ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৫
স্নানের শব্দ
আজকের মিটিংটা একই সঙ্গে জরুরি আর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মচমচে গরম সিঙ্গাড়া আর লেবু চা খেতে খেতে এজেন্ডাগুলো আলোচনা করে কয়েকটা নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারও ছিল। আর সেখানেই সবার সামনে ওসমান গণির সঙ্গে এক হাত হয়ে গেল শবনমের।
অননুমোদিত অনুপস্থিত কর্মীদের বেতন কাটা সংক্রান্ত একটা প্রস্তাবের সমর্থন দিয়েছিল ওসমান গণি আর মিটিং এ সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিল শবনম। আর তারপরেই ওসমান গণি বিদ্রুপের সুরে যেন ঠাট্টা করছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনি কি আজকাল এমপ্লয়িদের কাছে পপুলার হওয়ার চেষ্টা করছেন নাকি শবনম আপা? সামনে ইলেকশন করবেন? নাকি মানবাধিকার কমিশনে জয়েন করার ইচ্ছা আছে ..’
তার পরিহাসের ধরনে রাগ উঠে যায় শবনমের। ঝেড়ে একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেলে সে।
‘মানে কি, ওসমান গণি? আপনি বুঝতে পারছেন না, এই ডিসিশনটায় এমপ্লয়ি মাইগ্রেশন বেড়ে যাবে, কোম্পানির লস হবে। আমি তো নিজের জন্য কিছু বলি নাই। আপনিও আশা করি বোঝেন, কর্মীদের পেছনে পর্যাপ্ত ইনভেস্টমেন্ট না করে শুধু কাজের বোঝা চাপিয়ে দিলে ভাল রেজাল্ট আসে না। তখন তারা কাজে ফাঁকি দেয়, চাকরি ছেড়ে পালায়। আমি কোম্পানির ভালোর জন্যই এটা বলছি..’
শবনম বুঝতে পারছিল ওসমান গণির মাথার উপর নির্ঝর চৌধুরীর আধিপত্যবাদী আশীর্বাদের অদৃশ্য হাত আছে, কিন্তু তবু মিটিং এর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা না করে পারল না সে।
ওসমান গণি তীর্যকভাবে জিজ্ঞেস করল, ‘কোম্পানির জন্য আপনার কি এমন অবদান আছে আপা? শুধু লম্বা সময় উপরের পদ আঁকড়ে বসে থাকলেই কি সব হয়ে যায় নাকি?’
এর পর শবনম আর মেজাজ ধরে রাখতে পারল না, সে বেশ উচ্চ কণ্ঠেই বলল, ‘ওসমান গণি ব্যক্তিগত আক্রমণ বন্ধ করেন, আপনার কাছে এসব ফালতু প্রশ্নের জবাবদিহি করতে আমি বাধ্য নই। আমার কি অবদান সেটা কোম্পানি জানে, আপনি এই প্রশ্ন তোলার কে?’
শেষ পর্যন্ত নির্ঝর চৌধুরীর হস্তক্ষেপে ওসমান গণি চুপ করলেও নোট অব ডিসেন্ট জানিয়ে মিটিং থেকে বেরিয়ে আসে শবনম। মাথা ধরে গেছে তার, কপালের দুই পাশের রগ চিনচিন করে ব্যাথা করছে। জানে, হয়ত তাকে নিয়ে আড়ালে আবডালে বাজে কথা হবে, হাসাহাসি হবে। হয়ত সবচে বয়স্ক পুরুষটাই দাঁত কেলিয়ে বলবে, ‘শবনম আপার বয়স হয়ে গেছে, এখন অবসরে যাওয়া দরকার।’
আরেকজন হয়ত টিপ্পনী কেটে তাকে তাল দেবে, ‘হে, হে, হে, মেনোপজের পর নারীদের মন মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, বেশি রাগ দেখায়, নিজের ঘরেও তো দেখিরে ভাই! একই অবস্থা !’
