ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৩
স্নানের শব্দ
‘তোমার প্রতিপক্ষ যদি প্রবল ও শক্তিশালী হয়, তাহলে তুমি শক্তি প্রয়োগে প্ররোচিত হয়ো না। তোমাকে কৌশলী হয়ে তোমার লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। কথাটা কে বলেছিলেন? আব্বা? আব্বা বিভিন্ন সময় এরকম ছোট ছোট অনেক উপদেশ দিতেন। তিনি নিজে চাকরি জীবনে চরম ব্যর্থ একজন মানুষ। সরকারি অফিসে বছরের পর বছর একই পদে স্বল্প বেতনে মুখ গুঁজে নীরবে চাকরি করে গেছেন। শবনমের স্কুল শিক্ষিকা মা দুজনের উপার্জন এক করে দৃঢ় হাতে সংসারের চাকা চলমান রেখেছেন। শবনমের মাঝে মাঝে মনে হয়, আব্বা যেসব কথা বলতেন, তা হয়তো তিনি আসলে নিজেকে শোনাবার জন্যই বলতেন। অনেকটা আত্মসান্ত্বনার মতো। আব্বার কিছু কিছু কথা তো শবনমের মনেও গেঁথে আছে। যেমন, ‘অন্যের স্বীকৃতি দিয়ে সাফল্য বিচার করো না, মা, নিজের সাফল্য নির্ধারণ করতে হয় নিজেকেই।’ কথাটা যে কতটা সত্য তা এখন উপলব্ধি করতে পারে শবনম। বাবা আরও বলতেন, ‘শোনো মা, কখনো হাল ছাড়বা না। যে হাল ছাড়ে সে পরাজিত হয়, আর যে প্রত্যাশা না করে কর্ম করে যায় দিন শেষে সেই বিজয়ী হয়।’
আব্বার এইসব বাণীধর্মী কথাবার্তায় মা খুব বিরক্ত হতেন। রেগে গিয়ে মুখ ঝামটা দিতেন। ‘পারো তো কেবল বড় বড় ফাঁকা বুলি আউড়াতে, কাজের কাজ তো কিছুই দেখি না। বড়কর্তাদের একটু ধরাধরি করো, কতদিন আর কেরানি হয়ে কলম পিষবে?’
আব্বা এসব ঝাঁজালো সংলাপের কোনো জবাব দিতেন না। পত্রিকা বা কোনো বইয়ের পাতায় মুখ ডুবিয়ে নিঃশব্দে নিজের পছন্দের অন্য কোনো জগতে চলে যেতেন। সংসারের এইসব সামান্য লাভ ক্ষতিতে নিজেকে জড়াতে চাইতেন না।
অফিসে নিজের টেবিলে একা বসে হঠাৎ আব্বার কথা খুব মনে পড়ল শবনমের। বৈষয়িকভাবে হয়তো আব্বা অসফল ছিলেন, কিন্তু তার মানবিক গুণ, সততা আর নিষ্ঠা ছিল অসাধারণ। এইসব দিকে তারেকের সঙ্গে আব্বার চরিত্রের কিছু মিল খুঁজে পায় শবনম। মেয়েরা কি স্বামীর মধ্যে বাবার ছায়া খোঁজে? কি জানি, সচেতনভাবে হয়তো নয় কিন্তু অবচেতনে তার জীবনে আসা পুরুষদের সঙ্গে বাপের মিল অমিল যে খানিকটা হলেও খুঁজে বেড়ায়নি, তা কি সে একেবারে অস্বীকার করতে পারবে? মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আরেক মন গোপনে গোপনে কত কিছু করে! কখনো তার হদিস পাওয়া যায় কখনো যায় না।
অফিসের হালচাল বুঝতে শবনম এবার এডমিন হেড শওকত সাহেবের রুমে উঁকি দেয়। শওকত সাহেব এমনিতে ভালো মানুষ কিন্তু সবসময়ই নিজস্ব বিশ্বাসে বন্দী থাকা টাইপের লোক, তার ধারণা তিনি যা জানেন সেটাই সঠিক, বাকি সব ভুল।
‘আসেন ম্যাডাম, আসেন ...’ শওকত বিনীত ভঙ্গীত নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দুয়েকটা কেজো কথা হয়। নতুন সিইও নিয়োগের কিছু হলো কি না, জানতে চায় শবনম। শওকতের ধারণা এবারও বাইরে থেকেই নতুন কাউকে এনে সিইওর দায়িত্ব দেবে ম্যানেজমেন্ট। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘বুঝলেন ম্যাডাম, নির্ঝর চৌধুরীর উপরে আসলে মানুষের অভিশাপ লাগছে।’
