ধারাবাহিক উপন্যাস, পর্ব: ৬
অঘ্রানের অন্ধকারে
তুরির সঙ্গে শাবিনের আবার দেখা হলো পরদিন রাতে। তুরি গিয়েছিল শপিংয়ে। ছোটোখাটো টুকটাক কেনাকাটা। তাতে রাত হয়ে গেল। রিকশা থেকে নামতেই দেখে ওদের অ্যাপার্টমেন্টের সামনে শাবিন দাঁড়িয়ে আছে।
তুরি এগিয়ে এসে বলল, ‘আপনি!’
তুরির সঙ্গে গতকাল কথা বলার পর থেকে শাবিনের মন কেমন যেন অস্থির হয়ে পড়েছে। খানিক বিভোর, খানিক ছটফটে। তুরির দিকে তাকিয়ে ওর আবারও মনে হলো, মানুষ এত সুন্দর হয়! অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিল শাবিন। তুরির প্রশ্নে চমকাল।
‘আমার কাছে এসেছেন, না অন্য কোনো কাজে?’
শাবিন যতখানি সম্ভব নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘গতকাল একটা মিথ্যা বলেছিলাম আপনাকে। কেন বলেছিলাম জানি না। তবে বলার পর থেকে খারাপ লাগছে। তাই স্যরি বলতে এসেছি।’
‘মিথ্যেটা কী?’
‘আমার মা আমাকে ‘সাবু’ বলে ডাকেন না। ডাকেন ‘শিব’ বলে।’
‘বাহ্ ভালো তো। শিব হচ্ছেন দেবতা। শিব অর্থ সুন্দর। মঙ্গল, কল্যাণ।’
‘আমার কেমন জানি লাগে।’
‘সে মা ডাকেন ডাকুন। আপনাকে আমি ‘শাবিন’ বলেই ডাকব।’
তুরি তাকায় শাবিনের দিকে। ছেলেটিকে ভালো লাগে। সহজ সরল। ওর দৃষ্টিতে কী যেন আছে। চোখের দিকে তাকালে বুকের ভেতর অচেনা তোলপাড় শুরু হয় নিজের অজান্তে। ওর দৃষ্টি যেন ভেতরটাকে স্পর্শ করে খুব আলতোভাবে নরম করে।
তুরি বলল, ‘কাল আসুন বাসায়। বড়ো’পার সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।’
শাবিন পরদিন বিকেলে এলো তুরিদের বাসায়। তুরির বড়ো আপাকে বেশ ভালো লাগল শাবিনের। ভীষণ প্রাণবন্ত। খুব হাসেন। নিপাট ভালোমানুষ। আদুরে ভঙ্গিতে মিষ্টি করে কথা বলেন। দু’এক কথার পর কী সুন্দর ‘তুমি’ করে বললেন, ‘শাবিন ভাই শোনো! আমার ওই আপনি টাপনি কিন্তু আসে না। আমি তোমাকে ‘তুমি’ করে বলব।’
‘আমি খুশি হব। আপনি তো আমারও বড়ো বোন।’ কাতর গলায় শাবিন বলল, ‘আমার কোনো বড়ো বোন নেই।’
‘হয়েছে। আমি তোমার বড়ো বোন।’
শাবিন বড়ো আপার কথা শুনে যত না মুগ্ধ হলো তারচেয়ে বেশি হয়েছে খুশি। বড় আপা ওদের ড্রয়িংরুমে বসিয়ে ভেতরে গেলেন নাস্তা বানাতে। আজ নাকি শাবিনকে আপা এক্সপেরিমেন্টাল স্ন্যাকস টেস্ট করাবেন।
তুরি আর শাবিন বসে আছে। তারা নিজেরা কথা বলছে। যেন কতদিনের পরিচিত। শাবিন নিজের কথা বলে যাচ্ছে। তুরি তুরির। শাবিনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তুরি অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ছে বারবার। তার ভেতরে কোথায় যেন তিরতির করে কেঁপে উঠছে। সেই কাঁপন ধরা দিয়েছে চোখের পাতায়।
তুরি বলল, ‘মাঝেমধ্যে খুব হাঁসফাঁস লাগে। ছুটে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে কোথাও। ঠিক বুঝতে পারি না কোথায় যেতে মন চায়। সমুদ্র নাকি পাহাড়ের কাছে। নাকি দূর কোনো নির্জন গ্রামে।’
শাবিন বলল, ‘বেরিয়ে পড়লেই হয়। পথই নিয়ে যাবে কোথাও।’
‘এরকম টুকটাক ভালোলাগা, নিজেদের পছন্দের কথা ভাগাভাগি করে নেয় ওরা।’
কোথাও যাওয়া যে তুরির বারণ। আবার কোন ভুল পিছু টানে! কিছুই দেখা হলো না তার। না সমুদ্র, না পাহাড়। না কোনো এক নির্জন গ্রাম। এসবের কিছুই শাবিনকে বলে না তুরি।
শাবিন জিগ্যেস করল, ‘কেন যাওয়া হয়নি কোথাও?’
