নিজস্ব প্রতিবেদক
‘খেয়ালের বশে’ অধিক ফাঁসির রায়ে হাইকোর্টের উষ্মা
নিম্ন আদালতে ‘খেয়ালের বশে’ সাক্ষ্য-প্রমাণ যথাযথ বিচার বিশ্লেষণ না করে অধিক সংখ্যায় ফাঁসির রায় ঘোষণার বিষয়ে উচ্চ আদালত উষ্মা প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা। সংশ্লিষ্ট এক মামলায় হাইকোর্টের রায় ঘোষণার পর এই কথা জানান তারা।
দুই ব্যাক্তিকে হত্যার দায়ে নিম্ন আদালতে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১২ আসামির ৮ জনকে খালাস দিয়ে ওই রায় দেন হাইকোর্ট। নোয়াখালীর ওই ঘটনায় সাক্ষ্য-প্রমাণের যথাযথ বিচার-বিশ্লেষণ না করে ‘খেয়ালের বশে’ গণহারে ফাঁসির রায় দেওয়ায় হাইকোর্ট উষ্মা প্রকাশ করেছেন বলে জানান আইনজীবীরা।
আদালত থেকে বের হওয়ার পর আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী আজহার উল্লাহ ভুঁইয়া বলেন, এ বিষয়ে হাইকোর্ট রায় ঘোষণার সময় উষ্মা প্রকাশ করেছেন যে, আইন এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ যথাযথ বিবেচনায় না নিয়ে ‘হুইমের’ উপর ভিত্তি করে এই রায় প্রদান করা হয়েছে, যেটা উচিত নয়।
‘আরও সতর্কভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ পরীক্ষা করা এবং আইনকে যথাযথভাবে বিবেচনায় রেখে এই ধরনের মামলাগুলাে নিষ্পত্তি করার জন্য তাগিদ দিয়েছে।’
আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা বলেন, ট্রায়াল কোর্ট ফাঁসির দণ্ড দিতে বেশি ভালোবাসে। বিচারবিশ্লেষণ না করে এই যে গণহারে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হচ্ছে, হাইকোর্টের আজকের রায়ের মাধ্যমে এটাই প্রতিফলিত হয়েছে, ফাঁসি দিলে এই ফাঁসি হাইকোর্ট ডিভিশন ও আপিল বিভাগে টিকবে না।
আইনজীবী বলেন, এজন্য সময় এসেছে বিচারালয়ে যারা আছেন, বিচার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত এখন দেখেশুনে, সাক্ষ্য-প্রমাণ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সাক্ষীসাবুদ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রায় প্রদানের সময় এসেছে বলে আমি মনে করি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি যতগুলো মামলা করেছি, সেই নিরিখে বলতে চাই, আমরাতো মামলার যে সাক্ষ্য-প্রমাণ সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণ করি, আদালতের নিকট পেশ করি, এতে করে আমার মনে হয় না কোনো অপরাধী ছাড়া পায়।
তিনি বলেন, ‘কোনো অপরাধী ছাড়া পায় না, বরং নিরপরাধ যাদেরকে আসলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো না কোনোভাবে টেনে আনা হয়েছে মামলায়, সে সমস্ত আসামীরাই খালাস পেয়ে যায়। খালাস পাওয়া তাদের অধিকার, এ কারণে তারা খালাস পায়।
প্রসঙ্গত ১৪ বছর আগের ওই মামলার ডেথ রেফারেন্স (নিম্ন আদালতের দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের অনুমোদনের জন্য) ও আপিল শুনানির পর সোমবার বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি জাহিদ সারওয়ারের বেঞ্চ এ রায় দেন।
হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে ফাঁসির দণ্ড থেকে খালাস পেয়েছেন মোফাজ্জল হোসেন জাবেদ, জাফর হোসেন মনু, আলি আকবর সুজন, শামছুদ্দিন ভুট্টু, সাহাব উদ্দিন, নাছির উদ্দিন মঞ্জু, আবু ইউসুফ সুমন ও তোফাজ্জল হোসেন জুয়েল। বাকি চার আসামির মধ্যে আবদুস সবুরের ফাঁসির দণ্ড পাল্টে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া কামরুল হাসান সোহাগ, রাশেদ ড্রাইভার ও কামাল হোসেন ওরফে এলজি কামালের ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখেছেন উচ্চ আদালত। তাদের সবাই পলাতক।
তবে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহীন আহমেদ খান। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, বিচারিক আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হওয়ায় তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
‘কিন্তু জোরালো সাক্ষ্য-প্রমাণ থাকা সত্বেও সেগুলো আমলে না নিয়ে হাইকোর্ট ৮ আসামিকে খালাস দিয়েছেন। এ রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ সংক্ষুব্ধ, আমরা আপিল করব।’
উল্লেখ্য ২০০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাতে নোয়াখালী শহরের ‘মোবাইল ফেয়ারের’ মালিক ফিরোজ কবির মিরণ ও তার দোকানের কর্মচারী সুমন পাল নগদ ১৩ লাখ টাকা ও কিছু মোবাইল ফোন সেট নিয়ে রিকশায় বাড়ি ফিরছিলেন। পথে নাপিতের পুল এলাকায় সন্ত্রাসীরা তাদের দুজকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। পরে টাকা ও মালামাল ছিনিয়ে নিয়ে তাদেরকে কুপিয়ে খুন করে মরদেহ সড়কের পাশে ফেলে যায়।
ঘটনার পরদিন নিহত মিরনের বাবা এবি সিদ্দিক বাবুল মিয়া বাদী হয়ে ২৩ জনকে আসামি করে সুধারাম মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।
১০ জনকে খালাস দিয়ে ২০১৬ সালের ২৩ মার্চ নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা দায়রা জজ এ এন এম মোরশেদ খান ১২ জনের ফাঁসির রায় দেন। সোলাইমান জিসান নামে এক আসামি আগেই র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছিলেন।
রায় ঘোষণার পর আসামিপক্ষের আইনজীবী হেলাল উদ্দিন মোল্লা বলেন, ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিল বিবেচনায় নিয়ে আদালত ৮ জনকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে মুক্তি দান করে এবং অনতিবিলম্বে তাদেরকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।
তিনি বলেন, অন্য তিনজন আসামির ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত থাকার বিষয়ে তাদের স্বীকারোক্তি বিবেচনায় নিয়ে তাদের ফাঁসির দণ্ডাদেশ হাইকোর্ট বিভাগ বহাল রেখেছেন।
এক আসামি আব্দুস সবুরের সাজা কমানোর বিষয়ে আইনজীবী বলেন, তার বিরুদ্ধে মামলা প্রমাণিত হয়েছে মর্মে আদালত সাব্যস্ত করে তাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ কমিয়ে ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন।
এমএ/এমএমএ/