ফিরে দেখা ২০২১
আদালতের মুখোমুখি হয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতিসহ কয়েকজন বিচারক
মহামারি করোনার প্রভাবে বিদায়ী বছর ২০২১ সালে সারাদেশের সব আদালতে বিচারিক কার্যক্রম চলেছিল ঢিমেতালে। আদালতে বিচারিক কার্যক্রম কখনও চলেছে সশরীরে, আবার কখনও অন্তরালে। এর মধ্যেও বিচারাঙ্গণের সর্বোচ্চ আসনে থাকা সাবেক এক প্রধান বিচারপতিসহ বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিচারক নিজেই আদালতের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
বিচারকদের মধ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিন্হার বিরুদ্ধে দণ্ডাদেশ দিয়েছিল নিম্ন আদলত। আবার নিম্ন আদালতের বেশ কয়েকজন বিচারককে তলব করেছিল উচ্চ আদালত। এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালতেরও মুখোমুখি হয়েছিলেন নিম্ন আদালতের এক বিচারক।
দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত সাবেক প্রধান বিচারপতি
বিদায়ী বছর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) করা এক মামলায় সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিন্হাকে ১১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে নিম্ন আদালত। গত ৯ নভেম্বর এই রায় দেয় আদালত। পাশাপাশি ৪৫ লাখ টাকা জরিমানাও করা হয় আদালতের দৃষ্টিতে পলাতক সাবেক এই প্রধান বিচারপতির। ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক শেখ নাজমুল আলম দেশের বিচারাঙ্গণের সর্বোচ্চ আসন প্রধান বিচারপতির পদে থাকা সাবেক এই বিচারপতির বিরুদ্ধে এই রায় ঘোষণা করেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্হাকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ৭ বছর এবং দুর্নীতি দমন আইনে ৪ বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। ওই রায়ে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছে, ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকের নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি।
২০১৯ সালের ১০ জুলাই দুদকের পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন বাদী হয়ে ঢাকায় দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক বেনজীর আহমেদ আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, তারা ফার্মার্স ব্যাংক (বর্তমানে পদ্মা ব্যাংক) থেকে দুই ব্যবসায়ী শাহজাহান ও নিরঞ্জনের ভুয়া নথি ব্যবহার করে ৪ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে। পরবর্তীতে আত্মসাৎ করা টাকা সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিন্হার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়া হয়।
যে বিচারকের ক্ষমতা রহিত করেছিলেন প্রধান বিচারপতি
রাজধানীর রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের অভিযোগে করা এক মামলায় দেওয়া রায়ের পর্যবেক্ষণকে ঘিরে ওঠা বিতর্কের মধ্যে ওই বিচারকের বিচারিক এখতিয়ার রহিত করেন প্রধান বিচারপতি। ওই বিচারক মোছা. কামরুন্নাহার ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭-এর বিচারক হিসেবে রেইনট্রি হোটেলে ধর্ষণের মামলায় সব আসামিকে খালাস দিয়েছিলেন।
খালাস পাওয়া পাঁচ আসামি হলেন আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার হোসেনের ছেলে শাফাত আহমেদ, শাফাত আহমেদের বন্ধু সাদমান সাকিফ, নাঈম আশরাফ, শাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন।
