মৃত্যুর অনেক পর আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে অন্তর্ভুক্তি!
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনজীবী অন্তর্ভুক্তির নতুন একটি তালিকা প্রকাশ করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়া নামগুলোর মধ্যে অনেক আইনজীবীর নাম আছে, যারা তালিকাভুক্ত হওয়ার অনেক আগেই মারা গেছেন বলে প্রধান বিচারপতিকে অবহিত করেছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক মো: রুহুল কুদ্দুস (কাজল)।
গত ৩০ ডিসেম্বর এই তালিকা প্রকাশ করে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি (তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন) মহোদয়ের সভাপতিত্বে আপিল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী (বর্তমান প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি জনাব মো: নূরুজ্জামান এবং বিচারপতি ওবায়দুল হাসান মহোদয়ের সমন্বয়ে এনরোলমেন্ট কমিটি গত ২৬/১২/২০২১ খ্রি. তারিখের সভায় প্রত্যেক সদস্যের স্বতন্ত্র মতামতের ভিত্তিতে নিম্ন তালিকাভুক্ত বিজ্ঞ আইনজীবীদের বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, আপিল বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’
নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে এই তথ্য তুলে ধরেন বার সম্পাদক। অ্যাটর্নি জেনারেলের দপ্তর এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষ থেকে এই সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির এজলাসে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় এজলাসে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের (আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ) বিচারপতিগণ উপস্থিত ছিলেন।
আইনজীবী সমিতির পক্ষে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল। বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আপিল বিভাগে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্তি, অ্যাডভোকেট-অন রেকর্ড হিসেবে তালিকাভুক্তি ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে সম্মাননা প্রদানের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড ও নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। কোনো একজন ল’ গ্র্যাজুয়েট নিম্ন আদালতে আইনজীবী হওয়ার জন্য বার কাউন্সিল নির্ধারিত পদ্ধতিতে প্রথমে এমসিকিউ, পরবর্তীতে লিখিত ও সর্বশেষ ভাইভা দিয়ে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। হাইকোর্ট বিভাগে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রেও অনুরূপভাবে এমসিকিউ, লিখিত পরীক্ষা ও ভাইভা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হয়।’
রুহুল কুদ্দুস আরও বলেন, ‘একটি তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে হয়। অথচ আপিল বিভাগে তালিকাভুক্তির জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম বা মানদণ্ড না থাকায় অধিকাংশ আইনজীবী তালিকাভুক্তি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না। ২০২১ সালের ৩০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞ আইনজীবীর নাম উল্লেখ করা আছে, যারা অনেক আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে এ সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হওয়ার পর এর স্বচ্ছতা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলার সুযোগ পান। আমরা মনে করি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে আপিল বিভাগে অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্তি, অ্যাডভোকেট-অন রেকর্ড তালিকাভুক্তি ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে সম্মাননার বিষয়টি নির্ধারিত হওয়া প্রয়োজন।’
তিনি বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে একজন বিচারপ্রার্থীর সর্বশেষ আশা-ভরসার স্থল। সুতরাং এই অঙ্গনকে কুলষমুক্ত রাখা, দুর্নীতিমুক্ত রাখা আমাদের সবার দায়িত্ব। ঘুষ-দুর্নীতি-অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা সদা-সর্বদা সোচ্চার। তবে সমিতির সদস্য হিসেবে আমরা প্রতিনিয়ত কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকি। আপনার কার্যকালের এই প্রথম কর্মদিবসে তার কয়েকটি বিষয় আমি সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করতে চাই।’
‘বর্তমানে হাইকোর্ট বিভাগের ফৌজদারি মোশন বেঞ্চগুলো থেকে স্বল্প মেয়াদে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ছয় মাস বা এক বছর। জামিন প্রাপ্তির পর সংশ্লিষ্ট আদালত থেকে আদেশ নামানো, আদেশ ডেসপাস করা প্রতিটি ক্ষেত্রে অহেতুক নানাবিধ অতিরিক্ত পয়সা খরচ করতে হয়। অথচ আদালতে ফাইল আনা, ফাইল পাঠানো কিংবা আদেশ পাঠানো আইনগতভাবে অত্র আদালতের প্রশাসনিক দায়িত্ব। নবীন আইনজীবীরা এটির যে নিয়ম সেটি আজ ভুলতে বসেছে।’
‘অনিয়ম এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে মনে হয় এসব প্রশাসনিক কাজ সংশ্লিষ্ট আইনজীবী বা আইনজীবী সহকারীর দায়িত্ব। এ কারণে বিচার প্রশাসনে নানা রকম দুর্নীতি ও অনিয়ম ঘটছে। একটি মামলা এফিডেভিট করে দায়েরের পর আদালত পর্যন্ত পৌঁছাতে ও আদালতের আদেশের পর আদেশ পাঠানো পর্যন্ত পদে পদে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়। কোনো মামলা, জামিন কিংবা স্থগিতাদেশ বৃদ্ধির জন্য সময়মত নির্দিষ্ট আদালতে ফাইল না আসা কিংবা আদেশ সময়মত নিম্ন আদালতে না পৌঁছানোর ফলে জামিন প্রাপ্ত ব্যাক্তির অহরহ নিম্ন আদালত কর্তৃক পুনরায় কারাগারে প্রেরণের ঘটনা ঘটছে। এসব সমস্যা সমাধানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করার জন্য আপনার প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘এ কথা অনস্বীকার্য যে হাইকোর্ট প্রদত্ত অন্তর্বর্তীকালীন যেকোনো আদেশ, বিশেষ করে জামিন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে মামলার সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চেম্বার জজ আদালতে একতরফা শুনানি হয়ে থাকে। যেহেতু প্রতিটি আবেদনপত্রে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর মোবাইল নম্বর থাকে, আপিল শুনানির পূর্বে আপিলকারী পক্ষ কর্তৃক হাইকোর্ট বিভাগে মামলা দায়েরকারী বিজ্ঞ আইনজীবীকে অবহিত করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমাদের সমিতির পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ আইনজীবীকে অবহিত করণের বিষয়ে সহযোগিতা প্রদান করা হবে।’
এমএ/এসআইএইচ