গল্প
জুলিদের কে বাঁচাবে
মিনহাজ মুস্তাফির নতুন বইটা দারুণ যাচ্ছে। মারমার কাটকাট অবস্থা। প্রকাশক ইঙ্গিত দিলেন সেদিন, দ্বিতীয় এডিশনে যেতে হবে শিগগির। তৃতীয়, এমন কি চতুর্থ সংস্করণেও যেতে হতে পারে গত বইটার মতো। স্ক্রিপ্টে ছোটখাটো ভুল আছে। মিনহাজ ভাবছিলো, এগুলো ঠিক করে নেবে। সমস্যা হচ্ছে, ও সময় বের করতে পারবে কিনা। একটা নতুন গল্পে ডুবে আছে ও। দিনরাত মাথা জুড়ে আছে সামনের বইটার কাহিনীর আউটলাইন। খাওয়া-দাওয়ার ঠিক নেই, জীবনযাপনের রুটিন ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে।
দিন পনেরো আগে বেরিয়েছে ‘ছোবল’। ওর থ্রিলার সিরিজের নতুন বই। ওর মোট পাঁচটা বই এখন বাজারে। প্রথম দুটো খুব একটা চলেনি। তৃতীয়টা থেকে কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়া পাঠকদের মুখে মুখে ওর নাম ফিরতে শুরু করে। চতুর্থটা সুপারহিট। বলতে গেলে সে-ই অজন্তা প্রকাশনীর প্রথম ক্রিয়েটিভ লেখক। এ প্রকাশনীর লেখক আরো আছেন। এরা সবাই স্কুল বা কলেজের সিনিয়র শিক্ষক, পাঠ্যপুস্তকের নোটবই লেখেন। কেউ কেউ লেখেন বেনামে। কিছু খাঁটি লেখকও আছেন তালিকায়। ছদ্মনামে নোটবই লিখে দফায় দফায় বহু টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। এখন নোটবইয়ের বাজার মন্দা যাচ্ছে। পরীক্ষার ধরন পাল্টে গেছে, নোটবই তেমন কাজে আসে না। অজন্তা প্রকাশনীর ব্যবসা প্রায় উঠে যাচ্ছিলো, এমন সময় প্রকাশনীর কর্ণধার আবুল বাশার মিনহাজ মুস্তাফির খোঁজ পেলেন। তাঁর কথায় ওটা ছিলো এক অলৌকিক যোগাযোগ। মিনহাজ তাঁকে রীতিমতো তলিয়ে যাওয়া থেকে উদ্ধার করেছে। আবুল বাশারের চোখে মিনহাজ এখন নিছক লেখক নয়, সে একটি বাতিঘর। সেদিন কথায় কথায় বললেন, ও তাঁর আলোর দিশারি।
অজন্তা নোটবইয়ের ব্যবসা নামমাত্র রেখে পুরোপুরি গল্প-উপন্যাস এবং জনপ্রিয় পুস্তক প্রকাশনায় নেমে যাচ্ছে। কিছু উপন্যাস বেরও করেছেন আবুল বাশার। মোটামুটি বাজার পেয়েছে। এখন তাদের দরকার মিনহাজের মতো লেখক, যারা শুরু থেকেই পাঠকদের মাতিয়ে রাখতে পারে। এজন্য চাই এমন কিছু রাইটার, যারা লেখেন থ্রিলার, হরর এবং অ্যাডভেঞ্চার জাতীয় বই। এসব বিষয়ে চৌকস লেখকের খুব অভাব। কিন্তু মিনহাজ আবিষ্কার করলো, এ বিষয়গুলো নিয়ে ও স্বচ্ছন্দে লিখে যেতে পারে। এসব বই এককালে পড়েছেও প্রচুর। তবে আপাতত ও থ্রিলার নিয়ে থাকবে। বিষয়টা নিয়ে ও নতুন আঙ্গিকে গল্প বলতে চায়। ওর সবকিছুই হবে চলতি থ্রিলারের চেয়ে ভিন্ন। ছকের বাইরে। প্রাইভেট ডিটেক্টিভ-কেন্দ্রিক গোয়েন্দা কাহিনী বা স্পাই থ্রিলারের সিক্রেট এজেন্টদের মিশন নিয়ে অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। তবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে ও আবুল বাশারকে বিপদে ফেলবে না। এখনই ওসব করলে পাঠক হারাবে। আপাতত ও চলতি ধারায়ই লিখে যাবে। মাঝে মাঝে গল্প এবং চরিত্র নিয়ে কিছু মজা।
সামনের বইটায় হালকাভাবে কিছু কাজ করতে চাইছে মিনহাজ। অবশ্য ও এরই মধ্যে একটা বড় কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। ওর সিরিজের সিক্রেট এজেন্ট জুলি শামসি। ঢাকায় বড় হওয়া এক টগবগে তরুণী। শ্যামলা এবং সুশ্রী।
পড়াশোনা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, সাবজেক্ট ছিলো ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানস। ওর মতোই। জুলি দুঃসাহসী এবং বেপরোয়া, কমান্ডো ট্রেনিং আছে। কামান ছাড়া যে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে পারে। কারাতে-কুংফু জানে। কাহিনীতে কখনো ও সিক্রেট এজেন্ট বা স্পাই, কখনো প্রাইভেট ডিটেক্টিভ। বয়স চব্বিশ-পঁচিশ।
ঢাকায় এবার মার্চের মাঝামাঝিতেই প্রচণ্ড গরম। রোদের জন্য বাইরে যাওয়া যায় না, ঘরে বসে অনবরত ঘামতে হয়। লেখা দূরে থাক, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তাও করতে পারছে না মিনহাজ। বাড়িওলাকে অফিসের কাজে সাতদিনের জন্য বাইরে যাওয়ার কথা বলে ও রাঙামাটি চলে এসেছে। ও যে এখন চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি লেখক, এটা তাঁকে বলা হয়নি এখনো। প্রকাশককে ও বলেছে, রাঙামাটিতে বসে ও নতুন বইটার কাজ করতে চায়। শুনে আবুল বাশার খুশি। বেশকিছু টাকাও দিয়ে দিলেন রয়্যাল্টির অ্যাডভান্স হিসেবে।
