ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩
স্নানের শব্দ
অফিসে ঢোকার মুখেই, লিফট থেকে নেমে, ওসমান গণির সঙ্গে দেখা, ওসমান গণির চেহারা অনেকটা গোলগাল চাইনিজদের মতো, ছোট ছোট চোখ, মাথায় সোজা পাতলা চুল, মুখে ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, লম্বায় মাঝারি, মোটাসোটা শরীর, একটা আকাশি রঙের সার্টের সঙ্গে গলায় নেভি ব্লু রঙের টাই ঝুলিয়েছে গণি, শবনমকে দেখে হাসি মুখে বলল, ‘গুড মর্ণিং শবনম আপা, ইউ আর লুকিং গ্রেট!’
কর্পোরেটের চলতি নিয়মমাফিক মুখে হাল্কা হাসি ঝুলিয়ে গণিকে পাল্টা সম্ভাষণ জানাল শবনম। যদিও শবনম খুব ভাল করেই জানে গণি হারামজাদা হয়ত মনে মনে বলছে, ‘বুড়ির ঢং কত! এই বয়সেও কি সাজুগুজু কইরা অফিসে আসছে !’
এই মুহূর্তে অফিসে শবনমের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ওসমান গণি, প্রকিউরমেন্ট ডিপার্টমেন্টের হেড, তবে ম্যানেজমেন্টের ব্যাপক তোষামোদি করে সব কিছুতেই ওর চেয়ে এক ধাপ সামনে এগিয়ে আছে সে। থাকুক এগিয়ে, উচ্চপদস্থদের চাটুকারিতা করা শবনমের পক্ষে আগেও সম্ভব হয়নি কোনদিন আর হবেও না, এই যোগ্যতাটি (!) না থাকার কারণে জীবনে মাশুলও গুনতে হয়েছে অনেক, চোখের সামনে হাত কচলানো পার্টি সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে, আর সে পড়ে রয়েছে বেকুবের মতো লাইনের পেছনে। শবনম জানে, ব্যক্তিত্বহীন বসরাই তোষামোদী পছন্দ করে, আর যারা কাজে ফাঁকি দেয়, অসৎ, যারা অনৈতিক সুবিধা পেতে চায়, তারাই হয়ত ঊর্ধ্বতনদের তোষামোদি করে নিজের মতলব হাসিল করে।
এই কোম্পানির সিইও যিনি, টপ ম্যানেজমেন্টের খুব পছন্দের লোক নির্ঝর চৌধুরী সুন্দর চেহারার স্মার্ট, পরিপাটি, হাসিখুশি দীর্ঘদেহী ভদ্রলোক, বহুদিন দেশের বাইরে ছিলেন, বড় বড় কোম্পানিতে কাজ করেছেন কিন্তু দিন শেষে তিনিও কি চাটুকারদেরই পছন্দ করেন না? শবনমের স্বাধীনচেতা দৃঢ় মনোভাব যে তার তেমন পছন্দ নয়, সেটা উৎকট ভাবে প্রকাশ না করলেও শবনম তার অপছন্দের ব্যাপারটা নিজের সিক্সথ সেন্স দিয়ে ধরতে পারে। ফলে, শবনমও তার সঙ্গে একটা প্রয়োজনীয় পেশাদারি দুরত্ব বজায় রেখে নিজের নির্ধারিত কাজ কর্মগুলো করে যায়।
নির্ঝর চৌধুরী সারাক্ষণই অফিস মিটিংগুলোতে বলতে থাকেন, কোম্পানিতে গণতান্ত্রিক চর্চা চালু করতে হবে, টপ টু বটম সবার মতামতের মূল্য আছে, আমি সব বিষয়ে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করি। কিন্তু মুখে যাই বলুক, শবনমের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে তিনি আসলে চান সবাই তার সিদ্ধান্তকেই সমর্থন করুক। ওসমান গণিও এটা না বোঝার মতো বোকা নয় আর সে কারণেই সবসময় সে আগ বাড়িয়ে বলতে শুরু করে, ‘অসাধারণ প্রস্তাব স্যার। অতি উত্তম প্রস্তাব, আপনার মাথায় কিভাবে এত চমৎকার সব আইডিয়া আসে বুঝি না..’
নির্ঝর চৌধুরী মুচকি হেসে বলেন, ‘অভিজ্ঞতা, বুঝলে গণি, অভিজ্ঞতার মূল্য জ্ঞানের চেয়ে বেশি! কি বলেন শবনম?’ শবনমও মাথা নাড়ে। শুকনো গলায় বলে, ‘সে তো অবশ্যই!’
