নৈতিক মূল্যবোধের কথা স্মরণ করালেন প্রধান বিচারপতি
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন
জনগণের আস্থা অর্জনে বিচারকদের উঁচু নৈতিক মূল্যবোধের কথা স্মরণ করালেন বিদায়ী প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। প্রধান বিচারপতির বিদায়ী সংবর্ধনায় দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেন।
অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি প্রধান বিচারপতির এজলাসে বুধবার (১৫ ডিসেম্বর) এই সংবর্ধনা দেয়।
আপিল বিভাগে অনুষ্ঠিত এই সংবর্ধনায় সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, আইনজীবী, সাংবাদিক, আদালতের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় এজলাস কক্ষের সব আসন পূর্ণ হয়ে ফাঁকা জায়গাগুলোও কানায় কানায় পূর্ণ ছিল। তবে আইনজীবী সমিতির সম্পাদকসহ বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের একাংশ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেননি।
প্রধান বিচারপতির এজলাসে সকাল ৯টা ৪৪ মিনিটে প্রধান বিচারপতিসহ উভয় বিভাগের বিচারপতিগণ আসন গ্রহণ করেন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল দপ্তরের পক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির পক্ষে সহসভাপতি মোহা. শফিক উল্লা বক্তব্য রাখেন। শেষে প্রধান বিচারপতি বক্তব্য দেন।
বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের তিনটি (আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ) অঙ্গের দায়িত্ব এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য স্পষ্টভাবে বিধৃত রয়েছে। তিনটি অঙ্গের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কই গণতন্ত্রকে বিকশিত করে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এটা আমাদের সংবিধানের সৌন্দর্য।’
প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, ‘একটি স্বাধীন বিচারব্যবস্থার অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস হলো জনগণের আস্থা। এটা হলো বিচারকদের সততা, সক্ষমতা ও নিরপেক্ষতার প্রতি গণমানুষের অবিচল বিশ্বাস। সাধারণ মানুষের এই আস্থা অর্জনের জন্য বিচারকদের একদিকে যেমন উঁচু নৈতিক মূল্যবোধ ও চরিত্রের অধিকারী হতে হবে, তেমনি সদা বিকাশমান ও পরিবর্তনশীল আইন, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও সামাজিক মূল্যবোধ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। এটা অর্জন সম্ভব কেবলমাত্র নিয়মিত অধ্যয়ন ও সময়মতো আইনানুগভাবে বিচারিক কাজ সম্পন্নকরণের মাধ্যমে।’
‘এ কথা অনস্বীকার্য যে, মামলার সংখ্যা বিবেচনায় আমাদের বিচারকের সংখ্যা অপ্রতুল। মামলার জট নিরসনে দেশের অধস্তন আদালত থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত বিচারকের সংখ্যা পর্যায়ক্রমে দ্বিগুণ করা প্রয়োজন। জেনে খুশি হয়েছি যে, উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের লক্ষ্যে সরকার কাজ শুরু করেছে। সংবিধানের আলোকে বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা বাস্তবতার নিরীখে অপরিহার্য। এতে বিচারপতি নিয়োগের কাজটি আরও স্বচ্ছ ও দ্রুততর হবে এবং জনগণের মধ্যে বিচারপতি নিয়োগের স্বচ্ছতা সম্পর্কে ভিত্তিহীন ধারণা দূরীভূত হবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদালত কক্ষে আয়োজিত জনাকীর্ণ এই সংবর্ধনায় উভয় বিভাগের বিচারপতিগণ, আ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতৃবৃন্দসহ আইনজীবীরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন এবং সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সরকার সমর্থিত প্যানেল থেকে নির্বাচিত হওয়া সহ-সভাপতি শফিক উল্ল্যা বক্তব্য রাখেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল তার বক্তব্যে বলেন, আপনার প্রদত্ত বিভিন্ন রায় অন্যান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আপনার রায়ের গাইডলাইন কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারীর যৌন হয়রানী প্রতিরোধে সুরক্ষাবর্ম হিসেবে কাজ করছে। নারীর নিরাপদ পরিবেশে কাজ করার এবং শিক্ষা গ্রহণের পথকে সুগম করছে যা সুদূরপ্রসারীভাবে নারীর ক্ষমতায়ন ও নারী শিক্ষার বিস্তারে অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
তিনি বলেন, এ ছাড়া ফতোয়ার নামে গ্রামের নিরীহ মানুষকে হয়রানি এবং তাদের মানবাধিকার লংঘন করে কতিপয় শাস্তি প্রদানের যে বিষয়টি পরিলক্ষিত হচ্ছিল আপনার রায়ে এ সকল বিচার বহির্ভূত কার্যকলাপকে আপনি অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সেই সঙ্গে এ ধরণের শাস্তি প্রদানকারী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা যাবে বলে রায় প্রদান করেছেন। আপনার সে রায়ের মাধ্যমে গ্রামের নিরীহ মানুষের বিশেষত নারীর প্রতি সহিংসতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচার ও অধিকারহীনতা মানুষের জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তোলে। ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে আপনার নিরন্তর লড়াই বিচার বিভাগকে দেখিয়েছেন নতুন আলো।’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদকসহ সমিতির বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের একাংশ আজকের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যাননি।
এ বিষয়ে সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বেলা ১২ টায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের চিরাচরিত রেওয়াজ অনুযায়ী কোনো প্রধান বিচারপতির বিদায় অনুষ্ঠানের কমপক্ষে ৩-৪ দিন আগে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি ও সদস্যদের অংশগ্রহণ বিষয়ে সমিতির সভাপতি-সম্পাদককে অবহিত করা হয়ে থাকে ও সদস্যদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ ছাড়া প্রধান বিচারপতির জীবনবৃত্তান্ত প্রেরণ করা হয়। কিন্তু গতকাল (মঙ্গলবার) কর্মদিবসে প্রধান বিচারপতির বিদায় অনুষ্ঠান বিষয়ে সমিতিকে অবহিত করা হয়নি। যেটি সমিতির প্রতিটি সদস্যের জন্য চরম অবজ্ঞার শামিল।
বিএনপি সমর্থিত প্যানেল থেকে সম্পাদক নির্বাচিত হওয়া রুহুল কুদ্দুস বলেন, গতকাল সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিটে এসএমএস-এর মাধ্যমে আজকের এই সংবাদ সম্মেলন সম্পর্কে সাংবাদিক ও আইনজীবী সমিতির সদস্যদেরকে অবহিত করা হয়। সে এসএমএস দেওয়ার পর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল গতকাল সন্ধ্যা ৭ টা ১৭ মিনিটে সম্পাদককে ফোন করে বুধবার সকাল ১০ টা ৩০ মিনিটে প্রধান বিচারপতির বিদায় অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে বলে অবহিত করেন। কিন্তু আমাদের করণীয় কী বা সদস্যদের আমন্ত্রণ বিষয়ে কোন কিছু বলেননি।
আজকের বিদায় অনুষ্ঠান থেকে সুকৌশলে বঞ্চিত করা হয়েছে অভিযোগ করে রুহুল কুদ্দুস বলেন, সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের এহেন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগদান থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
এমএ/এমএমএ/