কীভাবে শেষ হতে পারে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ?
যুদ্ধের দামামা চারিদিকে, গোলা আর বারুদের গন্ধ। এসবের মধ্য দিয়ে দিন পার করছেন ইউক্রেনবাসী। দিন গুনছেন আগ্রাসনের সমাপ্তির। হাজার হাজর মানুষ প্রাণভয়ে ছেড়েছেন নিজ ভূমি। রণভূমি, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, নানা জল্পনা-কল্পনা ছাপিয়ে এখন একটাই ভাবনা এ যুদ্ধের অবসান কোথায়? কীভাবে থামানো যাবে রুশ আগ্রাসন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের ভূমিকা রাখতে পারে সম্ভাব্য এমন পাঁচটি বিষয় নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন করেছেন বিবিসির কূটনৈতিক প্রতিবেদক জেমস ল্যান্ডেল।
সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ:
ধরে নেওয়া যাক যুদ্ধ খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে শেষ হবে। যদি তাই হয়, তাহলে রাশিয়া তার সামরিক অভিযান বাড়াবে। ইতিমধ্যে আমার সেটা দেখতে পাচ্ছি। ইউক্রেন জুড়ে নির্বিচারে কামান এবং রকেট হামলা চলছে। রাশিয়ান বিমান বাহিনী এখনও পর্যন্ত ব্যাপক বোমা হামলা শুরু করেনি। তবে ইউক্রেনের জাতীয় অবকাঠামতে ব্যাপক সাইবার আক্রমণ, বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ মারা গেছে। বেশ শক্ত প্রতিরোধ সত্ত্বেও কিয়েভের পতন হলে ইউক্রেনে মস্কোপন্থী একটি পুতুল শাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। জেলেনস্কিকে হয় হত্যা করা হবে, নয়তো সে পালিয়ে যাবে। পুতিন বিজয় ঘোষণা করবেন, রুশ বাহিনীর কিছু অংশও প্রত্যাহার করবেন। হাজার হাজার উদ্বাস্তু পশ্চিমে পালাতে থাকবে। আর ইউক্রেন বেলারুশের মতো মস্কোর সহযোগী রাষ্ট্র হিসাবে রয়ে যাবে।
এমন কিছু ঘটা অসম্ভব নয়, তবে তা নির্ভর করবে আরও কয়েকটি বিষয়ের ওপর। যেমন, রাশিয়ান বাহিনী আরও জোরাল পারফরম্যান্স। ইউক্রেনের লড়াই করার মনোবল ভেঙ্গে যাওয়া। পশ্চিমাদেশগুলো কিয়েভের সমর্থন থেকে সরে গেলে, পুতিনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তবে রাশিয়াপন্থী সকার প্রতিষ্ঠা হলে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে ব্যাপক অস্থিরতা শুরু হবে, যা বিদ্রোহে রুপ নেবে। ফলাফল হিসেবে আস্থিতিশীল এবং সংঘাত পূর্ণ একটি পরিবেশ বিরাজ করবে।
দীর্ঘ যুদ্ধ:
এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। হতে পারে অপর্যাপ্ত রসদ এবং অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে রুশ বাহিনীর মনোবল দুর্বল হয়ে পড়লো। কিয়েভের মতো শহরগুলিকে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে আরও সময় লেগে গেল। ৯০ এর দশকে যেমনটি ঘটেছিল চেচনিয়ায়। চেচনিয়ার রাজধানী গ্র্রজনি দখল ছিল রাশিয়ার দীর্ঘ এবং নৃশংস সংগ্রাম, যার প্রতিচ্ছবি ইউক্রেনে রয়েছে।
ধরে নিলাম রাশিয়া বাহিনী ইউক্রেনের কিছু শহরের দখল নিল। তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করল। তবে এত বিশাল দেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখার মতো পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েন করতে পারলো না। এদিকে ইউক্রেন প্রতিরক্ষা বাহিনী স্থানীয় জনগণকে সাথে নিয়ে একটি কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হলো। সেখানে পশ্চিমারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করতে থাকলো। অবশেষে বেশ কয়েক বছর পর রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেন ছেড়ে চলে গেল। সেই ৯০ এর দশকের মতো, এক দশক যুদ্ধ করার পর সোভিয়েত ইউনিয়নকে যেভাবে আফগানিস্তান ছাড়তে হয়েছিল।
ইউরোপের যুদ্ধ:
এ যুদ্ধ কি ইউক্রেনের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে পারে? মোলদোভা এবং জর্জিয়ার মতো সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বেশ কিছু অংশ কি নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন পুতিন? যারা ন্যাটোর অংশ নয়। অথবা পুতিন হিসাবে ভুল করে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের আস্ত্র সরবারহকে আগ্রাসন ভেবে নিতে পারেন। আর এর প্রতিউত্তরে বালটিক রাজ্যেগুলোর মধ্যে লিথুনিয়াতে সৈন্য পাঠানোর হুমকি দিতে পারে? যেহেতু বাল্টিক ন্যাটোর সদস্য। আর রাশিয়া বাল্টিকের নিয়ন্ত্রণ নিলে উপকূলীয় ছিটমহল কালিনিনগ্রাদকে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।