তার নিজের চাকরিজীবনও যে বাইশ বছর পেরুতে চলল সে কথা আর এই মজলিশে বলে কি হবে? এখানে টিকতে হলে নির্ঝর চৌধুরীর স্তাবকতা করতে হবে, মাথা দুলিয়ে বলতে হবে, ‘চমৎকার সে হতেই হবে, হুজুরের মতে অমতকার?’ অমত নেই। অমত হলে বা মতবিরোধ তৈরি হলেই তো সমস্যা। নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে গেলে বসের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। শবনম নিজেকে বুঝিয়েছে, খামাকা বিরোধিতায় যাওয়ার দরকার নেই, এই মত যদি তোমার পছন্দ না হয় তাহলে স্রেফ চুপ করে থাক, আর যদি দেখ তোমার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে তখন মত প্রকাশ কর।
এই অফিসগুলো তো অফিস নয় যেন ইঁদুর দৌড়ের মাঠ, এখানে সবাই দৌড়ায় উপরে উঠার জন্য আর কর্তৃপক্ষের সুনজরে পড়ার জন্য। শবনমের পুরনো কলিগ বিল্লাহ ভাইয়ের কথা মনে পড়ে, ‘বুঝলেন শবনম, বসদের সবসময় দেখাবেন আপনি খুবই ব্যস্ত, সারাক্ষণই তাদের সামনে ফাইলপত্র হাতে অযথাই ছোটাছুটি করবেন, উঠতে বসতে সালাম দেবেন, শুধু মাথা নিচু করে কাজ করলে হবে না, কাজ দেখাতে হবে, নইলে নেপোয় খাবে দই আর আপনি আফসোস করে মরবেন..’
শবনম ইন্টারকমে ফোন করে অ্যাকাউন্টসের নতুন ছেলেটাকে ডেকে পাঠায়, সেদিন খুব কড়া ডোজ দিয়ে ফেলেছে, আজকে একটু মলম লাগিয়ে দিতে হবে, যাতে ক্ষতটা স্থায়ী না হয়, সহকর্মীদের মনের অবস্থাটা খেয়াল রাখাও একজন ভাল বসের দায়িত্ব।
‘এসো মনিরুজ্জামান, বসো, এই অফিসে কতদিন হলো জয়েন করেছ? এটাই প্রথম চাকরি?’
‘নয় মাস ম্যাডাম। জি¦, এটাই প্রথম ফুল টাইম জব।’
শবনম তার সামনে বসে থাকা মনিরুজ্জামানকে ভাল করে লক্ষ্য করে। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যাম, মাথায় ঘন কালো কোকড়া চুল, ক্লিন শেভড চেহারায় এখনো গ্রামীণ তারুণ্য ও সারল্যের ছাপ পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। শবনম ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসল, তাকে চা অফার করল, তারপর জানতে চাইল, ‘তোমার জীবনে তুমি কতদূর যেতে চাও মনিরুজ্জামান?’
মনির কিছুক্ষণ ইতস্তত করে, তারপর বলে, ‘এইতো,সবাই যেমন শীর্ষে যেতে চায় ম্যাডাম তেমন ..’
‘ভেরি গুড। বড় স্বপ্ন দেখতে হবে, বড় আশা করতে হবে। আর পজেটিভ থিংকিং প্র্যাকটিস করবে। গ্লাস অর্ধেক ভর্তি দেখা শিখবে, অর্ধেক খালি দেখা না, ঠিক আছে? মনোছবি বুঝো? মনে মনে নিজেকে কোথায় দেখতে চাও তার একটা ছবি তৈরি করবে, প্রতিদিন, তারপর সেই অনুযায়ী কাজ করে যাবে। মানুষের মধ্যে ভালটা খুঁজে বের করে সেটার প্রশংসা করবে, প্রশংসা না করতে পারলে চুপ থাকবে, সেটাও ভাল। এগুলি প্র্যাকটিস। কয়েকদিন চর্চা করো, দেখবে অভ্যাস হয়ে যাবে। বেশিরভাগ সময় নেতিবাচক চিন্তা মানুষকে পিছিয়ে দেয়, এটা মনে রেখো.. ’
‘ম্যাডাম, আমি আপনাকে অনেক পছন্দ করি, আসলে সেদিন..’
মনিরুজ্জামান হড়বড় করে বলতে শুরু করলে শবনম ডান হাতটা সামান্য উঁচু করে তাকে থামিয়ে দেয়। এরচে বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না।
‘ঠিকাছে মনিরুজ্জামান। উইশ ইউ অল দ্য বেস্ট, মনোযোগ দিয়ে কাজ করো কেমন!’
