আপাতত জাপানি মায়ের কাছে থাকবে দুই শিশু
দুই কন্যা শিশু আপাতত তাদের মা নাকানো এরিকোর কাছে থাকবে। আগামী ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত থাকবে বলে আদেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
আদেশে এই সময়ের মধ্যে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে শিশুদের মা ও জাপানি নাগরিক এরিকোকে নিয়মিত লিভ টু আপিল (সিপি) করতে বলা হয়েছে।
শিশুদের বাবা ইমরান শরীফও সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে শিশুদের সাথে দেখা করতে পারবেন বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সর্বোচ্চ আদালত।
এই দুই কন্যা শিশুকে নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে জাপানি মায়ের করা আপিল শুনানির ধারাবাহিকতায় সোমবার (৩ জানুয়ারি) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে তিন বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এই সিদ্ধান্ত দেয়।
আদালতে আজ মায়ের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আহসানুল করিম ও শিশির মনির। আর বাবার পক্ষে ছিলেন আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।
এ সময় আপিল বিভাগে বাবা-মায়ের সাথে দুই শিশু কন্যা আদালত কক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
প্রসঙ্গত গত ২১ নভেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ দুই শিশুকে নিয়ে দেয়া রায়ে বলেছে, যেহেতু মা জাপানি নাগরিক, সেখানে তার বসবাস ও কর্মস্থল সে কারণে তিনি তার সুবিধামত সময়ে বাংলাদেশে এসে শিশুদের সঙ্গে প্রতিবার কমপক্ষে ১০ দিন একান্তে সময় কাটাতে পারবেন। এক্ষেত্রে বছরে তিন বার বাংলাদেশে তার যাওয়া আসাসহ ১০ দিন অবস্থানের যাবতীয় খরচ শিশু দুটির বাবাকে বহন করত হবে। তবে এর চেয়ে অতিরিক্ত যাওয়া-আসা বা বাংলাদেশে অবস্থানের ক্ষেত্রে খরচ মা নিজে বহন করবেন। এছাড়া বাবা মাসে কমপক্ষে দুই বার শিশু সন্তানদেরকে ভিডিও কলে মায়ের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেবেন। আর গত কয়েক মাস বাংলাদেশে অবস্থান ও যাতায়াত বাবদ ওই মাকে ১০ লাখ টাকা সাত দিনের মধ্যে দিতে শিশুদের বাবার প্রতি নির্দেশ দেয় আদালত।
এছাড়া সংশ্লিষ্ট সমাজ সেবা কর্মকর্তাকে এই শিশুদের দেখভাল অব্যাহত রাখতে এবং প্রতি তিন মাস পরপর শিশুদের বিষয়ে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর প্রতিবেদন দিতে হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়। তবে জাপানে থাকা এদের আরেক মেয়েকে হাইকোর্টে হাজিরের নির্দেশনা চেয়ে ইমরান শরীফের করা রিটটি খারিজ করে দেওয়া হয়।
এর আগে দুই মেয়েকে নিজের জিম্মায় পেতে ঢাকায় এসে গত ১৯ আগস্ট জাপানি মায়ের করা রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেয়। হাইকোর্ট ওই দুই মেয়েকে নিয়ে বাবা ৩০ দিন বিদেশ যেতে পারবেন না বলে নিষেধাজ্ঞা দেয়। পরে দুই মেয়েকে বাবার হেফাজত থেকে সিআইডি উদ্ধার করে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখে। এ বিষয়ে শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিশুদের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারেই রাখার নির্দেশ দেয়। তবে ওই সময়ে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মা ও বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাবা শিশুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেন। একপর্যায়ে দুই পক্ষের আইনজীবী আদালতে এসে জানান শিশুদের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। পরবর্তীতে দুই পক্ষের প্রস্তাবের ভিত্তিতে হাইকোর্ট আদেশ দেয়, ইমরান শরীফের গুলশানের ভাড়া করা ফ্লাটে দুই শিশুকে নিয়ে বাবা- মা আপাতত ১৫ দিন একসাথে থাকতে পারবেন। সেই সাথে ঢাকার সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালককে এদের পারিবারিক পরিবেশের বিষয়টি দেখভাল করেতে নির্দেশ দেয়া হয়। এছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশ এবং পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) দুই শিশু ও তাদের মা-বাবার যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বলা হয়। তবে এই আদেশ মোডিফিকেশন চেয়ে এরিকোর করা আবেদনের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চার রাত (৯, ১১, ১৩ ও ১৫ তারিখ) দুই কন্যা শিশুকে নিয়ে জাপানি মা গুলশানের বাসায় থাকবেন বলে আদেশ দেয়। বাকি সময়টা বাবা-মা দুজনেই শিশুদের সাথে থাকতে পারবেন বলে আদেশ দেয়া হয়।