আপনার মনে আছে নিশ্চয়ই, নতুন জয়েন করেই ম্যানেজমেন্টকে খুশি করতে উনি লোক ছাটাইয়ের প্যাকেজ তৈরি করছিলেন।’
হ্যাঁ, শবনমের মনে আছে বৈকি, যারা অনেক দিন ধরে এই কোম্পানিতে চাকরি করছে, যাদের চাকরি শেষের প্রাপ্য বেনিফিট জমে গেছে অনেক বেশি, তাদেরকে বলা হয়েছিল, হয় ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত এলাকায় কাজ করতে যেতে হবে, নয়তো গোল্ডেন হ্যান্ডশেক। সেই সময় চাকরি হারাতে চায়নি অনেকে, কিন্তু তবু তারা বাধ্য হয়েছিল চাকরি ছাড়তে। কর্তৃপক্ষ খুশি হয়েছিল। তাদের অনেক টাকা বেঁচে গিয়েছিল।
‘এখন দেখেন, কীভাবে একটা বাজে অভিযোগ মাথায় নিয়ে যেতে হলো তাকে! অপমান অসম্মানের চূড়ান্ত হলো! আসলে অন্যের জন্য গর্ত খুঁড়লে সেই গর্তে নিজেকেই পড়তে হয়।’
মানুষ হয়তো অকারণেই সবকিছুর কার্য-কারণ খোঁজে। সব ঘটনার পেছনে নিজের মত একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারলে খুশি হয় তারা। বিশেষ করে দৈব ব্যাখ্যা। একটা ঘটনার সঙ্গে অন্য ঘটনার যোগসূত্র স্থাপন করে হয়তো এক ধরনের তৃপ্তি বোধ করে তারা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সেই ধারণা হয় অযৌক্তিক ও বাস্তবতাবিবর্জিত।
লাঞ্চের পর নিজের ডিপার্টমেন্টের কর্মীদের নিয়ে সংক্ষিপ্ত একটা মিটিং সারে শবনম। অযথা অপ্রয়োজনীয় কথা বলে টেনে টেনে মিটিং লম্বা করার ঘোর বিরোধী সে। প্রতি মিটিংয়েই সুনির্দিষ্ট এজেন্ডাভিত্তিক কথা বার্তার বাইরে বেশি কথা বলা এলাউ করে না শবনম। তার অধঃস্তনরা এভাবেই অভ্যস্ত। তবে ঊর্ধ্বতনদের ডাকা অনেক মিটিংয়ে গিয়ে দেখেছে সে, সময়ের কি ব্যাপক অপচয়! এজেন্ডা ফেজেন্ডার বালাই নেই, ঊর্ধ্বতন শুরু করলেন তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার দীর্ঘ বয়ান, নাইনটিন সিক্সটি ফোরে আমি যখন লাহোরে ছিলাম, তখন কি হয়েছিল, শোনেন..
এরপর চা নাস্তা, রিফ্রেরেশমেন্ট, বেহুদা আলাপ, একই কথার পুনরাবৃত্তি, কে কার চেয়ে বেশি জ্ঞানী তা প্রমাণের প্রতিযোগিতা, অহেতুক তর্কবিতর্ক অতঃপর দুইটি জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা বর্জন করে মিটিং শেষ। বোরিং বোরিং বোরিং...তবে দুর্ভাগ্যবশত এটাই বেশির ভাগ অফিসে মিটিংয়ের প্যাটার্ন হয়ে গেছে। অথচ সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টায় এসব মিটিং শেষ করে ফেলা সম্ভব।
হাতের আরও দুয়েকটা কাজ গুছানোর মধ্যেই কাঁচের দরজার অন্যপাশে মনিরুজ্জামানের হাসি হাসি মুখ দেখা গেল, ওর সঙ্গে আরেকটা ছেলে, যাকে ঠিক চিনতে পারল না শবনম। ‘খুব জরুরি একটা বিষয় ম্যাডাম, অনেক বড় খবর, আপনাকে বলা দরকার, তাই না এসে পারলাম না, মানে আপনাকে সবার আগে জানাতে চাই...’