একটা এনজিওর রেস্টহাউজে উঠেছে মিনহাজ। এনজিওর লোকজন ওর অনেকদিনের বন্ধু। পাড়াটা নির্জন। কয়েক পা হেঁটে গেলে কাপ্তাই লেকের একটা বড় ঘাট। এখান থেকে ছোটবড় বোট ছাড়ে, পর্যটকরা বোট ভাড়া করে দুর্গম অঞ্চলে যায়। নৌকা আসে দূরের পাহাড়ি গ্রাম থেকে। বেশ কয়েক বছর পর রাঙামাটি এসেছে মিনহাজ। শহরে এবং আশেপাশের গ্রামে ওর কিছু আদিবাসি বন্ধু আছে। এ যাত্রা ওদের থেকে দূরে থাকতে হবে। খোঁজ পেলে দল বেঁধে চলে আসবে। তারপর শুধু হৈ-হল্লা, লেকে পাহাড়ে ঘোরাঘুরি। লেখাটা হবে না।
দশটার ওপর বাজে। রাঙামাটি শহরে অনেক রাত। মিনহাজের খিদে লাগছে না। দুপুরে চট্রগ্রাম থেকে বাসে ওঠার আগে ওখানকার বন্ধুরা ঠেসে খাইয়ে দিয়েছে। কমলের বাসায় বিশাল লাঞ্চের আয়োজন হয়েছিলো। পেট এখনো ভরা। সঙ্গে আনা বড় আকারের কলা দুটো খেয়ে রাতের খাবার সেরে নেবে কিনা ভাবছে মিনহাজ। রুমে ঝকঝকে এলসিডি টিভি। মিনহাজ রিমোট হাতে নিয়ে চ্যানেল ব্রাউজ করে। টিভি খুব একটা দেখে না ও। বিবিসি, সিএনএন-এর নিউজ এবং ডকুমেন্টারি, আর ডিসকভারি চ্যানেল দেখে সময় পেলে। আর দেখে স্টার মুভিজ এবং দু’তিনটা ইন্ডিয়ান চ্যানেল। বাংলাদেশি চ্যানেলের কয়েকটায় ওর বন্ধুবান্ধব আছে। ওগুলো সময় পেলে দেখে। পর্দায় ইন্দ্রানী হালদারকে দেখা যাচ্ছে। ঘড়ি দেখলো মিনহাজ। জি বাংলায় ‘গোয়েন্দা গিন্নি’ হচ্ছে। সিরিজটা জমেছে খুব। ইন্দ্রানীও দারুণ কাজ করছে। শহুরে মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন চটপটে গৃহবধূ কিভাবে সংসার সামলে শৌখিন গোয়েন্দা হতে পারে, এ নিয়ে সিরিজের গল্পগুলো।
কলকাতার মতো ঢাকায়ও খুব জনপ্রিয় হয়েছে এটি। ইন্দ্রানীর চরিত্র পারমিতা মিত্র খালি হাতে ক্রিমিনালের মুখোমুখি হয়। গয়না চুরির ঘটনা থেকে শুরু করে সম্পত্তি দখল বা ঈর্ষা-প্রতিহিংসাকে কেন্দ্র করে বিচিত্র ধরনের খুনের রহস্য উন্মোচন করে পারমিতা। ওর মূল অস্ত্র তীক্ষ্ম বুদ্ধি এবং পর্যবেক্ষণ শক্তি। একজন বড় মাপের শিল্পী ইন্দ্রানী। যখন ও সন্দেহভাজন কারো দিকে হালকা বিদ্রুপ ও করুণা মেশানো মুখে স্থির তাকিয়ে থাকে, ওর মুখখানা কিন্তু তখনো হাসি-হাসি। এ অভিব্যক্তির তুলনা নেই। মিনহাজ ক্লোজআপে ধরা ইন্দ্রানীর এই মুখের নাম দিয়েছে মোনালিসা-মুখ।
‘গোয়েন্দা গিন্নি’ সিরিজে পারমিতার ডানহাত পুলিশ অফিসার অরূপ, ওর দূরসম্পর্কের ভাই। যখন আসামির বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ বা ধাওয়া-তল্লাশির প্রয়োজন হয়, ভাইটি ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। কোনো কেসে ব্যর্থ হয় না পারমিতা। হুমকি বা চোখ রাঙানির পরোয়া করে না ও। আজকের গল্পটাও জমে উঠেছে। একই পরিবারের তিনজন খুন হয়েছে এক সপ্তাহের মধ্যে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায়। ছুরি, বন্দুক নয়, ওদের মারা হয়েছে দূর থেকে ছুঁড়ে মারা এক ধরনের ছোট তীর দিয়ে। ওগুলো এসে বিঁধেছে তিনজনেরই ঘাড়ে। খুনির অবিশ্বাস্য হাতের নিশানা পারমিতার মাথা গুলিয়ে দিচ্ছে। কী ধরনের মানুষ হতে পারে এই খুনি, কী তার বয়স? পারমিতা কূলকিনারা পাচ্ছে না। এদিকে জুলি শামসি তুখোড় নারী। সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে জানে। হাত-পায়ের প্যাঁচ কষে কাবু করতে পারে শত্রুকে।। দুর্দান্ত অভিনয় জানে। রাস্তার বোবা পাগলি, ছেলে-মাস্তান বা হাই সোসাইটির কলগার্ল থেকে শুরু করে ডাকাত দলের নাচনেওয়ালি অথবা মক্ষিরাণী --- সব ধরনের চরিত্রে স্বচ্ছন্দে ঢুকে যেতে পারে। একবার শুভ্রকেশি, অভিজাত এক বৃদ্ধার বেশ ধরেছিলো জুলি। ওর একটা বড় গুণ, ও বাংলার বাইরে ইংরেজি এবং স্প্যানিশ বলতে পারে অবলীলায়। সদ্য কৈশোর-পেরুনো ছেলেমেয়ে এবং তরুণ-তরুণীদের কাছে রোলমডেল হয়ে গেছে জুলি। বয়স্ক পাঠকও আছে মিনহাজের। যেমন ওর ছোটখালা। দুই সন্তানের মা। পাঁচটা মাত্র বই। কিন্তু এরই মধ্যে জুলি বাংলাদেশের নারীশক্তির এক জীবন্ত