ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১
নেই দেশের নাগরিক
‘কক’ করে উঠলেন! ছেড়া-ফাটা কাঁথা-কাপড়ের পোঁটলা-পুঁটুলির ভেতর থেকে শব্দটা কুঁকিয়ে বেরোল! সে শব্দ শুনে ডুকরে উঠলেন হালেমা, ‘ও আল্লাহ!’ ধড়মড় করে বৈঠাটাকে বাঁশের বাতিতে ঠেসে কোমর ঠেলে ঠেলে পুঁটুলির দিকে এগোল নুহু। সে ঘষটানির ঘষ ঘষ শব্দ অন্ধকার ফুঁড়ে কাতরাচ্ছে।
দুরুদুরু কণ্ঠে নুহু বলল, ‘আল্লাহর উপর ভরসা রাখ, আল্লাহ রহমানের রহিম’। ‘আর কী বা বাকি আছে, যে ভরসা রাখতে হবে! ভিটেমাটি, জমিজিরেত, আবাদপানি সবই তো চলে গেল! খবিশরা আমার ডুগডুগে বৌটাকে চোখের সামনে নেকড়ের মতো ছিড়ে খেল আর ভরসা… ।’
ভিজে গলা অভিমানি হয়ে ওঠে হালেমার। তার ভেতরের নাড়ি দুমড়ে মুচড়ে উঠছে। যেন আস্ত নাফ নদীটা তার চোখে এসে উথলে পড়ছে। এ কি জলের নদী, না যন্ত্রণার? মানুষের শরীরেও নদী থাকে। সে নদী যেমন ঝর্ণার মতো কুলকুল করে বয়, আবার ফোয়াত নদীর মতো কষ্টের ক্ষিরও হয়ে ওঠে। আল্লাহর প্রতি ভরসা একটু একটু করে মরতে বসেছে হালেমার। তার ক্ষোভ, ‘মাটি দিতে পারবেন না তো জন্ম দেওয়ার কী দরকার ছিল?’ পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে বসে থাকেন হালেমা। কাঁথাটা ধুকপুক ধুকপুক করে নড়ছে। ভাবেন, মানুষটা এবার সত্যি সত্যি কাঁথা হয়ে যাবে! মানুষটার ঘাড়ের কাছে ছো মেরে বসে আছে মরণের ফেরেশতা আজরাইল! কখন খপ করে কলজে থেকে জানটা ছিনিয়ে নিল বলে! তাহলে কি মানুষটার শেষ ইচ্ছে পূরণ হবে না? চারপাশ ঘুলঘুল করে দেখলেন হালেমা। শুধু জল আর জল! কোত্থাও মাটির চিহ্ন নেই! জলের ওপর ঠেস মেরে বসে আছে ঘুটঘুটে আঁধার। হালেমা ভাবেন, এ আঁধার নয়, এ হল আজরাইলের ছায়া। সব্বাইকে একসঙ্গে গিলে খাওয়ার জন্যে ঘাপটি মেরে আছে। হাতের চুড়ি এবার ভাঙতে হবেই।
‘ধড়ফড় ধড়ফড় করছে, শ্বাসকষ্টটা মনে হয় বেড়ে গেছে!’ কাঁথার ভেতরে হাত পুরে বাপের নাড়ি টিপল নুহু। হাতে গরম ভাপ খেয়ে বলল, ‘গা’টা একেবারে পুড়ে যাচ্ছে গ!’