মনিরুজ্জামানের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে নিজের তরুণ বয়সের কথা মনে পড়ে শবনমের, একেবারে সেলফ মেড মানুষ সে, বাবা-চাচা-মামার জোর ছাড়া যেমন হয় সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার, স্রেফ নিজের সাহস আর আত্মবিশ্বাসে ভর করে এগিয়ে যাওয়া তার, ইমতিয়াজের সঙ্গে জেদ করে নেদারল্যান্ডসে এক বছরের মাস্টার্স কোর্সটা না করলে অবশ্য এ জায়গায় আসা সম্ভব হতো কিনা কে জানে, বিদেশি ডিগ্রিটা চাকরি জীবনে তাকে অনেক পয়েন্টে এগিয়ে রেখেছে। সবাই জানতো, ইমতিয়াজ আর শবনম এক সঙ্গেই বাইরে পড়তে যাবে। ডিপার্টমেন্টে সবসময় ফার্স্ট ক্লাস ফাস্ট ইমতিয়াজ, শবনম কখনো সেকেন্ড, কখনো থার্ড। তাতে অবশ্য আফসোস ছিল না শবনমের, ইমতিয়াজ তো তারই, ফলে ইমতিয়াজের সাফল্য মনে হতো শবনমের নিজেরই সাফল্য। কিন্তু ইমতিয়াজ যখন ফুল স্কলারশিপে হার্র্ভার্ডে পড়ার চান্স পেয়ে গেল, তখন থেকেই কেমন যেন বদলে যেতে শুরু করল। এই বদলানোগুলো মুখে বলে ঠিক বোঝানো যায় না, কিন্তু কাছের মানুষরা ঠিকই তা অনুভব করতে পারে। তারা বোঝে কোথায়ও তাল কেটে গেছে, ছন্দ পতন হয়েছে, কি যেন আর আগের মতো মিলছে না। তারা কেউ কাউকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় বলেনি আবার নিজের একান্ত জীবনে স্বাগতমও জানায়নি। কিভাবে যেন, দুজনেই বুঝে গেছে দুজনের দুটি পথ এক হয়ে মিশে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। অভিযোগ, অনুযোগ, অভিমানের চেয়ে শবনমের গায়ে বেশি লেগেছিল অপমানটুকু। পরাজয় আর প্রত্যাখ্যানের অপমান। নেদারল্যান্ডসের ঠাণ্ডা শীতল বরফ জমা সেই নিঃসঙ্গ নির্বান্ধব লেইডেন শহরে দীর্ঘ এগার মাস অপমানটা বুকের মধ্যে পুষে রেখে শক্ত পাথর বিছানো পথে রক্তাক্ত পায়ে আর মনে হেঁটে, দাঁতে দাঁত চেপে ডিগ্রিটা নিয়ে দেশে ফিরে অল্প কয়েকদিনের পরিচয়ে বড় ভাইয়ের বন্ধু তারেককে বিয়ে করে ফেলেছিল শবনম।
তারেকের তেমন বিদ্যা নেই, বিদ্যার অহংকারও নেই, অদ্ভুত এক সরল জীবনযাপনের স্বপ্ন দেখে দেখেই সে কাটিয়ে দিয়েছে শবনমের সঙ্গে এতগুলো বছর, যেন সঙ্গে থেকেও নেই, পাশে থেকেও দূরে কোথাও, নিজের মধ্যে নিমগ্ন, নির্লিপ্ত ধ্যানী বুদ্ধ। এতে একদিকে ভালই হয়েছে, নিজের পেশাগত জীবন নিজের ইচ্ছামতো গুছিয়ে নিতে পেরেছে শবনম। প্রেম ছিল, তবে সেটা শুধু নিজের কাজের সঙ্গে নিজের, কোথায়ও আর কোনোদিকে চোখ মেলে তাকায়নি সে, তাকাতে ইচ্ছাও করেনি। ওই দরজা লোহার সিলমোহর মেরে চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে শবনম। অন্তত প্রেম নিয়ে আর কোনো পুরুষের কাছে গিয়ে কাঁদুনি গাওয়ার ইচ্ছা হয়নি তার। পুরুষ, অনেক সময়, নারীর কান্নার অর্থও ঠিকমতো বুঝতে পারে না। নিজেদের মনের মতো ভুল অর্থ করে সবজান্তার মতো নিজের বানানো পৃথিবীতে ভাব ধরে বসে থাকে।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/