প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘গোয়েন্দা গিন্নি’ শেষ হয়ে গেলো। গল্প শেষ হয়নি। আগামীকালের পর্বে শেষ হবে। সেটা মিনহাজের দেখা না-ও হতে পারে। টেলিভিশন সিরিজ নিয়ে এক সমস্যা। ধারাবাহিকতা নষ্ট হয়। ফলে অনেক সময় কোনো কোনো গল্পের পুরো স্বাদ নেয়া যায় না। জুলি শামসি অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে দেশের বাইরে মাত্র যেতে শুরু করেছে। যে ক’টায় ও গেছে, সব সার্ক অঞ্চলের দেশ। একবার গেছে শ্রীলঙ্কা, আরেকবার বার্মার গভীর অরণ্যে। মিনহাজ ক’দিন ধরে ভাবছে জুলিকে দক্ষিণ আমেরিকার কোনো দেশে পাঠাবে। ঠিক করতে পারছে না কোন দেশে। ব্রাজিলে বৈচিত্র্যের শেষ নেই। বিশাল আমাজন বন, আমাজন নদী, দীর্ঘ সি-বিচ ---- সব আছে। দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় দেশ এটি, নানা ধরনের ক্রিমিনাল সিন্ডিকেটও ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন অঞ্চলে। সবগুলো বড় শহর জমকালো মহানগরী, কী নেই ওখানে। আধুনিক স্থাপত্যের বিস্ময়-জাগানো বহুতল অফিস ভবন, হোটেল, শপিং মল, চওড়া এভিনিউ যেমন আছে, তেমনি আছে বস্তি। সামনে আসছে অলিম্পিক গেমস। হবে রিও ডি জেনিরোতে। ওখানে একটা মিশনে বড় দেশের কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগী এজেন্ট হিসেবে পাঠানো যায় জুলিকে। কিন্তু একটা সমস্যা আছে। ব্রাজিল স্প্যানিশভাষী দক্ষিণ আমেরিকার দেশ। কিন্তু দেশটির প্রধান ভাষা পর্তুগিজ। কারণ ব্রাজিল এক সময় পর্তুগালের উপনিবেশ ছিলো। জুলি স্প্যানিশ ভালো জানে, পর্তুগিজ একেবারে না। এখন ওকে পর্তুগিজ শেখাতে গেলে ঝামেলা হবে। কারণ ও এখন তরুণ সম্প্রদায়ের কাছে প্রায় সুপারস্টার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইনস্টিটিউটে হয়তো পর্তুগিজ ডিপার্টমেন্ট আছে। কিন্তু ওখানে ও যাবে কীভাবে। ছাত্রছাত্রীরা ওকে চিনে ফেলবে। প্রতি বইয়ের প্রচ্ছদের এক কোনায় ওর ছবি। এক হাতে জেমস বন্ড স্টাইলে খাড়া করে রিভলবার ধরা মুখের এক পাশে, মাথায় চে গুয়েভারা ক্যাপ। কিন্তু জুলির মুখটি পরিষ্কার বোঝা যায়। ক্যাম্পাসে ও ঢুকলে ঝামেলা ঠেকানো মুশকিল হয়ে যাবে। অটোগ্রাফ দেবে, না ক্লাস করবে? প্ল্যানটা বাদ দিতে হলো।
চিন্তায় পড়ে গেছে মিনহাজ মুস্তাফি। পেছনের ব্যালকনিতে রেলিং ধরে দূরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে ও।। দোতলায় রুমের এ জায়গা থেকে লেকটা পরিষ্কার দেখা যায়। এখন বোঝা যাচ্ছে না।। মাঝেমধ্যে লেকে লালচে-হলুদ আলো দেখা যায়। ওগুলো ইঞ্জিন-বোট বা দেশি নৌকার লন্ঠন। কিছু আসছে, কিছু যাচ্ছে। বারান্দার পাশে একটা অচেনা ঝাঁকড়া গাছের মাথা। প্রচুর জোনাকি পাতার ফাঁকে ফাঁকে। একটা-দুটো দলছুট হয়ে চলে আসছে অন্ধকার ব্যালকনিতে। কলম্বিয়ার জঙ্গলে ড্রাগের আস্তানা, এগুলোর বিরুদ্ধে অপারেশন, বর্ডারে গেরিলা যুদ্ধ ইত্যাদি নিয়ে অনেক থ্রিলার লেখা হয়েছে। সিনেমা তৈরি হয়েছে। ওসব এখন চলবে না। পেরু আপাতত ঠাণ্ডা। শাইনিং পাথ গেরিলাদের কোনো খবর নেই বহুদিন। বরং জুলিকে ভেনিজুয়েলা পাঠানো যাক। কম্যুনিস্ট প্রেসিডেন্ট শাভেজ মারা যাওয়ার পর দেশটি এখন নাজুক অবস্থায়। অর্থনীতি ধসে যাচ্ছে। মানুষের অসন্তোষ বাড়ছে। নতুন বামপন্থী প্রেসিডেন্ট মাদুরো এসব সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। দেশি-বিদেশি চক্রান্তের কথা শোনা যাচ্ছে। মিলিটারি ক্যু’র আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা। এরকম এক জটিল এবং ঘোলাটে পরিস্থিতিতে কোনো একটা মিশনে জুলি শামসিকে পাঠানো যায়। কিন্তু কোন বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে ও কাজ করবে, মিনহাজ ঠিক করতে পারছে না। ভেনিজুয়েলায় সুবিধা না হলে মিনহাজ জুলিকে সোজা পাঠিয়ে দেবে বলিভিয়ায়। ওখানে সম্প্রতি মূল্যবান ধাতুর খনি পাওয়া গেছে। ক্ষমতায় বাম-ঘেঁষা সরকার। অনেক আঞ্চলিক শক্তির শ্যেনদৃষ্টি এখন দেশটির ওপর।
মোবাইলে রিংয়ের শব্দে চমকে উঠলো মিনহাজ। ও ভাবনায় ডুবে গিয়েছিলো।
হ্যালো, মিনহাজ ভাই, শুয়ে পড়েননি তো?