শবনমের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির সামনে কাঁচুমাচু মুখে বলে মনিরুজ্জামান। ‘কী খবর, বলো, আর তোমার সঙ্গে উনি কে...’
‘ও হচ্ছে কিবরিয়া, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আমাদের ইন্টারনাল অডিটে কাজ করে ম্যাডাম, ব্যাপারটা ওই জানিয়েছে আমাকে, তাই মনে হলো আপনাকে জানাই। আপনার কাজে লাগবে।’
মনিরুজ্জামানকে মনে হচ্ছে বেশ উত্তেজিত। যেন পরমানু অস্ত্র তৈরির মতো খুব গোপন কোনো ফর্মুলা আবিষ্কার করে ফেলেছে। পাশের ছেলেটা কিবরিয়া সেই তুলনায় শান্ত। শবনম চোখের ইশারায় ওদের বসতে বলল। ‘ঠাণ্ডা হয়ে বসো, তারপর বলো কি হয়েছে?’
মনিরুজ্জামান কিবরিয়ার দিকে তাকালে কিবরিয়া বলে, ‘ইন্টারনাল অডিটে ওসমান গণি সাহেবের একটা ফল্ট ধরা পড়েছে ম্যাডাম, যখন উনি পারচেজ কমিটির প্রধান ছিলেন, তখন অফিসের স্টাফ বাস কেনার টেন্ডারে খুব বড় একটা আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে, কাগজপত্রে সেটার প্রাইমারি প্রমাণ পেয়েছি আমরা, নিশ্চিত হতে আরও কিছু ডকুমেন্টস লাগবে, তবে সেসব পাওয়া যাবে...’
খুব শান্ত নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে কথাগুলা শুনলো শবনম। পেপার ওয়েটটা হাতে নিয়ে ঘুরালো কিছুক্ষণ।
‘ম্যাডাম, এই তথ্যটা ম্যানেজমেন্টের কাছে পৌঁছালে আপনার আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি থাকবে না। সিইও পদে আপনি এমনিতেই তখন প্রমোশন পেয়ে যাবেন। আপনার তো ক্লিন ইমেজ আছেই। এখন ম্যাডাম পুরো রিপোর্ট রেডি করে তথ্য প্রমাণসহ ম্যানেজমেন্টের কাছে পৌঁছাতে তো আরও কিছুদিন সময় লাগবে। সে কারণে আগেই যদি বিষয়টা বোর্ড অফ ডাইরেক্টরসের কাউকে জানিয়ে দেওয়া যায় তাহলে...’
মনিরুজ্জামানের কন্ঠে চাপা চাঞ্চল্য, সরল চেহারাটা আনন্দে চকচক করছে। ‘আমি সিইও হলে আমার উন্নতি হবে, তোমার কী লাভ, বলো?’ শবনম মৃদু হেসে সরাসরি জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান একটু থতমত খায়, যেন এই প্রশ্নটার জন্য সে একদম তৈরি ছিল না।
‘না মানে ম্যাডাম, লাভ আর কী, আপনাকে পছন্দ করি, গণি সাহেব মানে উনি তো ভাল লোক না, মানে লাভ এটুকুই যে আপনার হাতে কোম্পানির উন্নতি হবেছ। মানে আমাদেরও ভাল হবে।’
শবনম এবার শান্ত অবিচলিত কন্ঠে বলল, ‘দেখো, একজন সিনিয়র কর্মকর্তা হিসেবে আমার প্রতিপক্ষের ব্যাপারে এই ধরনের তথ্য লিক করা, মানে যেটা তোমরা বলছ, দুর্নীতির অভিযোগ করা সেটা আমার পক্ষে সম্ভব না। এটা কোনোভাবেই শোভনও হবে না।’
মনিরুজ্জামানের দপ করে নিভে যাওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা বিরতি দিয়ে একটু নিচু স্বরে শবনম যোগ করল, ‘তবে তোমরা জুনিয়র অফিসার, তোমরা যদি কিছু করতে চাও, কারো মাধ্যমে বোর্ড ডিরেক্টরদের বিষয়টা জানাতে চাও, তবে আমার তো বলার কিছু নেই। তাই না?’
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>