‘ওর সময় হয়ে এসেছে।’
‘মা, সবুর করো, আল্লাহ ঠিকই হেদায়েত করবেন।’ কান্নার দলা গলায় চেপে দুহাত আসমানের দিকে তুলল মতি। সে টাপার(ছৈ) মটকায় ওঠে, আরিফার শুকনো কাপড়টাকে টাপার পশ্চিমদিকের হলহলে মুখটাতে এঁটে বাঁধছে। হাওয়া একেবারে বেহুদ্দের মতো হুহু করে ঢুকে পড়ছে। খিলখিল করে দাঁত কেলাচ্ছে। মাঝেমধ্যে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো এমন ঝাঁকুনি দিচ্ছে যেন নৌকোটা ঠোঙার মতো পাক সাপ্টে উল্টে যাবে! বাঁশের একটা চাটাইকে টাপার মাথায় বেঁধে, কাপড়টাকে গিঁট মারছে মতি। পুয়ালের মতো তার দুবলা-পাতলা শরীরটাও হলহল করে নড়ছে। চামটা পেটটা পিঠের হাড়ের সঙ্গে যেন পোস্টার সাটা সেটে গেছে। পেট আর পিঠ যেন এক। হাড়ে হাড় পুঁতে আছে। অভাব আর অনাহার মানুষের শরীরের হাড়-মাংসে লাগলে সে মানুষের শরীর এমনই চাঁছি হয়ে ওঠে। মতির তামাটে রঙের পাকানো দেহটা হাওয়ার সঙ্গে যেন এঁটে উঠতে পারছে না। দমকা হাওয়ায় মাঝে মধ্যে ধনুকের মতো বেঁকে যাচ্ছে। তখন যেন মনে হচ্ছে, বাঁশের বাতার চেয়ে তার শরীরটাকেই যদি টাপার মাথায় বেঁধে দেওয়া হয়, তো টাপাটা আরও পোক্ত হয়। অনাহারের হাড়গিলে গতরটা যেন শুধু হাড়ের খোল! ভাত-রুটির অভাবে যেন আর কোনো রসকষ বাকি নেই! ফুঁ দিলেই যেন উড়ে যাবে।
‘পেটে বুকে খিল দিয়েই তো বেঁচে আছি রে ব্যাটা। খিলটা ভেঙে পড়লেই তো আর কিচ্ছু নেই। যেভাবে খালি হাতে এসেছি, সেভাবেই খালি হাতে চলে যাব। এ খিল আর ভর নিতে পারছে না। মানুষের শরীর তো আর লোহার কলকব্জা নয় যে বোঝার পর বোঝা ধরে রাখবে? এ যে রক্ত-মাংসের একটা খোল। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে একসময় রুহুটা ফুঁড়ুৎ করে উড়ে চলে গেলেই, ব্যস, এ দেহের সব হিসেবনিকেশ শেষ, তখন দেহটা শুধু একটা খোল, কখন পচবে তার অপেক্ষায় থাকবে। মাটির শরীর মাটি হয়ে যাবে।’ বিড়বিড় করে ওঠেন হালেমা। চোখের জল মুখের জল এক হয়ে যায়। হাতের তসবিহর দানাটায় আঙুলের জোর চাপ দিয়ে ‘লা-ইলাহা’ বলে ওঠেন। যেন এক দোয়া-কলেমা তেলওয়াতেই আল্লাহর দরবারে কান্নার সোর পড়ে যায়। হাই হাই করে ওঠে তামাম ফেরেস্তাকূল। আচানক টাপার উত্তরকোণা থেকে দমকা হাওয়ার মতো ভেসে এল, ‘কত দূর এলাম?’