আবুল বাশারের গলা। ভারি, গমগমে। ফোনে এই কণ্ঠ নতুন কেউ শুনলে ভড়কে যাবে। অথচ ভদ্রলোক নরম ধরনের মানুষ।
না ভাই, জেগে আছি। আমার শুতে শুতে একটা-দেড়টা বেজে যাবে। কিছু কাজ আছে। মিনহাজ বললো।
শোনেন ভাই, আপনার ‘ছোবল’ সাপ্লাই দিয়ে কুলাতে পারছি না। স্টক শেষ। এ সপ্তাহেই সেকেন্ড এডিশন বের করতে হবে।
রাইটারের জন্য এটা গ্রেট নিউজ।
রাঙামাটি কতদিন থাকবেন? আবুল বাশারকে উদ্বিগ্ন শোনালো।
মাত্র এলাম। দুই সপ্তাহ তো থাকবোই। বান্দরবান, খাগড়াছড়িও যেতে পারি। মাথাটা জ্যাম হয়ে আছে। একটু হালকা করে আসি।
বুঝলাম, কিন্তু ...
কিন্তু কী?
দু’দিনের জন্য একটু ঢাকা আসা যায় না?
খুব জরুরি? প্রকাশকের মনের অবস্থা জেনেও মিনহাজ বললো।
বুঝতেই পারছেন। দেরি হলে পাঠক ছুটে যাবে। এরকম চান্স জীবনে কম আসে।
লেখালেখি বা বই বিক্রির সঙ্গে চান্স কথাটা মেলানো যায় না। কেমন একটা বাজারে ব্যাপার মনে হয়। কিন্তু এখন ও পপুলার লেখক। কমার্শিয়াল রাইটার। ওর তিনটা কবিতার বইয়ের মধ্যে প্রথমটা গোটা ত্রিশেক বিক্রি হয়েছে গত দশ বছরে। বাকিগুলোর কথা ভাবলে কান লাল হয়ে যায়। দুটো প্রেমের উপন্যাস বের করেছিলো নিজের খরচে। প্রায় সব কপি বন্ধুদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছে। আর এখন ওর বই ছাপা হচ্ছে হাজার হাজার। নতুন এডিশন হচ্ছে। পাবলিশার ঘাড়ের ওপর চড়ে বসে আছেন। ওর জীবনের ফ্রিডম শেষ। অবশ্য এতে এক্সাইটমেন্ট আছে। ওর জীবন এখন জুলি শামসির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। দিনরাত কাটে ঐ তরুণী সিক্রেট এজেন্টের সঙ্গে। ওর দুঃসাহসিক মিশনগুলো তৈরি করতে হয়, ওকে নানা কৌশল শেখাতে হয়। জুলির সব মিশনে ও আছে প্রচ্ছন্নভাবে। আবুল বাশারকে নিরাশ করার প্রশ্নই ওঠে না।
বাশার ভাই, আমি ঢাকা আসছি। তবে কাল-পরশু না। দু’দিন পর। আপনি ট্রেসিং বিছিয়ে রাখুন। আমি শুধু পেজগুলোতে একবার করে চোখ বুলিয়ে যাবো। টুকটাক বানান ভুল আছে। বেশির ভাগ বিদেশি শব্দ। ওগুলো ঠিক করতে হবে।
ঠিক আছে, তাই হবে ভাই। দেখবেন, ডেট যেন মিস না হয়। বাসে চিটাগাং গিয়ে ঢাকার প্লেন ধরবেন। তাহলে প্রায় একটি দিনের সময় বাঁচবে। ঠিক আছে? রাখি তাহলে।
না, না, আরেকটা কথা। আপনার প্রথম বই দুটোর জন্যও অর্ডার আসছে। কিছু ছেপে দেবো নাকি? আবুল বাশার দ্রুত বললেন।
সেটা আপনি ভালো বুঝবেন। দ্যাখেন ডিমান্ডের জোর কেমন। রাখি। মিনহাজ ফোন রেখে দিলো।
ও পরশুই ঢাকা যেতে পারতো। কিন্তু ইচ্ছে করে একদিন পরে যাচ্ছে। প্রকাশক তো টাকা গোনেন। কিন্তু লেখে ও। লেখার কষ্ট উনি কী বুঝবেন? এ যাত্রা বিশ্রাম না নিলে ও শিগগির আর সুযোগ পাবে না। মাথার কলকব্জা বিগড়ে যাবে। জুলিকে এবার ও নতুন ধরনের মিশনে পাঠাচ্ছে। তা-ও আবার অন্য এক মহাদেশে। ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তাভাবনার ব্যাপার আছে। সূক্ষ্ম প্ল্যানিংয়ের ব্যাপার আছে। দুটো দিন একা থাকলে জুলি কাজটা কতদূর পারবে, সেটা আন্দাজ করা যাবে। যদি খাগড়াছড়ির ভেতরের দিকে যাওয়ার প্রোগ্রাম ঠিক থাকে, ওকে সঙ্গে নেবে মিনহাজ। জুলিকে ও কখনো পাহাড় বা অরণ্যের ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখেনি।
দুই
রেস্টহাউজ থেকে কিছুদূর হেঁটে গিয়ে মিনহাজ ব্রেকফাস্ট সেরে এসেছে। ছিমছাম, ছোট রেস্তোরাঁ। আশেপাশের রেস্টহাউজের ট্যুরিস্টরাই মূল খদ্দের। ম্যানেজারের কাউন্টারে মাথায় ফুল গোঁজা এক আদিবাসি তরুণী। ভারী নাশ্তার পর চায়ের সঙ্গে সিগারেট। সারাদিনে মিনহাজ একবারই সিগারেট খায়। সিগারেট না হলে সকালের চা পানসে লাগে। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে এতটা সুন্দর অভিজ্ঞতা হলো। কোথাও আজকের পত্রিকা পাওয়া যায় কিনা দেখার জন্য একটু সামনে এগিয়ে গিয়েছিলো ও। ওর মন বলছিলো এদিকে কোথাও পত্রিকা পাওয়া যাবে। নিউজস্ট্যান্ড না থাকলেও এসব ছোট শহরে পান-সিগারেটের দোকান দৈনিক পত্রিকা রাখে। মিনহাজের জন্য একটা বড় চমক অপেক্ষা করছিলো।
বেশ কয়েক পা এগিয়ে যাওয়ার পর ও দেখলো কড়া হলুদ রংয়ের একতলা একটি বাড়ির গেটে পাঁচমিশালি দোকান। দোকানের সামনে লম্বা টুলের ওপর সারি সারি দৈনিক পত্রিকা বিছানো। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের। মাথার ওপর লম্বা দড়িতে ক্লিপে আটকানো সাপ্তাহিক পত্রিকা, ম্যাগাজিন। উত্তেজনায় মিনহাজের দম আটকে আসার উপক্রম হলো, যখন সে দেখলো একটা কাঠের র্যাকে সারি দিয়ে সাজানো পেপারব্যাক মাসুদ রানা এবং অন্যান্য থ্রিলারের সঙ্গে ওর জুলি শামসি সিরিজ। সবগুলো বইই আছে। ’ছোবল’ও। মিনহাজকে বইয়ের র্যাকের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কাউন্টারে বসা হালকা-পাতলা প্রৌঢ় ভদ্রলোকটি বললেন, ‘বই দেবো?’
