ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১২
স্নানের শব্দ
এমনিতে শ্রাবণ বেশ সাদাসিধেভাবেই থাকতে পছন্দ করে। সাজগোজ যে একেবারে করে না তা নয়, তবে সেটা কখনো মাত্রা ছাড়ায় না। রুচিসম্মত পরিমিত সাজেই তাকে অপূর্ব দেখায়। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে শ্রাবণের নবরূপ দেখে প্রাথমিকভাবে বিশাল একটা ধাক্কা সামলায় শবনম। ওর এক মাথা ভর্তি মেঘবরণ কুচকুচে কালো চুলের জায়গায় ফর্সা গোলগাল মুখটা ঘিরে রঙধনুর সাত সাতটা রঙ সমস্ত উজ্জ্বলতা নিয়ে ঝলমল করছে। ওকে দেখাচ্ছে রঙচঙে জিপসিদের মতো। শবনমের মনটা বেদনায় ক্ষোভে হাহাকার করে উঠল, হায়, হায়, করছে কী মেয়েটা? এত সুন্দর চুলগুলো মানুষ এভাবে নষ্ট করে? এটা কোনো ষ্টাইল হলো? কী বেখাপ্পা লাগছে! শ্রাবণ তার চুল খুলে মায়ের সামনে টেলিভিশনে শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপন করা আহ্লাদি মেয়েদের মতো হাসি মুখে মাথাটা হেলিয়ে রঙিন চুলগুলো ডানে বামে ঝাঁকায়,
‘কেমন লাগছে, আম্মু ? .. সুন্দর না, বলো ? .. বকা দিও না প্লিজ .. এটা কিন্তু এখনকার ট্রেন্ড .. ’
শবনম যেন এই মুহূর্তে কিছু বলার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। এই আজব মেয়ের গজব কাণ্ড দেখে কী বলবে সে? এমন একটা দুঃসাহসী অদ্ভুত সিদ্ধান্ত শ্রাবণ একা একা কীভাবে নিতে পারল? নাহ বেশি স্বাধীনতা পেয়ে মেয়েটা একদম বখে গেছে। এত বড় একটা কাজ করার আগে মাকে একবার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করল না পর্যন্ত। অথচ ছাত্রী জীবনে এমনকি সামান্য চুলের আগা দুই ইঞ্চি বেশি কাটলেও মায়ের অনুমতি নিতে হয়েছে শবনমকে।
‘তোর একটুও মায়া লাগল না? এত সুন্দর চুলগুলোকে এইভাবে রং লাগিয়ে নষ্ট করলি?’
‘ওহ মা, নষ্ট করলাম কই? এটা নিউ লুক, চেহারায় কত চেঞ্জ আসছে দেখো, তোমার ভাল লাগছে না?’
সাজ পোষাকে শবনমের বরাবরই বাঙালিয়ানার দিকে ঝোঁক। পয়লা ফালগুনে লাল সবুজ পাড়ের হলুদ শাড়ি, খোপায় গাঁদা ফুল, বর্ষার প্রথম দিন নীল বা মেঘরঙের শাড়ি, পয়লা বৈশাখের লাল সাদা নির্দিষ্ট দিনগুলোতে এখনো মনে করে আলমারি খুঁজে বের করে পরে সে। ছোটবেলা থেকেই ওয়েষ্টার্ণ পোষাকের দিকে শ্রাবণের ঝোঁক বেশি থাকলেও শাড়ি, সালোয়ার কামিজ যে একেবারে পরে না, তা নয়। ওর চুলের স্বাস্থ্য সবসময়ই খুব ভাল, ঘন কালো আর ধরন ধারণ সিল্কি মসৃণ বলে বরাবরই কাঁধ ছাড়ানো লম্বা চুল রেখেই অভ্যস্থ সে। অথচ এই মুহূর্তে শ্রাবণের এই লম্বা রংচঙে চুলকে শবনমের মনে হচ্ছে রঙিন উল সুতায় তৈরি স্রেফ একটা পরচুলা। হাস্যকর, উদ্ভট আর খাপছাড়া।
‘বাবা কিন্তু দেখে ভালই বলছে, বলছে আমাকে নাকি চেনাই যাচ্ছে না। ’
শ্রাবণ তার রঙিন চুলে হাত বুলিয়ে বলে। শবনমের মনে হলো, এই মেয়েকে তো সে নিজেও চিনতে পারছে না। যেন শ্রাবণ তার পেট থেকে জন্ম নেয়নি, যেন বহু দূরের কেউ। এই তো মাত্র কদিন আগে কাউকে কিছু না বলে হুট করে বাঁ হাতের বাহুতে একটা উড়ন্ত প্রজাপতির ট্যাটু আঁকিয়ে নিয়ে এলো শ্রাবণ। সুই দিয়ে খুচিয়ে খুচিয়ে যেভাবে ট্যাটু আঁকা হয়, সেটা শুনেই তো আঁতকে উঠেছিল শবনম।
‘প্রথমে একটু ব্যথা লাগছিল, চামড়া কাটলে যেমন লাগে তেমন হাল্কা তারপর আর ব্যথা লাগে নাই, আসলে চামড়ার দ্বিতীয় স্তর পর্যন্ত ওরা কালিটা লাগায়...অনেক দিনের একটা শখ ছিল, তাই করে ফেললাম। আমার বন্ধুরাও করেছে। বুশরা ওর ঘাড়ে একটা টিকটিকি আঁকিয়েছে, জানো?’