চাইলেও এই লোকদের নোংরা মুখ তো আর বন্ধ করতে পারবে না শবনম। এরা হয়ত এরকম কথা সারা জীবন ধরে বলতেই থাকবে। হয়ত তাদের পরের প্রজন্ম আর এসব বলবে না। তারা সহকর্মী নারীকে শ্রদ্ধা করবে, সহমর্মী হবে। চাকরি জীবনের শুরুতে তো সত্যিকারের অসুস্থতার জন্য ছুটি চাইতেও ইতস্তত বোধ করত শবনম পাছে না আবার বসরা বলে বসেন, ‘এসেছেন এক চির-রুগ্ননারী, প্রতিমাসে তার অসুস্থতার জন্য ছুটি চাই।’
আর এখনকার মেয়েরা তো দিব্যি পিরিয়ডের প্রথম দু’চারদিন ছুটির দাবি তুলছে। বেশিরভাগ সময়ই পিরিয়ডের প্রথম কয়েকটি দিন কী ভীষণ অস্বস্তি, পেটে ব্যাথা, ক্লান্তি আর দুর্বলভাব শরীরে ভর করে, তা নারীমাত্রই জানে। শবনম মনে করতে পারে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের দিনগুলোতে ব্যাগে একস্ট্রা প্যাড নিয়ে শারীরিক মানসিক অবসাদে ধুঁকতে ধুঁকতে অফিসে আসার দিনগুলোর কথা। শারীরিক সব অসুবিধা মনের জোরে উপেক্ষা করে টেবিলে উট পাখির মতো মুখ গুজে কাজ করার কথা। এমন দিন কি সত্যিই এই দেশে কোনোদিন আসবে, যেদিন পিরিয়ডের অস্বস্তি আর অসুবিধা সামলানোর জন্য মেয়েরা বছরে অন্তত বারোটা দিন বেশি ছুটি পাবে?
নাকি তখন নাক কুঁচকে বলা হবে, ‘মেয়েদের বাচ্চা হওয়ার জন্য কত লম্বা ছুটি দিতে হয়, আবার পিরিয়ডের জন্যও ছুটি দিতে হবে নাকি? তারচে মেয়েদের কাজে নেওয়ারই দরকার নেই ..’
অথচ, শবনম মনে করে, নারী পুরুষের শারীরবৃত্তিয় পার্থক্য স্বীকার করতে কোনো দোষও নেই, লজ্জাও নেই। এই পার্থক্যকে মান্য করেও নারীপুরুষ সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে এগুনো যায়। কোনো দিন যদি কোম্পানির শীর্ষ পদে যাই, তবে এটা বাস্তবায়ন করে দেখাবো, মনে মনে ভাবে শবনম। ভাবে আর নিজের মনেই হাসে, আকাশকুসুম? ‘আমি কেবলি স্বপন করেছি বপন বাতাসে, তাই আকাশ কুসুম করিনু চয়ন হতাশে..’