আর এখানে যুদ্ধ ন্যাটো বাহিনীর জন্য খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং ভয়ঙ্কর হতে পারে। ন্যাটো সামরিক জোটের সনদের ৫ অনুচ্ছেদে অনুসারে ন্যাটোর একজন সদস্যের ওপর হামলা মানে সবার ওপর হামলা। তবে পুতিন তার নেতৃত্বকে বাঁচাতে এ ঝুঁকি নিতে পারেন, যদি তিনি ইউক্রেনে পরাজিত হন। ইউক্রেনে পরাজয় পুতিনকে ইউরোপে যুদ্ধের মদদ দিতে পারে। রাশিয়ান নেতা আন্তর্জাতিক নিয়ম ভঙ্গ করতে পারে। পুতিন তার পারমাণবিক বাহিনীকে উচ্চ স্তরের সতর্কতার মধ্যে রেখেছেন। বিশ্লেষকদের ধারনা পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার আসন্ন।
কূটনৈতিক সমাধান:
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের কি কূটনৈতিক সমাধান হতে পারে? জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, বন্দুক এখন কথা বলছে, কিন্তু সংলাপের পথ সবসময় খোলা থাকতে হবে। সংলাপ কিন্তু চলছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ফোনে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে কথা বলেছেন। কূটনীতিকরা বলছেন, রাশিয়ান এবং ইউক্রেন কর্মকর্তারা বেলারুশ সীমান্তে আলোচনার জন্য বসেছেন। আলোচনা খুব বেশিদূর এগোয়নি। কিন্তু আলোচনায় রাজি হয়েছেন পুতিন। অর্থাৎ আলোচনার মাধ্যমে যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে একেবারে নাকোচ করেননি পুতিন।
বিশ্লেষকরা বলছেন কোথায় থামতে হবে ভ্লাদিমির পুতিন জানেন। রুশ নেতা জানেন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করাতে কোন কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
একটি কাল্পনিক দৃশ্য, ধরুন যুদ্ধ রাশিয়ার জন্য খারাপ পরিণতি বয়ে আনল। নিষেধাজ্ঞার ফলে মস্কোতে অস্থির অবস্থা শুরু হলো। পুতিন হয়তো ভাবছেন যুদ্ধ থামিয়ে দেয়ার লজ্জার চেয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া তার নেতৃত্বের জন্য বড় হুমকি হতে পারে। এদিকে চীন হয়তো আপোষের জন্য মস্কোকে চাপ দিতে থাকল। আগ্রাসন থেকে সরে না আসলে রাশিয়া থেকে তেল ও গ্যাস কিনবে না চীন। তাই পুতিন একটি উপায় খুঁজতে শুরু করলেন। অন্যদিকে ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ ধ্বংস, প্রাণহানির চেয়ে রাজনৈতিক সমঝোতাকে এ যুদ্ধের অবসানে যথোপযুক্ত সমাধানের পথ হিসেবে বিবেচনা করল। তাই কূটনীতিকরা যুক্ত হলেন একটি চুক্তির জন্য। চুক্তিতে ইউক্রেন ক্রিমিয়া এবং ডনবাসের কিছু অংশের উপর রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিল। এর পরিবর্তে পুতিন ইউক্রেনের স্বাধীনতা এবং ইউরোপের সাথে ইউক্রেনে সম্পর্ক গভীর করার বিষয় অর্থাৎ ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি মেনে নেবে। এমনটি হয়তো ঘটবে না। তবে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও ধ্বংসাবশেষ থেকে বাঁচতে এমন একটি সম্ভবনার কথা উড়িয়ে দেওয়া য়ায় না।
পুতিন ক্ষমতাচ্যুত:
আক্রমণের সময় ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছিলেন, 'আমরা যেকোনো ফলাফলের জন্য প্রস্তুত।' যদি এমন হয় যে পুতিন ক্ষমতা হারাচ্ছেন! এটা অকল্পনীয় হতে পরে কিন্তু এমনটা ঘটা অস্বাভাবিক নয়।
লন্ডনের কিংস কলেজের ওয়ার স্টাডিজের ইমেরিটাস অধ্যাপক লরেন্স ফ্রিডম্যান তার এক লেখায় বলেছেন, 'এখন কিয়েভের মতো মস্কোতেও শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।'
কেন তিনি একথা বললেন? সম্ভবত পুতিন একটি বিপর্যয়কর যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। হাজার হাজার রুশ সৈন্য মারা যেতে পারে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে আরও বিপর্যস্ত হতে পারে রাশিয়া। ফলে জনসমর্থন হারালেন পুতিন। তার জনপ্রিয়তা কমে গেল। দেশের অভ্যন্তরে পুতিন বিরোধী বিদ্রোহ শুরু হলো আর সেই বিরোধিতাকে দমন করতে তিনি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনীকে ব্যবহার করেন। ফলে রাশিয়ার সামরিক, রাজনীতি ও অর্থনৈতিক শক্তি তার বিরুদ্ধে চলে গেল। এদিকে পশ্চিমারা যদি প্রস্তাব দেয় যে, পুতিন সরে গেলে তার পরিবর্তে কোনো মধ্যপন্থী নেতা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলে কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবে এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে। ফলে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুতিন ক্ষমতাচ্যুত হলেন। এমনটি হতে পারে এটা মনে হচ্ছে না?
উপসংহারে এটা বলা যায় যে, পরিস্থিতি যাই ঘটুক তার পেছনে অনুঘটক গুলোই নিয়ে যাবে কোন একদিকে। যা এখনও নিশ্চত নয়। পরিস্থিতি নির্ধারন করবেন পুতিন নাকি পশ্চিমা পরাশক্তি? দুই পরাশক্তি কিভাবে পৌঁছাবে সমাধানে?
কেএফ/