এছাড়া বাবা-মা দুজনই তাদের শিশুদের নিয়ে বাইরে যেতে এবং কেনাকাটা ও ঘুরাফেরা করতে পারবেন বলে আদেশে বলা হয়। আর ওই ফ্লাটের ভেতরে স্থাপন করা সিসি ক্যামেরা অপসারণ করে বাসার বাইরে তা স্থাপন করতে বলেন হাইকোর্ট। এছাড়া বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে দুই শিশুর মা-বাবাকে নিয়ে প্রচারিত ‘অবমাননাকর ভিডিও’ অপসারণে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়ে ওইসব ভিডিও যারা তৈরি ও প্রচার করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সিআইডি’র সাইবার পুলিশ সেন্টারকে ওইদিন নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর বাবা-মাকে সমঝোতার সুযোগ দিয়ে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গুলশানের বাসায় একদিন মা ও একদিন বাবাকে শিশুদের সঙ্গে থাকার সুযোগ দিয়ে আদেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। আদেশ অনুযায়ী ২৮ সেপ্টেম্বর বিষয়টি শুনানির জন্য এলে দু’পক্ষই আবার সমঝোতার জন্য সময় চায়। তখন আদালত দু’পক্ষকে আবার সমঝোতায় বসার সুযোগ দিয়ে পরবর্তী শুনানির জন্য দিন ধার্য করে। পরবর্তীতে হাইকোর্ট তার আদেশে ২১ অক্টোবর পর্যন্ত দিন-রাত সব সময় জাপানি মা এরিকো গুলশানের ভাড়া ফ্লাটে দুই কন্যাকে নিয়ে থাকতে পারবে বলে আদেশ দেয়। এই সময় বাবা ইমরান শরীফ শুধু দিনের বেলা সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে ও থাকতে পারবেন বলে বলা হয়। অবশেষে কয়েক মাস জুড়ে আলোচনা থাকা বিষয়টি নিয়ে রায় দেয় হাইকোর্ট।
তবে দুই শিশুর জিম্মা নিয়ে করা রিটটি (কন্টিনিউয়াস ম্যান্ডামাস) বিচারিক বিবেচনায় চলমান থাকবে বলে দেয়া রায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, আমরা দুই পক্ষের আইনজীবীকেই আন্তরিক ধন্যবাদ জানাবো কোর্টকে সহযোগিতা করার জন্য। এধরণের একটা কন্টেস্টিং মামলায় দুই পক্ষেই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ল’ উপস্থাপন করেছেন, যাতে আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি এবং যা আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে খুব সহায়ক হয়েছে। তবে হৃদয় বিদারক কথা হচ্ছে, আমরা আজ যে রায় বা আদেশ দেই না কেন, ভিকটিম কোন না কোন পক্ষ তো হবেন। তবে তারচেয়ে বেশি ভিকটিম হবেন এই দুই শিশু সন্তান। তবে আমরা আশা করবো যে, এই বাবা-মা ভবিষ্যতে যেন আরো গঠনমূলক এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই বাচ্চাদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করেন এবং সেক্ষত্রে তারা যাতে পদক্ষেপ নিতে পারেন আমরা সে সুযোগ রেখেই আদেশটি দিচ্ছি।
আদেশে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম আরও বলেন, আরেকটি কথা বলতে হবে যে, আমরা আপনাদের সিদ্ধান্ত এবং যুক্তি সবকিছুই যতটুকু সম্ভব বিবেচনা করেছি। এসব বিবেচনা করতে গিয়ে আমরা শিশু দুটির সাথে সর্বমোট ৩ বার কথা বলেছি। আমরা আমাদের বিবেচনায় বাচ্চাদের বর্তমান পর্যায়ে কল্যাণের জন্য যে ধরনের আদেশ প্রদান করা সমীচীন, সেভাবেই আদেশ দিচ্ছি।
হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে নাকানো এরিকোর করা আপিলের শুনানি নিয়ে চেম্বার আদালতের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ১২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে বিষয়টি শুনানির জন্য নির্ধারণ করেন। সে ধারাবাহিকতায় গত ১২ ডিসেম্বর শুনানি নিয়ে দুই শিশুকে ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর মায়ের জিম্মায় রাখতে নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ। আর ১৫ ডিসেম্বর দুই শিশুকে আদালতে নিয়ে আসতে বলা হয়। কিন্তু দুই শিশুকে মায়ের কাছে না দেয়ার প্রেক্ষাপটে দুই শিশুকে পরে আপিল বিভাগে হাজির করতে নির্দেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত। সে অনুযায়ী দুই শিশুকে বাবা আদালতে নিয়ে আসলে আপিল বিভাগ শিশুদের খাসকামরায় নিয়ে প্রায় ৩০ মিনিট তাদের কথা শোনে।
পরে আদালত ওই দুই শিশুকে মায়ের জিম্মায় রাখার আদেশ চলমান রেখে ১৫ ডিসেম্বর পরবর্তী আদেশের দিন ধার্য করে। সে অনুযায়ী গত ১৫ ডিসেম্বর আদালত আদেশ দেয় যে, আগামী ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই কন্যা শিশু তাদের মা নাকানো এরিকোর কাছে থাকবে।
এমএ/কেএফ/