এখন থাক। আচ্ছা, ঐ সিরিজটা বুঝি নতুন বেরিয়েছে? ঐ যে, জুলি শামসি? মিনহাজ বললো।
হ্যাঁ। খুব চলছে। কলেজের ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে কিনছে। আমি নিজেও পড়ি। নতুন ধরনের লেখা। মাসুদ রানার চেয়ে আলাদা।
তাই নাকি? বলতে বলতে মিনহাজ খেয়াল করে র্যাকে ওর সবগুলো বই আছে কিনা। ‘ছোবল’ আছে মাত্র একটা। প্রকাশক ভুল বলেননি। আসলেই কাটছে বইটা। একবার মনে হলো নিজের পরিচয়টা বলে দেয় মিনহাজ। অনেক কষ্টে ইচ্ছেটা দমাতে পারলো ও। নিজেকে গোপন রাখার একটা মজা আছে। দূর থেকে নিজেকে দেখা যায়। নিজের ওজনটাকে নিরাসক্তভাবে যাচাই করা যায়। হঠাৎ ওর মনে হলো, সবগুলো বইয়ের ব্যাক কভারে ওর ছোট একটা ছবি আছে। ভদ্রলোক বোধ হয় ব্যাপারটা লক্ষ্য করেননি। আর করলেই বা কী। অনেক সময় হালকাভাবে দেখা ছবির সঙ্গে হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ানো মানুষটার চেহারা মেলানো যায় না। এখন প্রৌঢ় ভদ্রলোক অতি উৎসাহে ওর বই র্যাক থেকে নামিয়ে না আনলেই হয়। আটটার ওপর বাজে। রাস্তায় এখনো তেমনভাবে লোক চলাচল শুরু হয়নি। দোকানে ও ছাড়া আর কোনো খদ্দের নেই। ভদ্রলোক মনে হয় দোকানের মালিক। হয়তো অবসর জীবন কাটাচ্ছেন চাকরিবাকরির পর। নিজের বাড়ির সামনে ছোট একটা দোকান দিয়েছেন। চললে ভালো, না চললে ক্ষতি নেই। সময়টা তো কাটে।
রাঙামাটি বেড়াতে এসেছেন বুঝি? ভদ্রলোক সোজাসুজি তাকালেন মিনহাজের দিকে।
হ্যাঁ, এই আর কি। দু’দিন একটু ঘুরে বেড়াবো।
ফ্যামিলি আনেননি? ভদ্রলোক চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বললেন।
জ্বি না। কথা না বাড়িয়ে মিনহাজ জানতে চাইলো ঢাকার দৈনিকগুলো ক’টা নাগাদ আসবে।
ন’টা-সাড়ে ন’টার দিকে এসে যাবে। চিটাগাং থেকে আসবে তো। প্যাসেঞ্জার বাসে। চাটগাঁয়ের পত্রিকা নিন না। ওগুলো এসে গেছে। ’আজাদী’ আছে, ‘পূর্বকোণ’ আছে। এগুলো ঢাকার পত্রিকার মতোই।
জানি। হাসলো মিনহাজ। দুটো পত্রিকাতেই ওর চট্রগ্রামের বন্ধুরা আছে। ও টুল থেকে একটা ‘পূর্বকোণ’ তুলে নিয়ে মেলে ধরে।
ভাই, আমার কিন্তু অনেক বয়স। দেখে হয়তো মনে হয় না। সিক্সটিএইটে এসএসসি। ভদ্রলোক মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন।
তাই নাকি? ফিগারটা বেশ মজবুত রেখেছেন। দেখে মনে হয় বয়স ফিফটির সামান্য ওপরে-নীচে।
ভদ্রলোক মুখ ছড়িয়ে হাসলেন, ‘আমি সিক্সটিফোর ক্রস করেছি গত মাসে।’
বাহ, আপনি এইটিতেও এরকম থাকবেন। টাইট ফিগার।
দোয়া করবেন।
অবশ্যই। মিনহাজ পত্রিকার ভেতরের পৃষ্ঠাগুলো খুললো না। পত্রিকাটা টুলে রেখে ও মানিব্যাগ বের করলো।
বয়সের কথা কেন তুললাম জানেন? আমি মাসুদ রানা সিরিজের প্রথমদিকের সবগুলো বই পড়েছি। তখন স্কুলে ক্লাস এইট-নাইনে পড়ি। কী সব বই! ‘ধ্বংস পাহাড়’, ‘ভারত নাট্যম’, ‘স্বর্ণমৃগ’, ‘বিস্মরণ’। একটার চেয়ে একটা এক্সাইটিং। আমরা বই ভাগাভাগি করে পড়তাম। এমন কি দু’জন একসঙ্গে বসে এক এক পাতা করেও পড়তাম। এ নিয়ে আবার ঝগড়া। যেমন একজন খুব দ্রুত পড়ে, অন্যজন স্লো। এতে অন্য ধরনের মজা ছিলো। আপনি বুঝবেন না। ভদ্রলোক আনমনা হয়ে গেলেন। হয়তো বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে।
মিনহাজ চুপ করে রইলো। ও নিজেও প্রচুর বই পড়ে। মাসুদ রানা পড়ে নিয়মিত। কিন্তু ও সিরিজটা ধরেছে অনেক পরে। কাজী আনোয়ার হোসেনের প্রথম দিকের এ বই ক’টার নাম ও শুনেছে। পড়েনি। পকেটের মোবাইল বেজে উঠলো। একটা অচেনা নম্বর। ও ধরলো না। কয়েকবার রিং হয়ে থেমে গেলো। পত্রিকার দাম দিয়ে মিনহাজ হাত তুলে বললো, ‘চলি ভাই, আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগলো।’ ও ফেরার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এমন সময় ভদ্রলোক বলে উঠলেন, ’ভাই সাহেবের পরিচয়টা জানা হলো না।’
আমি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ঢাকায় থাকি। নাম মিনহাজ মুস্তাফি। ওর নামটা শোনার পর ভদ্রলোকের মুখে কোনো ভাবান্তর হওয়ার আগেই মিনহাজ জোরে হাঁটা শুরু করলো। ফোন আবার বাজলো। বাজতে থাকুক। রুমে গিয়ে ধরবে।
