গল্প: শেষ পর্ব
মুজিবের হলদে পাখি
আমি ফিরে আসি নিজের ঘরে। শুনতে পাই কাকদের ডাকাডাকি। নতুন বাসা বানিয়েছে দুটি কাক। দাঁড়িয়ে থেকে দেখি। লোহার তার দিয়ে খুব সুন্দরভাবে গাছের সঙ্গে পেঁচিয়ে ওরা বাসা বানায়। আমার মনে হয় ওরা এক একজন দক্ষ কারিগর। বাসা বানানোর জন্য এইসব উপকরণ কাকরা কোথায় খুঁজে পায় তা ভেবে আমি বিস্মিত হই। পাঁচটা আম গাছ থেকে কাদের মিয়াকে দিয়ে পাঁচ-সাত বার বাসা ভেঙে ফেলেছি। ওরা আবার তৈরি করে। ওদের সঙ্গে আমি সন্ধি করি। ওদের ধৈর্য আর অধ্যাবসায় আমার কাছে উদাহরণ হয়ে থাকে। সেজন্য তিনটা আমগাছ ওদের বাসা করার জন্য ছেড়ে দেই। কাকেরা বাসা বানাল। নানা উপকরণ জোগাড় করে বাসা বানায়। তিনটি গাছ ছেড়ে দিয়েছিলাম। ওরা আর একটি দখল করে ফেলল।
কাদের মিয়া এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, স্যার কি করব? আবার ভাঙব বাসাগুলো?
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করি। দেখতে পাই ওর চেহারায় আশঙ্কার ছাপ। আমি কাদেরকে বলি, না বাসা আর ভাঙতে হবেনা। বাসা করতে দাও। এখন ওদের ডিম পাড়ার সময়। ওরা যাবে কোথায়?
-স্যার, আপনি ওদেরকে অনেক মায়া করছেন।
-মায়াতো করব রে। ওদেরওতো ভালো থাকার অধিকার আছে।
-অধিকার কি স্যার? ওরাতো মানুষ না।
-তুই কি বলিস? ওদেরকে রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। আমি কি কাজটি ভুল করছি ওদের বেঁচে থাকার কথা বলে?
-না, না স্যার আপনি ভুল করবেন কেন? আমি ভুল বলছি। মাফ করবেন স্যার। আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি স্যার। আপনি আমাদের মাথার উপরের মানুষ। আমাদের ভালোর জন্য আপনি রাজনীতি করেন।
-হয়েছে, হয়েছে থাম।
-থামব কেন স্যার? আমিতো মিথ্যা কথা বলছিনা। আপনাকে জেলে পেয়ে আমি খুশি। নইলেতো আপনাকে আমি কাছ থেকে দেখতে পেতাম না। আপনার যতœ করতে পারতাম না স্যার। আপনার সঙ্গে থাকতে পেরে জেলখানার চাকরি করার জীবন ধন্য।
-বাব্বা, তুইতো দেখছি অনেক বাহাদুর ছেলে রে।
কথা শেষ করে কাদের মিয়া আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। আমি ওর মাথায় হাত রেখে বলি, তোর ভালোবাসা পেয়ে আমিও ধন্যরে কাদের মিয়া। যা, তুই অন্য কাজে চলে যা।
-আপনার কিছু লাগবে?