তুরি হাসে। ওর সেই মন পাগল করা হাসি। বলল, ‘তারাশঙ্করের ‘কবি’র কথা মনে আছে? নিতাই গান লিখল, ‘আমার কর্মফল, দয়া করে ঘুচাও হরি-জনম করো সফল।’ আমার হয়েছে সেই দশা। সবই আমার কর্মফল।’
‘কবি পড়া হয়নি’, লজ্জা পায় শাবিন কথাটা বলতে গিয়ে।
তুরি অবাক হয়ে বলে, ‘‘কবি’ পড়েননি! বিরাট মিস করেছেন। আচ্ছা ঠিক আছে ‘দৃষ্টিদান’ তো পড়েছেন।’
‘বাউণ্ডুলে টাইপ মানুষ আমি। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন কেউ কোনোদিন খোঁজ নেইনি আমার। কী পড়ছি, আদৌ পড়ছি কিনা। ইশকুল, কলেজে পড়ার সময় পরীক্ষা দিতাম কিনা, পাশ করেছি কিনা-এসব কেউ কখনো জানেনি। আমাকে নিয়ে কারও কখনো কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এখনো নেই।’
তুরি খেয়াল করল শাবিনের চোখভরা অভিমান। তার চোখ থেকে অভিমান ঝরে পড়ছে। তাকে কথাগুলো বলতে পেরে নিশ্চয় শাবিনের ভালো লাগছে।
‘বন্ধুদের সাথে ইশকুলে যেতাম। অনেকদিন দেখেছি আমার শার্টের বোতাম ছেঁড়া। বন্ধুরা দেখিয়ে দিত। কেউ কেউ হাসাহাসি করত।’
‘মা খেয়াল করতেন না?’
শাবিন বুকের ভেতর লম্বা শ্বাস টেনে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘চণ্ডালের মতো রাগ বাবার। কথায় কথায় রাগারাগি করত। মা বেশিরভাগ সময় ব্যস্ত থাকত বাবা যাতে রেগে না যান। আমার দিকে খেয়াল করার সময় ছিল না তার।’
কথাগুলো বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো শাবিনের। মুখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে। তুরি মাথা নিচু করে বসে আছে বিভোর হয়ে। বুকের ভেতর নিজের অজানিতেই মোচড় দিয়ে ওঠে তুরির। তবে চট করে নিজেকে সামলেও নেয়।
তুরি নিচু গলায় জিগ্যেস করল, ‘আর কলেজে?’
