তৃণমূলের ‘প্যারালাল ক্যাপিটাল’ এবং প্রশান্ত কিশোর প্রসঙ্গ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে আট দফায় বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গতবছর ২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত। সেখানে বিজেপির ব্যাপক উত্থান সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস (টিএমসি) নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। বিজেপি পায় ৭৭ আসন। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের তাৎপর্য হলো–মোদি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর এবারই প্রথম কোনো বিরোধী দল বিজেপিকে কড়া জবাব দিতে পারল। এ জয়ের মধ্য দিয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসে। একদিকে, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলকে টেক্কা দিয়ে জিতে যাওয়ায় টিএমসির সর্বভারতীয় স্তরে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষা ব্যাপক জোর পায়। অন্যদিকে, এমন একটি নির্বাচন জয়ের অন্যতম কুশীলব এবং টিএমসির আকাঙ্ক্ষার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে আবারও আলোচনার শীর্ষে আসেন প্রশান্ত কিশোর।
তৃণমূলের সর্বভারতীয় হওয়ার প্রচেষ্টা
কয়েকমাস আগে অনুষ্ঠিত ত্রিপুরায় পৌরসভা ভোটে তৃণমূল কংগ্রেস খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি। তবে তৃণমূলের ভারতব্যাপী সংগঠন গড়ার চেষ্টা এখানে শেষ হয়ে যায়নি। ত্রিপুরায় বামপন্থীদের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সেখানে কয়েকটি আসনে তৃণমূল ভালো করেছে। এর মধ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আরেকটি রাজ্যে সংগঠন গড়ার সুযোগ পেয়েছে দলটি।
অপরদিকে, মেঘালয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবির্ভাব ঘটেছে তৃণমূল কংগ্রেসের। অনেকটা বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি যেভাবে ভাঙন ধরায় সেই কায়দায়। মেঘালয়ে কংগ্রেসের মুকুল সাংমা দুই-তৃতীয়াংশ বিধায়ক নিয়ে কংগ্রেস থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে নাম লিখিয়েছেন। এর ফলে খাতা-কলমে তৃণমূল কংগ্রেস এখন মেঘালয়ে প্রধান বিরোধী দল। মুকুল সাংমা যেহেতু এক-তৃতীয়াংশের বেশি বিধায়ক নিয়ে কংগ্রেস থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে এসেছেন। তাই তারা দল-বদলবিরোধী আইনের আওতায় পড়ছেন না। প্রত্যেক বিধায়ক যারা তৃণমূল কংগ্রেসে এসেছেন, তারা নিজেদের পদটাও ধরে রাখতে পারবেন। এভাবে খুব সুন্দর করে তারা কংগ্রেস থেকে চলে এসেছেন তৃণমূল কংগ্রেসে এবং এভাবেই তৃণমূল কংগ্রেস রাতারাতি হয়ে গেছে মেঘালয়ের বিরোধী দল।
গোয়া বা ত্রিপুরায় এভাবে সাংবিধানিক, রাজনৈতিক কোনো স্বীকৃতি এখনও পর্যন্ত আসেনি। গতবছরের প্রথম ভাগে গোয়ায় একটি টিম পাঠিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সেখানে গিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট সংগ্রহ করা হয়। এর ভিত্তিতে সেখানে সংগঠন সাজিয়ে তোলা হচ্ছে। রাজ্যসভা এবং লোকসভার দুই সাংসদ, যারা কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে এসেছেন, তারা সেখানে কাজ করলে ফসল ঘরে উঠবে বলে মনে করছে জোড়া ফুল শিবির। গত অক্টোবর মাসেই গোয়ায় গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন প্রাক্তন টেনিস তারকা লিয়েন্ডার পেজ এবং নাফিসা আলি। সম্প্রতি দুটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। একদিকে, গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইনজো ফেলেইরোকে রাজ্যসভায় পাঠিয়েছে। অন্যদিকে, সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে গোয়ার বিধানসভা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হলো। পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে তার শক্তিশালী প্রচারণা দেখেছে সেখানকার মানুষ। আবার লোকসভায় তার ঝাঁঝালো বক্তব্যের সামনে দাঁড়াতে পারেননি গেরুয়া শিবিরের অনেক রথী-মহারথী। ইংরেজি, বাংলা এবং হিন্দি ভাষায় সাবলীল মহুয়া। তাই গোয়ার মতো মাল্টি-ডাইমেনশনাল রাজ্যে এমন সুবক্তার উপরই ভরসা করছে তৃণমূল।
উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের গোয়া বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস ৪০ সদস্যের বিধানসভায় একক বৃহত্তম দল হিসেবে ১৭টি আসনে জয়লাভ করে। তারপর কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত বিধায়কদের দলে টেনে বিজেপি গোয়ার বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। বর্তমানে কংগ্রেসের মাত্র চারজন বিধায়ক রয়েছে। প্রথমে বিজেপি, পরে তৃণমূল গোয়ায় পা দিয়ে কংগ্রেসকে ভাঙতে শুরু করে। গোয়ায় ক্রমেই শক্তি বাড়াচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। ক্ষমতায় আসতে না পারলেও তৃণমূল নিজেকে সর্বভারতীয় রূপ দিতে এখন দুই রাজ্য–ত্রিপুরা এবং গোয়াকে মূল টার্গেট করেই প্রচারণা চালাচ্ছে।
এতদিনে অনেকেই জেনে গেছেন যে, প্রশান্ত কিশোর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের পর যে কথাটি বলেছিলেন যে, পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজিস্টের (রাজনৈতিক নীতিনির্ধারক) কাজ থেকে তিনি বিদায় নিচ্ছেন, সেটি একদমই সঠিক নয়। তিনি বিদায় নেননি, কোথাও যাননি, কোনো ব্রেকও নেননি। তিনি তার কাজ বহাল তবিয়তে চালিয়ে যাচ্ছেন। মেঘালয়ে যে মুকুল সাংমা দুই-তৃতীয়াংশ বিধায়ক নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেছেন, তিনি তার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একাধিকবার প্রশান্ত কিশোরকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। শুধু এটুকুই নয়, তৃণমূল কংগ্রেস যে অন্য দল ভাঙিয়ে লোকজন দলে টানছে, যে নেতাদের নামই আলোচনায় আসছে, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই কোনো না কোনোভাবে প্রশান্ত কিশোর কানেকশন রয়েছে।
প্রশান্ত কিশোর একসময় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের জনতা দল (জেডিইউ) দলের নেতা ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন; কিন্তু ‘দলবিরোধী কার্যক্রমের’ জন্য তাকে দল থেকে বিতাড়িত করা হয়। আরও স্পষ্ট করে বললে–২০১৯ সালে বিজেপি নাগরিকত্ব আইন সংশোধন ইস্যুতে নীতিশ কুমার বিজেপির পক্ষ নিলে তিনি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। প্রশান্ত কিশোরকে জেডিইউ থেকে বিতাড়িত করা হয়। সেসময় তার সঙ্গে আরও একজনকে বহিষ্কার করা হয়, তিনি হলেন পবন বর্মা। কিছুদিন আগে তিনিও তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেছেন। সম্প্রতি একটা কথা আলোচনায় ছিল যে, প্রশান্ত কিশোর হয়তো কংগ্রেসে যোগদান করবেন। তিনি সেখানে যোগ দেননি; কিন্তু এতদিন ধরে এই দল ভাঙতে গিয়ে নেতাদের তৃণমূল কংগ্রেসে নিয়ে আসার কাজটা তিনি করে যাচ্ছেন ভালোমতোই।
উল্লেখ্য, বিভিন্ন দল ও ক্ষেত্র থেকে লোকজন টেনে নিয়ে এসে দলকে চটজলদি দেশজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতা তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে আগেও ছিল। মেঘালয়ের মতো রাতারাতি সংগঠন গড়ার চেষ্টা ত্রিপুরাতেও হয়েছিল। ২০১৬ সালে ত্রিপুরায় কংগ্রেসের সুদীপ রায় বর্মণ ছয় বিধায়কসহ কংগ্রেস থেকে যোগদান করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসে। তার ফলে সেখানেও কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস হয়ে গিয়েছিল প্রধান বিরোধী দল। তবে এর কিছুদিন পরই সুদীপ রায় বর্মন তার দলবল নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস থেকে চলে যান বিজেপিতে। যার ফলে ত্রিপুরায় তৃণমূল কংগ্রেসের অস্তিত্বটাই প্রায় মুছে যায়। এখনও বিজেপিতেই রয়েছেন সুদীপ রায় বর্মন। তবে মজার বিষয় হলো–এখন সুদীপ রায় বর্মন বিজেপিতে থেকেই বিজেপির বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন। মনে করা হচ্ছে, সুদীপ রায় বর্মন হয়তো আবার তৃণমূল কংগ্রেসে ফিরে যাবেন।