সে কি আর জানে না, ক্ষমতা বিষয়টাই কতখানি পুরুষতান্ত্রিক। সেখানে কারো জন্য সহমর্মিতা, সমবেদনা, সহানুভূতি দেখানোর কোনো জায়গা নেই। দেখালে সেটা তোমার দুর্বলতা। তাছাড়া, এটাও তো হয়, যে ক্ষমতার শীর্ষে বসেও ক্ষমতা কাঠামোর প্রচলিত বিন্যাসের কারণে নারী অনেকসময় চাইলেও কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তাকে ঘিরে থাকা পুরুষতান্ত্রিক বলয় সেই সুযোগ তাকে কখনোই দেয় না, বরং ছলে বলে কৌশলে বাধ্য করে নিজেদের বৃত্তে আটকে রাখতে।
শবনম মাছের মতো মুখ খুলে জোরে কয়েকবার শ্বাস নেয়। নিজেকে প্রবোধ দিতে মনে মনে বলে, অবস্থাকে বদলাতে না পারলে মেনে নিতে হয়। মেনে নিলে মন দূষিত হয় না। সহনীয় হয়। অবশ্যই এর মানে পরাজয় নয়, বর্তমানকে কেবল স্বীকার করে নেওয়া। তখন বদলাবার বাস্তবতাটা তৈরি হয়। হ্যাঁ, এটা সত্যি মাঝে মাঝে এই মেনে নেওয়াটা একদমই সহজ থাকে না। মন কিছুতেই কিছু বুঝতে চায় না। আবার অনেক সময় দেখা যায়, মেনে নেওয়ার পরও অপমানগুলো ভোলা যায় না। এই না ভুলতে পারাটাও একধরনের মানসিক কষ্ট দেয়। অশান্তি উৎপাদন করে। অথচ কর্মক্ষেত্রে শুরু থেকেই মধ্য পস্থা অবলম্বন করে চলেছে শবনম। সহকর্মীদের সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় মতানৈক্য, মনোমালিন্য সযত্নে এড়িয়ে চলেছে। চেষ্টা করেছে সবার সঙ্গে যতটা সম্ভব সুসম্পর্ক বজায় রাখতে। কিন্তু আর কতো? সব সময় গা বাঁচিয়ে চলা খুবই কঠিন হয়ে পড়ছে ইদানিং। নিজেকে এখন সুবিধাবাদী মনে হয়, মনে হয় মেরুদণ্ডহীন কেঁচোর জীবনযাপন করছে সে। দুর্যোগ দুর্বিপাক দেখা দিলেই তার মুখোমুখি না দাঁড়িয়ে লুকিয়ে পড়ছে নিজের গর্তে।
শবনম ভাবে, এই অফিস, তার চারপাশের চেনা কদর্য মুখগুলো সব ছেড়ে ছুড়ে কোথাও একটা যেতে হবে, কিন্তু সেটা কোথায় ঠিক জানা নেই। হতে পারে দূরের কোনো শান্ত গ্রামে, বিচ্ছিন্ন কোনো সবুজ দ্বীপে, কোনো ঘুমঘুম অবসন্ন নদীর ধারে, কোনো বিজন পাহাড়ে একা বা দল বেঁধে.. মৌসুমিকে বলা যায় উদ্যোগ নিতে। এটা হতে পারে, ওনলি ফিমেইল ট্রিপ। মন প্রাণ খুলে শুধু বিশুদ্ধ হা হা হি হি...
ফোনটা আসে তখনই, অপর প্রান্তে সালেহা খাতুনের নার্স মোমেনার উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর শোনা যায়,
‘ম্যাডাম,খালাম্মার শরীর হঠাৎ খুবই খারাপ করছে, পালস পাইতেছি না, অ্যাম্বুলেন্স খবর দিছি, হাসপাতালে নেওয়া লাগবে।’
মাসের মধ্যে দুয়েকবার এমন ঘটে, সালেহা খাতুন নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে যান, তারপর কয়েকদিন হাসপাতালে বসবাস শেষে খানিকটা ভাল হয়ে আবার বাড়িতে ফিরে আসেন। নার্সদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া আছে, তারা জানে কখন কি করতে হবে, সে জন্য মাস গেলে মোটা অংকের টাকা দেওয়া হয় তাদের। এবারো আগের মতোই কিছু হয়েছে হয়ত, ভাবল শবনম। ফোনেই বলে দিল, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যেতে। চেনা ডাক্তারকে ফোন দিল। তারপর ব্যবসার কাজে চট্টগ্রামে থাকা তারেক ম্যাসেজ দিল। টেবিলে জমে থাকা দুটো জরুরি ফাইল দেখে স্বাক্ষর করল, সবশেষে সিইওকে বলে বেরিয়ে পড়লো হাসপাতালের উদ্দেশে।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
স্নানের শব্দ: পর্ব-৪
আরএ/