‘দৈনিক পূর্বকোণ’-এর সবগুলো পাতায় চোখ বুলিয়ে সামনের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে মিনহাজ, এমন সময় মোবাইল বাজলো।
সেই নম্বরটা, যেটা আগে দু’বার বেজেছে।
হ্যালো।
ভাইয়া, আমি সুমি।
হ্যাঁ সুমি, কী খবর? মিনহাজ একটু অবাক হলো। সুমি বন্ধু কমলের ছোটবোন। এদের চট্রগ্রামের বাসায়ই মিনহাজ উঠেছিলো রাঙামাটি আসার আগে।
ভাইয়া, আমি আপনার লেখার খুব ভক্ত।
জানি তো। মিনহাজ শব্দ করে হাসলো।
আপনি যখন আমাদের বাসায়, আমি তখন আপনার ‘ছোবল’ পড়ছিলাম। কাল রাতে শেষ করলাম। উফ, কী যে বলবো। এত ভালো লেগেছে যে, ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।
থ্যাংক ইউ, সুমি।
আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আপনার অটোগ্রাফটা পর্যন্ত নিতে ভুলে গেছি। আপনার পরের বইটা কবে আসবে ভাইয়া?
আসছে, তবে একটু সময় লাগবে। এবারের গল্পটা অন্য ধরনের হবে। তাই কিছু চিন্তাভাবনা করতে হচ্ছে। মিনহাজ দূরে খোলা মাঠটার দিকে তাকিয়ে বললো। মাঠের এক পাশে স্কুল ইউনিফরম পরা ছোট সোনামণিদের এসেম্বলি হচ্ছে। ‘আমার সোনার বাংলা...’ গাইছে ওরা। সামনে একটা বাঁশের মাথায় বাংলাদেশের পতাকা। পাশে দাঁড়ানো কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ। খুব সম্ভব টিচার।
ভাইয়া, জুলি শামসির ফাইটিং স্পিরিটটা কিন্তু রাখবেন। দারুণ। বড় বড় মিশনে যায়, পুরুষ স্পাইদের সঙ্গে এনিমি পজিশন অ্যাটাক করে --- আবার দেশের নারীদের নিয়ে চিন্তাও করে। আমি গে এরকম শুনিনি।
ওর কিন্তু ছোট মেয়েদের একটা গানের স্কুল আছে। ঢাকার মগবাজারে। মিনহাজ বললো।
হ্যাঁ ভাইয়া, জানি। মাস্তানরা স্কুল উঠিয়ে দিয়ে বাসাটা দখল করতে চেয়েছিলো। কী সাহসের সঙ্গেই না জুলি ওদের ঠেকালো। সেই সঙ্গে বুদ্ধির প্যাঁচ। ও কারাতে-কুংফুর নমুনা দেখাতে পারতো ওদের। সেটার দরকার হয়নি অবশ্য। কোন বইয়ে যেন এটা পড়লাম? নামটা মনে আসছে, ঠোঁটে আসছে না।
‘মৃত্যুকূপ’। জুলির দ্বিতীয় মিশন। সেবার ও টেকনাফ দিয়ে বার্মায় ঢুকেছিলো। গানের স্কুলের ঘটনাটা হয় মিশনে যাওয়ার আগে। মিনহাজ কথা শেষ করতে পারে না, সুমি কলকল করে বলে ওঠে, ইয়েস, ‘মৃত্যুকূপ’। এ বইটা আমার কালেকশানে নেই। এক ফ্রেন্ড পড়তে নিয়ে গিয়ে ফেরত দেয়নি। পরে মার্কেটেও পাইনি।
ঠিক আছে, তোমাকে ঢাকা থেকে এক কপি পাঠিয়ে দেবো।
কমলের এই বোনটি চট্রগ্রাম বিশ্বদ্যিালয়ে বাংলা অনার্সের ছাত্রী। প্রচুর বই পড়ে, আর ইউটিউবে সিনেমা দেখে। অধিকাংশ ভারতীয় ছবি। থ্রিলায় ওর প্রিয় বিষয়। ইদানীং কলকাতায় গোয়েন্দা গল্প নিয়ে খুব ছবি হচ্ছে। মিনহাজ নিজেও দেখে। কিন্তু সময় করে উঠতে পারে না। ঢাকার ফিল্মমেকাররা কেন থ্রিলার বনাতে শুরু করছে না, বুঝতে পারে না মিনহাজ। অথচ এসব গল্পের প্রচুর ভক্ত বাংলাদেশে।
ভাইয়া, আমার একটা রিকোয়েস্ট রাখবেন? আবদারের সুরে বললো সুমি।
রাখার মতো হলে অবশ্যই রাখবো। বলো কী রিকোয়েস্ট।
ফেসবুকে আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে আমাকে অ্যাড করে নিন না। আমি কিন্তু আপনাকে অনেক আগে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি।
ওহ্হো, সরি। এখনই ল্যাপটপ খুলে ট্যাগ করে নেবো। আসলে কী জানো, আমি খুব ফেসবুক বা কম্পিউটার-ফ্রেন্ডলি না। বিনা প্রয়োজনে বসি না। মাসে বড়জোর দু’তিনবার। তবে লেখার জন্য বা গুগলে সার্চ দেয়ার জন্য বসতে হয়। ফেসবুকে খুব সময় নষ্ট হয়। তাই বসি না।
ভাইয়া, আপনার ফ্রেন্ডলিস্ট কী বিশাল! জুলি শামসিকে নিয়ে সবার কত কৌতূহল। আমার নিজেরও।
আচমকা মিনহাজের মনে হলো বান্দরবান, খাগড়াছড়ি যাওয়ার জন্য সময়টা উপযোগী কিনা এটা কমলের কাছে জেনে নিতে হবে।
আচ্ছা সুমি, তুমি কি জানো এখন কমল কোথায়? মিনহাজ জানতে চাইলো।
ভাইয়া, ও তো বাসায়। অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। ডাকবো?