‘তখন পাড়ার বন্ধুদের কাছ থেকে মাস্তান হওয়ার ট্রেনিং নিতে শুরু করেছি। মাস্তান হতে পারলাম না। তাদের সঙ্গে থাকলাম ঠিকই তবে আলাদা হয়ে। ভার্সিটিতেও একই অবস্থা। গতবছর পরীক্ষা ড্রপ দিয়েছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর পড়াশোনা করব না।’
‘এমন ভাবার কোনো মানে নেই। নতুন করে আবার শুরু করা যায় সব। ইচ্ছে করলেই হয়।’
শাবিন নিজের ভেতর শক্তি খুঁজে পাচ্ছে। উচ্ছ্বল চোখে বলল, ‘আপনি একটা কাজ করবেন? আমাকে কয়েকটা বইয়ের নাম লিখে দিন। আমি পড়ব।’
‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পগুলো পড়ুন।’
‘ওরকম করে বললে হবে না। কাগজে লিখে দিন।’
‘ঠিক আছে। লিখে দিচ্ছি। প্রথমে খুব বেশি না। অল্প কয়েকটা। কমন বাঁধলে সেগুলো পড়ার দরকার নেই।’
তুরি কাগজ কলম এনে তাতে বইয়ের নামের তালিকা তৈরি করতে বসল। একটু চিন্তা করে আবার লেখে।
উদাস হয়ে পড়ে শাবিন। হঠাৎ নিজেকে খুব একা মনে হয়। শূন্য হয়ে আসে চারপাশ। মনে হয় কে যেন নেই। কোনোদিন কি কেউ ছিল যে ওকে নিয়ে ভেবেছে! ওর জন্য অস্থির হয়েছে কখনো! কেন জানি খুব মায়ের কথা মনে পড়ছে। বাবার সামনে মায়ের সেই ভীত মুখ।
শাবিনের দিকে তাকায় তুরি। মুখ ঘুরিয়ে আছে শাবিন অন্যদিকে। তুরি নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়িতে কে কে আছেন?’
‘শুধু মা। আর বাবা কোথায় আছেন জানি না।’
‘বাবা কোথায় আছেন জানেন না, বুঝিনি ব্যাপারটা।’
‘বাবা ইঞ্জিনিয়ার। পাশ করার পর অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা কাজে লাগানোর বিশেষ চেষ্টা করেননি। ব্যবসা শুরু করেছিলেন। প্রতিবছর ব্যবসায় লস খেয়েছেন। মাকে টর্চার করতেন নানার বাড়ি থেকে টাকা আনার জন্য। মা এনে দিয়েছে। বাবা এখন আমাদের সঙ্গে থাকেন না।’
কষ্ট হয় তুরির। একজন সাদাসিধে মানুষের জীবনটা এমন কেন হবে! চোখে পানি চলে এসেছিল। আটকায়। তুরি বলল, ‘পড়াশোনা করতে কি একেবারেই ইচ্ছে করে না?’
‘কতকিছুই তো ইচ্ছে করে। সব ইচ্ছে কি পূরণ হয়?’
‘আর কী ইচ্ছে হয়?’
‘ইচ্ছে হয় কোনো এক বড়ো পুকুরের পানিতে কারও সঙ্গে পা ডুবিয়ে বসে থাকি।’
বড়ো আপা এসেছেন নাস্তা নিয়ে। হইচই করে বললেন, ‘চুপচাপ খেয়ে যাবে। কোনো মন্তব্য করবে না। ইউটিউব থেকে রেসিপি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছি। আজই প্রথম।’
ঘরের গুমোট পরিবেশ হালকা হয়ে গেল। শাবিন বলল, ‘ভালো লাগলেও বলা যাবে না?’
‘তার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা হয়েছে অক্সিজেনের মতো। নিজে জ্বলে না, অন্যকে জ্বলতে সাহায্য করে। মুখে দিয়ে জ্বলে উঠবে।’
তুরি বলল, ‘যেমনই লাগুক এমন এক্সপ্রেশন দেবেন যেন মনে হয় খেতে খুব ভালো লাগছে।’
বড়ো আপা ওদের দুজনকে স্ন্যাকস দিয়েছে। শাবিন খেয়ে বলল, ‘ওয়াও! দারুণ হয়েছে।’
তুরি হেসে ফেলেছে। সে হাসতে হাসতে বলল, ‘বলেছিলাম শুধু এক্সপ্রেশন দিতে। আপনি দেখি ডায়ালগসহ দিচ্ছেন।’
খাবার সত্যি মজা হয়েছে। শাবিন আনন্দ নিয়ে খাচ্ছে।
(চলবে)