-না, আমার কিছু দরকার নাই। জেলখানার পাখিগুলো আমাকে মাতিয়ে রাখে। হলদে পাখিদুটো আমাকে সঙ্গ দেয়।
-যাই স্যার।
কাদের হাসতে হাসতে চলে যায়।
আমি ঘরে ঢুকি। বিছানায় পা গুটিয়ে বসে খবরের কাগজ পড়ি। কিন্তু কাগজের পাতায় মন বসে না। কেবলই দরজার দিকে তাকাই। কেউ যদি এসে বলে, স্যার আপনার ‘দেখা’ এসেছে। আমি বুঝে যাই ছেলেমেয়েদের নিয়ে রেণু এসেছে।
জেলখানায় এরা ‘দেখা’ শব্দ চালু করেছে। সবাই ব্যবহার করে। ‘দেখা’ শব্দ বললেই বুঝে যাই যে কেউ এসেছে দেখা করতে। জেল গেটের কাছের ঘরে অপেক্ষা করছে। কাগজ ভাঁজ করে বিছানায় রেখে দিয়ে ভাবি আজ যদি রেণু আসত! সময়টা আমার আনন্দে কাটত। ছোট্ট রাসেলকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতাম, সোনারে। গত দিন যখন কোলে নিয়েছি তখন আব্বা, আব্বা করে কয়েকবার ডেকে মায়ের কোলে গিয়ে তাকেও আব্বা, আব্বা বলে ডাকতে শুরু করল।
আমি রেণুকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপার কি?
রেণু বলল, বাড়িতে আব্বা আব্বা করে কাঁদে। তাই ওকে বলেছি, আমাকে আব্বা বলে ডাক। সেদিন ও আব্বা আব্বা করে পরে যখন ডাকতে শুরু করল যেই আমি জবাব দেই ও সঙ্গে সঙ্গে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, তুমি আমার আব্বা। আমি বুঝতে পারি আমার উপর ওর অভিমান হয়েছে। আগে রেণুর সঙ্গে জেলখানায় এলে আমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইত। বলত, আব্বা বালি চল। এখন আর চলে যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যেতে চায়না।
ওর আভিমানে আমি কষ্ট পাই। মাথা কাত করে বালিশে শুয়ে পড়লে আমার বুক ভেঙে যায়। দুহাতে চোখের পানি মুছি। ছোট্ট শিশুটির অভিমানী চেহারা দুচোখ বুঁজে থাকলে আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। আমি শুয়েই থাকি। ঘন্টাখানেক পরে দরজায় কড়া নাড়ে কেউ। উঠে দরজা খুলি।
-আপনার ‘দেখা’ এসেছে স্যার।
-ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।
জেলগেটে এসে দাঁড়ালেই ছুটে আসে হাসিনা আর রেহানা। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আব্বা আব্বা আপনি কেমন আছেন?
-শরীর ভালোই আছে।
দুজনে আমার দুহাত ধরে রাখে। আমি সাক্ষাৎপ্রার্থীর রুমে ঢুকি। রাসেল রেণুর গলা জড়িয়ে ধরে আছে। আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে হাসে। মুখে কিছু বলেনা।
হাসিনা রাসেলকে টেনে ধরে বলে, চল আমরা একটু বাইরে যাই।
-না, আমি যাব না।
-আমরা তোর সঙ্গে খেলব। আয়।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ খেলব। চল, চল।
তিনজনে বেরিয়ে যায়।
আমি রেণুর দিকে তাকিয়ে বলি, কেমন আছ হলদে পাখি?
-তোমার হলদে পাখি আজ আমগাছে এসেছিল?
-হ্যাঁ, এসেছিল।
-তাহলেইতো তোমার মন রসে টইটুম্বুর হয়ে আছে।
-থাকবেইতো। তিন বছর বয়সে তুমি আমার হলদে পাখি হয়ে টুকটুক শিস বাজিয়েছ।
-ভালোই বলেছ। এখন তোমার কাকদের কথা বল। ওগুলো কি তোমাকে বিরক্ত করে?