থাক। আমিই ফোন করছি।
ভাইয়া, আমাকে কিন্তু আজকেই ট্যাগ করবেন।
শিওর।
মিনহাজ মোবাইলে কমলের নাম বের করে কল দেয়।
।। তিন।।
খাগড়াছড়িতে কী একটা হাঙামা হচ্ছে। কমল ওদিকে যেতে মানা করলো। অগত্যা মিনহাজ দক্ষিণে বান্দরবানেই রওনা হলো। চট্রগ্রামে ফেরার পথে সময় একটু বেশি লেগে যাবে।। তবু সুযোগটা ও নষ্ট করতে চাইলো না। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে বান্দরবানকেই সবার ওপরে ধরা হয়। সবুজ ঘন অরণ্যে ছাওয়া গিরিশ্রেণী ঢেউয়ের মতো জেগে আছে প্রায় পুরো জেলায়। ছোট শহরটিও রাঙামাটি, খাগড়াছড়ির চেয়ে আলাদা চরিত্রের। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি নদী শঙ্খ। রাঙামাটি থেকে জিপে কিছুদূর না যেতেই ঝুম বৃষ্টি। পাহাড়ের বৃষ্টি বুনো, খুব তোড়ে নামে। ভালো লাগে মিনহাজের। বৃষ্টির জন্য গাড়ির গতি কমাতে হয়েছে। বান্দরবান পৌঁছাবার পর ভোজবাজির মতো বৃষ্টি থেমে গেলো। দেখতে দেখতে আকাশে রৌদ্র-মেঘের খেলা। পড়ন্ত বিকেলের স্নিগ্ধ গোলাপিতে জেলা শহরটিকে মায়াবি মনে হয়।
শহরে মিনহাজের কয়েকজন বন্ধু আছে। এদের দু’জন আদিবাসী, ঢাকায় ওর সঙ্গে কলেজে পড়তো। অনেকদিন দেখা হয় না। এদের বাড়ি গ্রামের দিকে। খোঁজ নিয়ে জানলো দু’জনের একজনও এখন বান্দরবানে থাকে না। একজন থাকে কক্সবাজার, একজন ঢাকায়। শফিককে পাওয়া গেলো অবশ্য। বন্ধুটি শহর থেকে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা বের করে। বনরূপা। মাঝে মাঝে ও মিনহাজের ঢাকার ঠিকানায় কুরিয়ারে পাঠায় পত্রিকাটা।
শফিকের সঙ্গে কিছুক্ষণ ওর অফিসে আড্ডা দিয়ে, কিছুক্ষণ শহরে ঘোরাঘুরি করে হোটেলে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেলো। খেতে হয়েছে শফিকের বাসায়। ওর স্ত্রী মানসী কিছুতে না খাইয়ে ছাড়বে না। বেশ মজা করে আদিবাসি রান্না খাওয়া হলো। শফিকের কিছু প্রিয় পদ রেঁধেছে মানসী। ওগুলোর মধ্যে ওর প্রিয় বৈসাবি নিরামিষ এবং শুঁটকিও ছিলো।
বাইরে চারদিক ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টিধোয়া নির্মল চাঁদের আলোয়। হোটেলটা নদীর পাড়ে। রুম থেকে নদী দেখা যায়। ব্যালকনি থেকে মিনহাজ দেখলো পাহাড়ের গাছগাছালির ওপর চাঁদ। ফিনফিনে মেঘ ছুটে এসে ঢেকে দিচ্ছে মাঝে মাঝে। তখন আলো কমে আসে, আবার পরক্ষণেই চারদিক ফকফকে। চাঁদের আলোয় নদীর পানি চিকচিক করছে। কোনো দেশি নৌকা বা বোট চোখে পড়ছে না। হোটেলের ম্যানেজার জানিয়েছে, নদীর উজানে দু’দিন থেকে প্রচণ্ড স্রোত। স্রোতের জন্যই মিনহাজকে থানচি যাওয়া বাদ দিতে হয়েছে। শফিক বলছিলো, এসময় বার্মার আরাকান পাহাড় থেকে বৃষ্টির কারণে পানির ঢল নামে। সেজন্য নদীতে স্রোতের তোড় বেড়ে যায়। থানচি এবং দূরদূরান্তে যাওয়া-আসা কঠিন হয়ে পড়ে। এ নদীতে লঞ্চ চলে না। কোনো কোনো জায়গায় পানি হাঁটু সমান। তার ওপর নদীর মাঝখানে পড়ে থাকে বিশাল বিশাল পাথর।