গত ১১ নভেম্বর ওই রায় দেন বিচারক। রায়ে দেওয়া পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে ওঠা সমালোচনার মধ্যে বিচারিক ক্ষমতা হারান তিনি।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর আসে, ধর্ষণ প্রমাণে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ফরেনসিক পরীক্ষা করার বাধ্যবাধকতার যুক্তি দিয়ে ওই সময়ের পর মামলা না নিতে পর্যবেক্ষণ দেন তিনি। এই নিয়ে ওঠা সমালোচনার মুখে প্রধান বিচারপতি বিচারক কামরুন্নাহারের বিচারিক এখতিয়ার রহিত করা হয়। পরে তাকে আদালত থেকে সরিয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এরপর দুই বছর আগের একটি ধর্ষণ মামলার আসামিকে জামিন দেওয়া নিয়ে আপিল বিভাগে কামরুন্নাহারকে তলব করে আগে দেওয়া একটি আদেশের বিষয় সর্বোচ্চ আদালতের নজরে আসে। বিষয়টি গত ১৫ নভেম্বর আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় আসে।
আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ থাকার পরও আসলাম শিকদার নামে এক আসামিকে গত বছরের ২ মার্চ জামিন দিয়েছিলেন বিচারক কামরুন্নাহার। কোন এখতিয়ার বা ক্ষমতাবলে ওই আসামিকে জামিন দিয়েছিলেন সে ব্যাখ্যা জানতে তখন আপিল বিভাগে তলব করা হয় কামরুন্নাহারকে। ওই তলবাদেশের ধারাবাহিকতায় গত ১৫ নভেম্বর বিষয়টি কার্যতালিকায় এলে আপিল বেঞ্চে সশরীরে হাজিরা দেন বিচারক কামরুন্নাহার।
চিত্রনায়িকা পরীমণিকে দফায় দফায় রিমান্ডে পাঠানোর পর উচ্চ আদালতে ক্ষমা চেয়েছিলেন দুই বিচারক মাদক মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনির বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফায় রিমান্ড মঞ্জুর করা নিম্ন আদালতের দুই বিচারক হাইকোর্টে ক্ষমা চেয়েছিলেন। এর আগে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা না মেনে মাদক মামলায় চিত্রনায়িকা পরীমনিকে দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে বিচারকের ব্যাখ্যা দিতে নথি ও তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করে হাইকোর্ট।
এর আগে গত ২৯ আগস্ট হাইকোর্টে স্ব-প্রণোদিত আদেশের আর্জি জানানো হয়। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন এ আবেদন করেন। এরপর ২ সেপ্টেম্বর একই বেঞ্চ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় পরীমনিকে দফায় দফায় রিমান্ডে নেওয়ার বিষয়ে বিচারিক আদালতের ব্যাখ্যা ও নথি (কেসডকেট সিডিসহ) তলব করেন হাইকোর্ট। আদেশে দুই তদন্ত কর্মকর্তাকে ১৫ সেপ্টেম্বর সশরীরে উপস্থিত হতে বলা হয়। এছাড়া তিন দফায় রিমান্ডের আদেশ দেওয়ায় সংশ্লিষ্ট বিচারকের কাছে ব্যাখ্যাও চায় উচ্চ আদালত।
রিমান্ডে নির্যাতিতের জবানবন্দি গ্রহণ: বিচারককে হাইকোর্টে তলব
হত্যা মামলার আসামি মো. ফরহাদ হোসেন ওরফে খলু রিমান্ডে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠে। তার জবানবন্দি রেকর্ডের বিষয়ে হাইকোর্টে দেওয়া লিখিত ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হওয়ায় চাঁদপুরের সাবেক চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্টেট মো. নূরে আলমকে তলব করেছিল হাইকোর্ট। গত নভেম্বরে এই আদেশ দেয় উচ্চ আদালত।
জানা গেছে লিখিত ব্যাখ্যায় নূরে আলম বলেছেন, তদন্তকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তিনি ভুল করেছেন। তিনি আদালতের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তার ব্যাখ্যা সন্তোষজনক মনে করেনি আদালত। সেজন্য ওই বিচারককে তলব করেছ উচ্চ আদালত।
হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘন: চট্টগ্রামের এক বিচারককে তলব হাইকোর্টের আদেশ লঙ্ঘনের অভিযোগে চট্টগ্রামের ৩য় যুগ্ম জেলা জজ আদালতের বিচারক সরকার কবির উদ্দিনকে তলব করেছিল উচ্চ আদালত। বিদায়ী বছর ২০২১ সালের শুরুর দিকে গত ১ ফেব্রুয়ারি ওই তলব আদেশ দেয় হাইকোর্ট।
জানা গেছে, উচ্চ আদালতের আদেশ লংঘনের অভিযোগে আদালত অবমাননার রুল জারি করে চট্টগ্রামের ৩য় যুগ্ম জেলা জজ আদালতের বিচারক সরকার কবির উদ্দিনকে তলব করেছিল আদালত।
এমএ/এএন