‘চিন্তা নেই, জান কবজ করা আজরাইল ফেরেশতার নখের কাছে চলে এসেছি।’ ঠেস মেরে ওঠেন হালেমা।
‘মা, তুমি থামবে?’ ধমকে ওঠে নুহু।
‘মা’কে অমন করে বকছ ক্যানে? মা’র মাথা কি ঠিক আছে?’ ঝেঁঝিয়ে উঠল আরিফা। জ্বরে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে সে। গতকালের পুরো বৃষ্টিটা তার গায়ের ওপর দিয়েই গেছে। সে বৃষ্টি জ্বর এনে তার গায়ে কামড় বসিয়েছে। গায়ে তাওয়া তাতা তাপ। হলহল করে হেলে উঠছে শরীর। একেবারে হাড়ে সেঁধিয়ে ঠকঠক করে ঠুকাচ্ছে কনকনানি।
‘উ!’ গোঙানিটা এবার কাঁথার সেলাই ফুঁড়ে নদীর জলে আছড়ে পড়ল। টাপার বাঁধনিতেও ঠক্কর মারল। নৌকোর তক্তায় গেঁথে নৌকোটাকেও খানিক হেলিয়ে দিল। ‘আব্বা!’ মুষড়ে উঠল নুহু। টাপার মটকা থেকে ধপাস করে ঝাঁপ মারল মতি। পা হড়কে মুখ খুঁচে পড়ল নৌকোর পাটাতনে। নৌকোটা ডান দিকে আলতো করে কাত হয়ে হেলে গেল। আর একটু হলে ডুবে যেত।
‘মুখে পানি দাও।’ কেঁদে উঠল নুহু। চোখের কোণে গোল হয়ে থাকা চিকচিকে অশ্রুটা গালে গড়িয়ে পড়ল। শিথেনের কাছে রাখা পিতলের ঘড়া থেকে কাঁসার গেলাসটায় জল ঢেলে, গেলাসটা বাপের মুখের ছমুতে ধরল মতি। নুহু থুত্থুরে ঠোঁটদুটো আলতো করে খুলে ধরল। দাঁতহীন ন্যাড়া মাড়িটা মিহি করে হাঁ করে উঠল। দাঁতপাটির চামটি মাংসগুলো গাবের আঠার মতো এঁটে লেগে আছে। গেলাসের কাণাটা বাঁকিয়ে কয়েকফোটা জল ঢেলে দিল মতি। বিছানাগত মানুষটা ঢোক গিললেন না। জলের ফোটাকটা জিভ চুইয়ে নলিতে গড়ে গেল। গেলার ক্ষমতাই নেই, তো গিলবেন কী করে। চুরাশি বছরের শতাব্দী প্রাচীন মানুষ জাফর আলি। বয়স তার শরীরে জেঁকে বসেছে। জড়ানো চামড়ার হাড়গিলে খুটোলে ঘোলা ডিমের মতো ঘুলঘুল করছে ছানিপড়া চোখ। বাপের কালেও ভাবেননি আল্লাহর ফেরেশতা আজরাইলের সঙ্গে দেখাটা হবে এই নাফ নদীর বুকে। আল্লাহর শেষ হুকুমটা হবে এই ভিটেমাটিহীন অথৈ সমুদ্রে। সারাজীবন আল্লাহর ইবাদত করে নসিবে এই ছিল? জীবনভর আমলনামার এই ফল? মরার পর এই রক্ত-মাংসের দেহটা এক মুঠো মাটি পাবে কি না তারও কোনো ঠিক নেই! জাফরের দুই চোখের কোণ দিয়ে ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে অশ্রু।
মানুষটার আছেই বা আর কি? চোখের এই জলটুকু ছাড়া? আল্লাহর এত বড় দুনিয়ায় আজ যে তার একটুখানি মাথা গোঁজার ঠাঁইও নেই! সাদা ফেকাসে জিভটাকে সিরসির করে নড়তে দেখে, মতি জলের আরও দু ঢোক বাপটার মুখে ঢেলে দিল। আর কিছু না পাক, পানের জলটুকু তো পেল? যে মানুষ মরার সময় মুখে জল পায় না, তার মতো হতভাগা এই দুনিয়ায় কেউ নেই। কিন্তু মুখের জল না হয় দেওয়া গেল, আব্বার শেষ ইচ্ছেটা কি পূরণ করা সম্ভব হবে? আল্লাহ কি আব্বার মরা শরীরটার জন্যে সাড়ে তিন হাত মাটি লিখে রেখেছেন? কথাটা মনের কোটরে থক করে বাজতেই, মতি নৌকোর পেছন পানে চোখ ফেলল, ‘আমাদের মংডুর ঢিবিটা কি আর দেখা যাচ্ছে?’
‘কই, না তো। একটু আগেই সেনার লালবাতির সিগন্যালটা পিটপিট করে ভেসে আসছিল, এখন সেটাও চোখে সুজছে না!’ মিনমিন করল নুহু।
চলবে...
আরএ/