পরশু খুব সকালে ওকে চট্টগ্রাম রওনা হতে হবে। কমল প্লেনে ঢাকা যাওয়ার টিকিট কেটে রেখেছে। বিকেলে ফ্লাইট। কালকের দিনটা খুব ব্যস্ততায় কাটবে। শফিককে সঙ্গে নিয়ে ও যাবে বগা লেকে। জায়গাটা দুর্গম এলাকা। সামনের কোনো বইয়ে ও জুলি শামসিকে একটা মিশনে এই অঞ্চলে আনতে চায়। ফোনে মেসেজ আসার শব্দ হলো। প্রায়ই শব্দটা শুনতে পায় না মিনহাজ। এখন শুনলো। স্ক্রিনে জুলির নাম। সঙ্গে সঙ্গে মেসেজটা খুললো ও। লেখা ভাসছে, ‘স্যার, আমি খুব বিপদে। কী করবো বুঝতে পারছি না। হেল্প মি।’ মিনহাজ তৎক্ষণাৎ উত্তর লিখলো, ’কী ধরনের বিপদ? কোথায় তুমি?’ জুলি লিখলো, ‘স্যার, আমি একটা বাসে। লোকাল বাস। আমি ছাড়া আর কোনো প্যাসেঞ্জার নেই।’ মাথাটা চক্কর দিলো মিনহাজের। এবার মেসেজ না লিখে ও জুলির নম্বরে ফোনে করলো। একবার রিং হতেই ফোন ধরলো জুলি। ফিসফিস করে কথা বলছে ও।
হ্যালো, স্যার।
কী হচ্ছে এসব? তুমি বাসে, তা-ও এত রাতে। ঘটনা কী? কোথায় যাচ্ছো? উৎকণ্ঠায় মিনহাজের গলা শুকিয়ে আসছে।
স্যার, আমি মানিকগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি। আমার দাদু মৃত্যুশয্যায়। বাবা-মা খুন হওয়ার পর উনিই আমাকে বড় করেছেন। আপনি তো সব জানেন।
কিন্তু এই গভীর রাতে কেন যাচ্ছো? তার ওপর তুমি একা।
খবরটা পেলাম সন্ধ্যার পর। আমার মাথা ঠিক ছিলো না স্যার। টার্মিনালে যে বাসটা সামনে পেয়েছি, সেটাতেই উঠেই পড়েছি।
তারপর?
আমি জানতাম না এটা লোকাল বাস। কয়েকটা স্টপেজ পার হতেই দেখি বাস খালি। বাসে আমি একা। আর আছে কন্ডাক্টর, হেল্পার আর ড্রাইভার।
এখন প্রব্লেম কী? বাসের কোন দিকে তোমার সিট?
পেছনের দিকে। স্যার, বাসের লোকগুলো ...
সবাই তো খারাপ লোক না। তুমি এর চেয়ে ভয়ংকর সিচুয়েশন ফেস করেছো। ইউ আর এ সিক্রেট এজেন্ট।
কিন্তু স্যার, এধরনের সিচুয়েশনে কখনো পড়িনি।
কেন তুমি অফিসের গাড়ি নিলে না আমি বুঝতে পারছি না। সঙ্গে আর্মস আছে তো?
জ্বি স্যার, রিভলভার আছে। হ্যান্ডব্যাগে।
কী ড্রেস পরে আছো এখন?
সালোয়ার-কামিজ। গ্রামে যাচ্ছি। প্যান্ট-শার্ট কিভাবে পরি।
ঠিক আছে, একদম ঘাবড়াবে না। লোকগুলো হয়তো খারাপ নয়। তুমি অযথা সন্দেহ করছো। আর খারাপ হলেও তুমি ঠিক ফেস করতে পারবে।
কিছু বুঝতে পারছি না, স্যার। দুর্বল আর অসহায় শোনায় জুলিকে।
শোনো, বাসটা এখন কোন রোড দিয়ে যাচ্ছে?
এতক্ষণ তো আরিচা রোড দিয়ে যাচ্ছিলো। এখন এটা কোন রাস্তা বুঝতে পারছি না। দু’পাশে জঙ্গল মনে হচ্ছে।
মিনহাজকে দুশ্চিন্তা পেয়ে বসলো। মানিকগঞ্জ যাওয়ার পথে কোথায় জঙ্গল, ও মনে করতে পারলো না। সাভারের দিকে জঙ্গল আছে কি? নাকি গাড়ি কোনো অচেনা রাস্তা ধরে যাচ্ছে।
স্যার, ওরা বাসের জানালা বন্ধ করে দিচ্ছে। ভয়-খাওয়া গলায় জুলি বললো। কন্ডাক্টরটা আমার দিকে আসছে।
বোধ হয় বৃষ্টি। তোমার দিকের জানালা বন্ধ করতে চায়। ঝড় আসছে নাকি? রিভলভারটা হাতে ধরে রাখো, তবে ওরা যেন বুঝতে না পারে।
জুলি কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কথা বোঝা যায় না। ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে। লাইন কেটে গেলো। নেটওয়ার্ক নেই বোধ হয়।
কিছুক্ষণ আগেও ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছিলো। এখন মিনহাজের গরম লাগছে। ওর শরীর ঘেমে গেছে।
নারীকণ্ঠে উচ্ছল হাসির শব্দ ভেসে এলো নদীর দিক থেকে। একটা দেশি নৌকা ভাসছে। চাঁদের আলোয় দেখা যায়, দু’জন নারী নৌকার দু’পাশে বসে একে অপরের দিকে পানি ছিটাচ্ছে। পেছনের দিকে বৈঠা হাতে এক পুরুষ।
নদীতে আর কোনো নৌকা নেই। চারদিক সুনসান।
মিনহাজ মুস্তাফির মনে হলো ও কোনো আ্যবসার্ড নাটকের দৃশ্য দেখছে।
###