মুখপোড়া, হৃদপিন্ডে পেসমেকার নিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বসুন্দরী
একটি ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনা থেকে প্রাণে বেঁচেছেন। পুরো মুখটি তার আগুনে পুড়েছে। গল্পকে হার মানিয়ে সেই মেয়েটিই হয়েছেন এবারের দ্বিতীয় বিশ্ব সুন্দরী বা প্রথম রানারআপ। নাম ‘শ্রী শাইনি’, জন্মসূত্রে ভারতীয়।
পাঞ্জাবের লুধিয়ানাতে জন্ম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে তারা চলে যান স্বপরিবারে। তখন তার বয়স মোটে পাঁচ। তার বাবা-মায়ের দেশের হয়ে যিনি লড়েছেন ২০২১ সালের আসরে, সেই মানাসা ভারানসি প্রথম ১৩ জনের পর আর তালিকাতে উঠতে পারেননি। ভারতীয় বংশোদ্ভুত আমেরিকান মেয়ে হয়ে তিনিই গিয়েছেন সেরা তিনের লড়াইয়ে ও হয়েছেন প্রথম রানার-আপ। তাকে নিয়ে আয়োজকরা টুইটারে লিখেছেন, ‘পোল্যান্ডের কারালিনা বিউস্কা এবার মিস ওয়াল্র্ড নিবাচিত হয়েছেন। তার সঙ্গে প্রথম রানার-আপ হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রী শেইনি।’
এবারের আসরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে উপস্থাপন করেছেন। প্রথম ছয়ের মধ্যে এসে দেশের একমাত্র সুন্দরী প্রতিযোগী হয়েছেন। এছাড়াও প্রতিযোগিতায় ‘দি বিউটি উইথ দি পারপোজ’ নিবাচিত হয়েছেন। যার মানে-বিশেষ উদ্দেশ্যটির সেরা সুন্দরী। তিনি “মিস ওয়াল্র্ড’স গ্লোবাল অ্যাম্বাসেডর অব বিউটি উইথ দি পারপোজ” হয়ে বলেছেন ‘এই সম্মানে আমি কৃতজ্ঞতা বোধ করছি।’ প্রথম ইন্ডিয়ান-আমেরিকান হিসেবে শ্রী শেইনিই ইতিহাসের প্রথম সুন্দরী হিসেবে আসরে এসেছেন ‘মিস ওয়াল্ড আমেরিকা-২০২১’ নিবাচিত হয়ে। সেই জয়লাভের পর বলেছিলেন, ‘একই সঙ্গে খুশি ও নার্ভাস। আমি মনের কথাগুলো মুখে বলতে পারছি না। সব সাফল্যের প্রেরণা মা-বাবার কাছে যাবে। আমার মায়ের কথা আলাদা করে বলছি, কেননা তার সমর্থনের কারণেই আজকে এখানে। আপনাদের সবাইকে এই সম্মান দেবার জন্য ধন্যবাদ।’
হৃদপিন্ডের স্বাস্থ্যগত কাজের একজন বিশ্বদূত এই অসাধারণ সুন্দরী মেয়েটি নিজে হৃদরোগে আক্রান্ত। মোটে ১২ বছর বয়স থেকে তার হৃদযন্ত্রে একটি পেসমেকার বসানো আছে। তার বয়স এখন ২৬। শেইনি কিন্তু সাংবাদিকতার ছাত্রী। সাংবাদিকতায় অনার্স ডিগ্রি নিয়েছেন। তারপর থেকে বাবার প্রতিষ্ঠানে ব্যবসায় ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছেন। তার জয়লাভের পর মিস ওয়াল্র্ড আরো বলেছে, ‘এই বিউটি কুইনের স্বপ্ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষামন্ত্রী হবেন।’
তিনি পাঁড় পাঠক ও নাচিয়ে। ভালো নৃত্যশিল্পী। খুব আগ্রহ নিয়ে নাচের ওপর বানানো মঞ্চ নাটকগুলো দেখেন এবং উপভোগ করেন স্টান্ড-আপ কমেডি। তার হৃদরোগ নিয়ে কাজ করতে একটি প্রকল্প আছে। নাম, ‘হৃদপিন্ডের স্বাস্থ্য : শারিরীক ও আবেগীয় হৃদপিন্ডের আরোগ্য’। এর বাদেও কোভিড রোগের সময় ভারতের দুর্গত মানুষদের জন্য ত্রাণ তহবিল করেছেন। নিজের ভবিষ্যত লক্ষ্যগুলোর কথা জানিয়েছেন এভাবে, ‘পেসমেকারকে নিয়ে বাস করার উপায়গুলোই আমি খুঁজে চলি। বিশ্ব সুন্দরী হওয়ার পর এই কথাগুলোই বলতে চাই, মানুষকে সাহায্য করতে সারা দুনিয়াতে কাজ করুন। তাদের উৎসাহিত করুন, উদ্দীপ্ত করুন। এখন থেকে আমার সব মনোযোগ নিজের সেরাটি দেবার চেষ্টায় থাকবে, তুলে ধরব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। আমরা দেখব কী ঘটে।’ আরো বলেছেন, ‘একজন হৃদরোগী ও মুখ পুড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ হিসেবে প্রতিটি প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্ত মানুষকে উপস্থাপন করি। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গেই আমি আছি, যারা নিজেকে বাইরের লোক মনে করেন বা পরাজিত ভাবেন।’
বিশ্বকে আগের মতোই সারাজীবনভর উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে মানুষকে তৈরি করা ও ওপরে ওঠার প্রেরণাগুলোর মাধ্যমে সাহায্য করে যাবেন তিনি। বলেছেন, ‘নিরাময় বা আরোগ্য লাভের জন্য সবখানে অনেক হৃদয় আছে।’
জীবনে তার আরো অনেক গল্প। পেসমেকার বসানোর পর চিকিৎসকরা নাচতে ভালোবাসা মেয়েটিকে বলে দিয়েছিলেন, তিনি আর কোনোদিনও নাচতে পারবেন না। তবে কখনো কোনোকিছুতে হার মানেননি। বলেছেন, ‘আমি সত্যিকারভাবে বিশ্বাস করি, আপনার উত্তরাধিকার নির্ধারিত হয় কীভাবে অন্যদের অনুভূতিগুলোকে পূরণ করছেন ও সারাজীবনভর কী ভালো পার্থক্যগুলো গড়ে দিতে পারছেন।’ এরপর মোটে ১৫ বছর বয়সে নিজে একটি অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তোলেন ও সমাজ এবং মানুষের ভালোর জন্য কাজ শুরু করেন।
শ্রী শেইনি মিস ইন্ডিয়া প্রথম ১৩ জনে থাকার পর চলে যাওয়ার পর কেবল যুক্তরাষ্ট্রকেই নয়, পিতৃভূমি ভারতকেও তুলে ধরেছেন বিশ্ব সুন্দরীদের সেরা আসরে। একাকে দুই, দুটি সম্মাননা লাভের পর বলেছেন, ‘৩৩৩ মিলিয়ন আমেরিকানের প্রতিনিধিত্ব করেছি গর্বিতভাবে ও কোটি, কোটি ভারতীয়কে তুলে ধরেছি সারাবিশ্ব জুড়ে যারা থাকেন।’
এর আগে অভিবাসী পরিবারের মেয়েটি ‘মিস ইন্ডিয়া ওয়াল্র্ডওয়াইড ২০১৮’ নির্বাচিত হয়েছেন। তাকে নিয়ে সেই আয়োজকরা বলেছেন, ‘তিনি দেখিয়েছেন, ভারতের বাইরে এই দেশে যে মেয়েরা বাস করেন, তারাও তাদের দেশকে বিশ্ব আসরে শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরতে পারেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি, অদূর ভবিষ্যতে ভারতের বাইরে বাস করা এই দেশের মেয়েরা মিস ওয়াল্র্ড ও মিস ইউনিভার্স পদকগুলো জয় করবে।’
আসরটি বসেছিল নিউ জার্সি অঙ্গরাজ্যের ফোর্ড শহরে। ছিল ২৭তম। আয়োজন করেছিল নিউ ইয়কনির্ভর ‘ইন্ডিয়া ফেস্টিভ্যাল কমিটি’ বা ভারতীয় উৎসব সমিতি। সংক্ষেপে ‘আইএফসি’। এটিই ভারতীয় দিয়াসপুরা কমিউনিটি নামের সেখানকার ভারতীয় একটি সমাজের সবচেয়ে পুরোনো ও সবচেয়ে বড় উৎসব। তখন শেইনির বয়স ছিল ২২ বছর। বলেছিলেন জয়লাভের পর, তার স্বপ্ন একটি বিশ্ব পদকের জন্য লড়বেন। এই স্বপ্নটি দেখতে শুরু করেছিলেন প্রাথমিকে লেখাপড়ার সময়। সেবার সারা দুনিয়ার ১৭টি দেশের ভারতীয় মেয়েরা বাষিক সুন্দরী প্রতিযোগিতাতে অংশ নিয়েছেন।