মেয়ের সামনে নিজের প্রচণ্ড বিরক্তি আর রাগ ক্ষোভ চেপে রেখে শবনম একটা কাষ্ঠং শুষ্কং অপ্রসন্ন হাসি ঠোটে ঝুলিয়ে বলে, ‘আামার মা হলে বেত দিয়ে পিটিয়ে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিত যদি তোমার মতো এসব কাণ্ড কারখানা করতাম।’
হে, হে, হে করে দাঁত বের করে শিশুদের মতো হাসে শ্রাবণ। বলে, ‘ভাগ্যিস, তুমি নানুর মতো এতটা রক্ষণশীল চরমপন্থী না, ভেতরের রাগটা মনের মধ্যে চেপে রেখে দিব্যি আমার সঙ্গে সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছ, যদিও তোমার চোখে মুখে ব্যাপক অসন্তুষ্টির ছাপ আমি ধরে ফেলেছি ..’
শবনম এবার একটু গম্ভীর হয়।
‘আসলে তোর সমস্যাটা কী, বলত, কেন এ রকম করছিস? মানে তুই তো এমন আলট্রামডার্ন ছিলি না কখনো, হঠাৎ এমন ট্যাটু, চুলে এমন বাহারি রং, আমি না বুঝতে পারছি না, সমস্যাটা কোথায়...!
‘কোনো সমস্যা না, মা। আসলে তোমাদের ভদ্র সমাজের তথাকথিত নিয়ম ভাঙলাম। এমন ছিলাম না বলে এমন কিছু করতে পারব না, তা কি কেউ বলেছে? আমি খুব সচেতনভাবে, ভেবে-চিন্তে এই কালার করেছি, যাতে তোমাদের চোখ বৈচিত্র্য দেখতে অভ্যস্ত হয়। ডাইভারসিটি একসেপ্ট করে, সব কিছু এক ছাঁচে ফেলে দেখার পুরনো অভ্যাসটা বদলায়...’
এই মেয়ের সঙ্গে বৃথা তর্ক করে লাভ নেই, বুঝল শবনম। কাঁচের চুড়ি ভাঙার মতো নিয়ম ভাঙার ভূত চেপেছে ওর মাথায়। শবনম দেখেছে, তরুণ বয়সে তার অনেক সহপাঠি মেয়ে বন্ধু ছেলেদের মতো শার্ট প্যান্ট পরে বা ধুমপান করে সমাজের প্রচলিত প্রথাগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে চাইত। ধাক্কা দিতে চাইত বদ্ধ সমাজকে। বিদ্রোহী, প্রথাবিরোধী হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে চাইত। তবে শবনমের ধারণা, প্যান্ট শার্ট পরে হাতে জ¦লন্ত সিগারেট নিয়েও যে অনেক সময় সমাজ বদলানো যায় না আবার প্রচলিত পোষাক পরে ধূমপান না করেও নিঃশব্দে সমাজের অনেক কিছু পরিবর্তন করা সম্ভব সেই সত্যটা হয়তো আরও অনেক পরে তারা উপলব্ধি করেছিল। থ্যাংকস গড, শ্রাবণ এখনো ধূমপানের বদঅভ্যাসটা ধরেনি। (অবশ্য ধরতে কতক্ষণ? আর মা হিসেবে তখন কি করবে সে? ভাবতেই ভয় লাগে) পেছন ফিরে নিজের তরুণ বয়সটা দেখার চেষ্টা করে শবনম। বাবা মায়ের কঠোর শাসন অনুশাসনের মধ্যে বেড়ে ওঠা হাত পা বাঁধা জীবন তার। সেই বয়সে সন্ধ্যার পর ঘরে ফেরা কিংবা ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখাই ছিল নিয়ম ভাঙার নামান্তর। নিজের মায়ের মতো অত কঠোর মা হতে পারেনি শবনম। সময় পায়নি, আবার খবরদারি করার ইচ্ছাও জাগেনি। কারণ, নিজেকে দিয়েই জানে সে, শাসনের বেড়াজাল মানুষকে ছোট করে রাখে। পূর্ণ মানুষ হতে দেয় না। তাকে ভঙ্গুর আর হীনমন্য করে তোলে। পরে যখন শাসন থেকে মুক্তি পায় তখন সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি করে ফেলে। এসব কিছু ভেবেই বলতে গেলে কোনো নজরদারি ছাড়াই মুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠেছে শ্রাবণ। তারপরও তার এই বিদ্রোহী মনোভঙ্গী কেন ভেবে পায় না শবনম। এ কি শুধুই তারুণ্যের নিরীক্ষাপ্রবণতা, কে জানে!
ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে উঠেই শ্রাবণ বায়না ধরল বন্ধুদের সঙ্গে বান্দরবানের পাহাড়ে ট্র্যাকিং করতে যাবে। থাকবে পাঁচ রাত। অল্পবয়সী ছেলে মেয়েরা একা একা এত দুর্গম জায়গায় গেলে, উদ্বেগ হয় না? তা ছাড়া, ওসব এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্কও থাকে না। পথঘাটের কী পরিস্থিতি, অজানা অচেনা জায়গায় কোনো বিপদে পড়ে কি না, দুর্ঘটনার আশংকা আছে কি না, কত শত প্রশ্ন মাথায় আসে। দুঃশ্চিন্তায় মন আচ্ছন্ন হয়ে যায়। শবনম তো বাপ মায়ের বাধায় থার্ড ইয়ারে উঠেও ডিপার্টমেন্টের স্টাডি ট্যুরে ইন্ডিয়া যেতে পারেনি, মানে যাওয়ার অনুমতি পায়নি। কিন্তু শ্রাবণ অদম্য, অপ্রতিরোধ্য। বলেছে যখন তখন যাবেই, যাবে। শেষ পর্যন্ত গিয়েওছিল, বন্ধুদের সঙ্গে হেসে খেলে মজা করে নিরাপদে ফেরৎ ও এসেছে। কিন্তু তবু চিরায়ত মায়েদের মত আশঙ্কা উৎকন্ঠায় সারাটাক্ষণ বুক কেঁপেছে শবনমের। তারেক তাকে বোঝায়, ‘আহা তুমি এত সিরিয়াস হইলা কেন? এইসব তো এক্সপেরিমেন্ট, অল্পবয়সে সবাই এমন একটু আধটু করে। বয়স বাড়ুক, দেখবা সব ঠিক হয়ে যাবে।’
‘ওকে কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে বলো.. কি দরকার ছিল ..’
‘দেখো, আমাদের সঙ্গে ওদের রুচির ব্যবধান তো থাকবেই। ওর সব কাজ কারবার আমাদের পছন্দ না হওয়াটাই স্বাভাবিক, কিন্তু মেনে নিতে হবে। করতে দাও যা করতে চায়। তারুণ্যের ধর্মই তো এমন ..’
‘ও আমাকে কি বলছে জানো? বিয়ে করবে না, জরায়ু কেটে ফেলে দেবে আর একটা বাচ্চা দত্তক নিয়ে পালবে। এইসব ট্রাডিশনাল ফ্যামিলি প্রথায় ওর নাকি বিশ্বাস নাই।’
তারেক দাড়ি নাড়িয়ে হো হো করে হাসে। বলে, ‘আমিও তো ভাবছিলাম, জীবনেও বিয়ে শাদি করব না। সংসার থেকে শত হাত দূরে থাকব। সন্ন্যাসী হয়ে পথে পথে ঘুরব। সেই আমিও তো তোমাকে দেখে মত পাল্টাইলাম। সুড় সুড় করে লাইনে আসলাম।’
শবনম বুঝল তারেককে কিছু বলে লাভ নাই। বরাবরের মতোই মেয়েকে সে প্রশ্রয় দিয়েই যাবে। হয়তো সেজন্যই শ্রাবণ অনেক ব্যাপারেই মায়ের চেয়ে বাবার সঙ্গে শেয়ার করতে পছন্দ করে। একটাই কারণ, বাবা মাথা ঝাঁকিয়ে চুপচাপ মেয়ের কথা শুনে যায়, কোনো পরামর্শ বা মতামত দেয় না।
কলেজে পড়ার সময় একবার বিড়াল পোষার বায়না ধরলো শ্রাবণ। ফ্লাটবাড়িতে বিড়াল পোষা কি সহজ ব্যাপার? তা ছাড়া, বিড়ালকে খাওয়ানো দাওয়ানো, পটি করানো, সময়ে অসময়ে পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া-ঝক্কি কি কম? শবনম মেয়েকে নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওই যে মাথায় ঝোঁক চেপেছে, কোনো কিছুতেই সে বুঝ মানে না। বরং উল্টো মাকে বোঝায়, ‘বিড়াল খুব কিউট একটা প্রাণী মা, আমার তো ভাইবোন নাই। ও আমার ছোট ভাইবোনের মত থাকবে। তোমার কিছু করতে হবে না, সব কাজ আমি করব। বাবা বলেছে আমাকে হেল্প করবে।’
বাবার সমর্থন পাওয়ার পর শবনমের আপত্তি আর ধোপে টিকলো না। বাপ বেটি মিলে বেশ দাম দিয়ে একটা জিনজার কালারের গোমড়ামুখি পারশিয়ান বিড়াল কিনে নিয়ে এলো। ‘লীলাবতী‘ নামের সেই আহ্লাদি বিড়াল এখন পরিবারের সদস্য হিসেবে গত কয়েকবছর ধরে আরাম আয়েশ করে বহাল তবিয়তে টিকে আছে। শ্রাবণ ঠিকই বলেছিল, এখন সে পরিবারের আরেকটি সন্তান।
চলবে...