খোকা
আবদুল মতিন প্রতিদিন তার নাতি সিয়ামকে স্কুল থেকে ছুটির পর আনতে যান। আজও যাচ্ছেন। সিয়াম এবার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে। ছেলেটা অনেক দুষ্ট। কথা শুনে না। বাবা-মা সারাদিন চাকরিতে থাকে। মতিন সাহেবও অসুস্থ মানুষ নাতিকে বেশি সময় দিতে পারেন না। একা একা নাতিটা বেড়ে উঠছে। সারাদিন মোবাইল আর গেইমস। এই নিয়ে মতিন সাহেবের চিন্তার শেষ নেই। গেটে দাঁড়াতেই ব্যাগ কাঁধে ছুটে এলো সিয়াম। মতিন সাহেব নাতির বামহাতটা নিজের হাতে নিলেন। দুজনে বাড়ি পথে রওনা দিলো।
‘স্কুল কেমন কাটলো দাদুভাই?’
‘ভালো।’
‘কি খাবে দাদুভাই?’
‘চিপস আর চকলেট।’
মতিন সাহেব স্বযত্নে নাতিকে খাবার কিনে দিলেন। সিয়াম নিজের মতো চকলেট খাচ্ছে। টুকটাক দাদার সাথে কথা বলার সময় সিয়ামের বয়সী একটা ছেলে এগিয়ে এলো সিয়ামের দিকে। টুকাই বোধহয়। পরনে ছেঁড়া শার্ট। সিয়ামের উদ্দেশ্যে বললো,
‘ভাইজান? চকলেট একটু দিবেন। দুইদিন ধইরা খাই না ভাইজান।’
কি যে আকুতি ছেলেটার কন্ঠে! সিয়াম কপাল কুঁচকে তাকালো। সুর উচ্চ করে বললো,
‘ছিঃ, তুমি তো নোংরা। যাও। দূর হও।’
ছেলেটা কষ্ট পেলো। ছলছল চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে চলে গেলো। মতিন সাহেব সব দেখলেন নিরবে। মনে মনে আফসোস করলেন। তবে মুখে কিছুই বললেন না। প্রতি বিকালে সিয়াম মতিন সাহেবের কাছে গল্প শুনতে আসে। আজোও এসেছে। দাদু তাকে ভূতের গল্প শোনায়, দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প শোনায়।
‘দাদু আজ কিসের গল্প শোনাবে?’
‘আজ তোকে খোকার গল্প শোনাবো, দাদুভাই।’
‘খোকার গল্প?’
‘হুম।’
চায়ের কাপটা নামিয়ে টেবিলে রেখে মতিন সাহেব শুরু করলেন।
‘১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করে একটি ছেলে শিশু। খোকা তার ডাকনাম। ছোট থেকেই দূরন্ত খোকা। মধুমতির ঘোলাজলে গ্রামের ছেলেদের সাথে সাঁতার কাটা, দল বেঁধে হা-ডু-ডু, ফুটবল, ভলিবল খেলায় সে ছিলো দস্যি বালকদের নেতা। গ্রামের ছোট ছোট ছেলের সঙ্গে করে মাঠে-ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সাথে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালো লাগত। বানর ও কুকুর পুষতো, তারা তাঁর কথামতো যা বলতো তাই করত।’
‘যা বলতো তাই!’
অবাক হলো সিয়াম। মতিন সাহেব হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন।
‘হ্যাঁ রে। খোকা ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত হৃদয়বান। তখনকার দিনে ছেলেদের পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করত। চার-পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতে হতো। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসত। আর সারাদিন অভুক্ত অবস্থায় অনেক দূরে হেঁটে তাদের ফিরতে হতো। খোকা তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসতো। স্কুল থেকে ফিরে দুধ-ভাত খাবার অভ্যাস ছিল এবং সকলকে নিয়েই সে খাবার খেতো। জানিস খোকার জন্য মাসে কয়েকটি ছাতা কিনতে হতো। কারণ সে অসহায়দের ছাতা দিয়ে দিতো। যেন তাদের কষ্ট না হয়। এমনকি পড়ার বইও মাঝেমাঝে দিয়ে আসতো। খোকা একবার কি করেছে জানিস?’
‘কি?’
‘যখন ছুটির সময় হতো তখন খোকার মা আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খোকা আসবে দূর থেকে রাস্তার ওপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তাঁর খোকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কী ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড়ে দেখে সব দিয়ে এসেছে খোকা।’
‘খোকা কে দাদু? সে খুব ভালো।’
‘আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’
ঘটনাগুলো শোনার পর থেকে অদ্ভুত পরিবর্তন আসলো সিয়ামের মাঝে। সেইদিনের টুকাই ছেলেটাকে নিজের হাতে চকলেট দিয়েছে সে। মতিন সাহেব নাতির পরিবর্তনে বেশ খুশি।
আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের অনুপ্রেরণা। তাঁর জীবনী, কর্মজীবন, ছেলেবেলা আমাদের অসংখ্য শিক্ষা দেয়। আজকের শিশুদের মহান এই নায়কের জীবনী সম্পর্কে ধারণা দেওয়া অত্যাবশ্যক।
ঠিকানা -৫২/বানিয়াছল,খালপাড়, নরসিংদী