-হ্যাঁ, তা করে। মাঝে মাঝে সহ্য করে থাকি। তবে ওদের একটি ঘটনার কথা আজ তোমাকে বলব। হলদে পাখি আমার ভালোবাসার পাখি। কাকেরা আমার রাজনীতির পাখি।
-ওহ তাই! রেণু উচ্ছ¡সিত হয়ে ওঠে।
-কাকেরা বাসা ভেঙে দেয়ার সময় ভয় পেয়ে একটু দূরে চলে যেত। সেখানে বসে সঙ্গীসাথী জোগাড় করে চিৎকার করত। আমি বুঝতাম এটা ওদের প্রতিবাদ। ওরা যে এক হয়ে প্রতিবাদ করত এটা আমি খুব প্রশংসা করতাম। অধিকার রক্ষার জন্য পাখিদেরও প্রতিবাদ আছে। আম বড় করে নিঃশ^াস টানতাম। আমার ভাবনা এলোমেলো হতো না। মনে করতাম বাঙালিদের চেয়েও ওদের একতা বেশি। বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে যদি কাকদের মতো শোষকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত তবে তারাও জয়লাভ করত। তাই কাকের অধ্যাবসায়ের কাছে আমি পরাজিত হয়েছি। কিছুদিন ধরে কাকরা আমাকে দেখলেই চিৎকার করত। প্রতিবাদের ভাষায় পাখা ঝাপটাত। এখন আর আমাকে দেখলে চিৎকার করে প্রতিবাদ করে না। আর নিন্দা প্রস্তাবও পাশ করে না।
-ভালোই বলেছ, নিন্দা প্রস্তাব পাশ করেনা। রেণু দুরন্ত হাসিতে মেতে ওঠে।
-এটাই আমার রাজনীতি রেণু।
রেণু হাসতে হাসতে বলে, বুঝেছি বুঝেছি। পাখিদের নিয়ে ভালোই আসর জমিয়েছ। তোমার আর একা থাকার খারাপ লাগা থাকবেনা।
-থাকবে গো থাকবে। তুমিতো আমার কাছে নেই।
-কেন? আমিতো তোমার হলদে পাখি।
আমি মৃদু হেসে চুপ করে থাকি। ছেলেমেয়েরা ঘরে আসে ওদের সঙ্গে কথা বলি। একসময় চলে যায় ওরা।
রাত্রে পাগলের চিৎকারে ঠিকমতো ঘুমুতে পারিনা। ভোরে নাস্তা খেয়ে চেয়ার নিয়ে আমগাছের নিচে বসি। হাতে থাকে রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ বই। অল্পক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাই, হলদে পাখি দুটো এসে আমার দুই ঘাড়ে বসে। আমি নড়াচড়া না করে চুপচাপ বসে থাকি। আমি বলি, আয় কাছে আয় ভালোবাসার বন্ধুরা। মুহূর্ত সময় মাত্র উড়ে যায় ওরা। হয়তো ভয় পেয়েছে, আমি যদি ধরে ফেলি। মনে মনে ভাবি ওরা যেন আবার আসে। ভালোবেসে একবার কাছে এসেছে, আবার উড়ে গেছে। বুঝতে পারি এটা ওদের একরকম খেলা। আমারও আনন্দ। বুকের ভেতর খুশির আমেজ নিয়ে বসে থাকা।
একটুপরে দেখি কুড়ি-পঁচিশটা কাক আমার ফুল বাগানে এসে নামে। জড়ো হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রতিটি কাকের দৃষ্টি একই দিকে। আমিও তাকিয়ে থাকি। একসময় ওরা উড়ে চলে যায়। আমি দুহাত নেড়ে বলি, আবার আসিস একতার বন্ধুরা। তোদেরকে আমার পাশে চাই। তোরা একসঙ্গে ডেকে আমার মন ভরিয়ে দিবি।
ওরা চলে গেলে বাগানে আসে হলদে পাখি দুটো। এখন ওরা ফুলের সঙ্গে মিশে থাকে। রঙবেরঙের ফুলের মাঝে ওদেরকে অপূর্ব দেখাচ্ছে। নিঃসঙ্গতার মুহূর্ত আমার সামনে থেকে মুছে যায়। আমি ডেকে বলি, আয় কাছে আয় আমার ভালোবাসা। পাখি দুটো ডানা মেলে দিয়ে ফুল গাছের মাঝে ঘুরে বেড়ায়। একসময় বাগান ছেড়ে আমার কাছাকাছি এসে উড়তে শুরু করে। বাগানের চারদিকে ওড়ে। দূরে চলে যায় না। আমার বুকের ভেতর শব্দ হয় রেণু, রেণু! তুমি আমার হলদে পাখি।