তবে এবার তৃণমূল কংগ্রেস যেভাবে নিজেদের চারদিকে বিস্তার করার চেষ্টা শুরু করেছে, তার সঙ্গে আগেরবারের অনেকটা তফাৎ রয়েছে। আর সেটি হলো–এবার তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্ব দলকে অন্যান্য রাজ্যে বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। তৃণমূল কংগ্রেসে যেসব লোকজন নেওয়া হচ্ছে, সেটি আপাতদৃষ্টিতে খুব গোঁজামিল মনে হতে পারে, খুব বিক্ষিপ্ত মনে হতে পারে; কিন্তু প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তের পেছনে একটা কারণ রয়েছে। সবই পরিকল্পনার অংশ। হারিয়ানার একজন পলিটিশিয়ান অশোক তানবার কংগ্রেসে ছিলেন, কিছুদিন আগে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করেছেন। হারিয়ানাতে এটা সম্ভব নয় যে, তৃণমূল কংগ্রেস গিয়ে সেখানে নির্বাচনে লড়বে আর জিতে যাবে। তাহলে হারিয়ানার একজন রাজনীতিককে দলে টানার কারণ কী? এর পেছনেও সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। অশোক তানবার কিছুদিন আগে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে নিজের আলাদা দল গঠনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে সময় বিভিন্ন রাজ্যের রাজনৈতিক দলের নেতারা তাকে সমর্থন করেন। যারা অশোক তানবারকে নিজেদের আলাদা দল তৈরি করতে সমর্থন করেছিলেন, তাদের মধ্যে ত্রিপুরার একজন রাজনীতিবিদও ছিলেন। যিনি অশোক তানবারের অত্যন্ত কাছের একজন বন্ধু। তিনি হলেন ত্রিপুরার কিরীট প্রদ্যোত মাণিক্য দেববর্মন। যার নিজের দল রয়েছে ত্রিপুরাতে। অনেকেই মনে করছেন যে, তৃণমূল কংগ্রেসকে যদি ত্রিপুরায় নিজের জায়গা তৈরি করতে হয়, তাহলে এই প্রদ্যোত মাণিক্য দেববর্মনের টিপরা মোথার সমর্থন অবশ্যই দরকার হবে। তৃণমূল কংগ্রেসকে ত্রিপুরাতে জায়গা করার জন্য যদি প্রদ্যোত মাণিক্য দেববর্মনের সমর্থন চাইতে হয়, সে ক্ষেত্রে তার বন্ধু হারিয়ানার অশোক তানবার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবেন।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বারবার অভিযোগ করা হচ্ছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের পেট কেটে ফেলছেন এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি বিরোধীদের দুর্বল করে মোদির হাত শক্ত করছেন। আর এসব বলার মধ্য দিয়ে কংগ্রেস নিজের দুর্বলতাই বারবার প্রকাশ করছে। কংগ্রেস এ মুহূর্তে প্রচণ্ড দুর্বল একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বিজেপি ইতিমধ্যে কংগ্রেসকে ফুটো করতে শুরু করেছিল, আম আদমি পার্টি এবং তৃণমূল কংগ্রেস বিভিন্ন রাজ্যে সেই কাজটাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু এ বিষয়টাকে আটকানোর জন্য কংগ্রেসের তরফ থেকে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মুকুল সাংমার কথা। আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল যে, কংগ্রেসে মুকুল সাংমা ভালো নেই। তিনি তৃণমূল কংগ্রেসে চলে যেতে পারেন। অথচ কংগ্রেস হাই কমান্ডের টনক নড়েনি। মুকুল সাংমাকে কথা বলার জন্য দিল্লিতে তলব করা হয়; কিন্তু তার সঙ্গে কোনো কেন্দ্রীয় নেতা বা প্রতিনিধি দেখা পর্যন্ত করেননি। একের পর এক নেতা কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, তারা কিছুই করছে না সেভাবে। তারা ২০২৪ সালে কার অধীনে এক জোট হয়ে লড়াই করব, সেই চিন্তায় মশগুল। বিজেপিতে যাওয়ার জায়গা নেই এবং মুকুল সাংমা যখন কংগ্রেস ছেড়ে বেরিয়ে যান, প্রশান্ত কিশোর সেখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছিলেন। একইভাবে বিভিন্ন জায়গায় আম আদমি পার্টি কংগ্রেসের ভেতর থেকে পেট কেটে লোকজন নিয়ে চলে যাচ্ছে; কিন্তু কংগ্রেসের যেন তাতে কিছু যায় আসে না! বিজেপি অলরেডি বুলডোজার দিয়ে কংগ্রেসের সরকার ফেলে রাতারাতি একই বিধায়কদের নিয়ে নিজের সরকার গঠন করেছে–এমন উদাহরণও একাধিক রাজ্যে দেখা গেছে। এবারও যদি কংগ্রেস নড়েচড়ে না বসে, তাহলে আম-আদমি পার্টি এবং তৃণমূল কংগ্রেস বাকি কাজটা করে দেবে।
প্রশান্ত কিশোর প্রসঙ্গ
বর্তমানে ভারতের রাজনীতিতে সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত নাম প্রশান্ত কিশোর। ১৯৭৭ সালে বিহারের রোহতাস জেলার কোরান গ্রামে জন্ম নেওয়া এই ব্যক্তি পেশায় একজন ভোট কৌশলী বা ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট। তবে নিজেকে ভোটকুশলীর পরিবর্তে রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন ৪৫ বছর বয়সী প্রশান্ত কিশোর। জনস্বাস্থ্য কর্মী হিসেবে তার প্রাতিষ্ঠানিক কাজের শুরু। পরে কাজ করেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায়। সরাসরি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা না রাখলেও নরেন্দ্র মোদির উত্থান-পর্বে প্রধান কারিগর ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। আবার মোদির কট্টর সমালোচক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়েও কাজ করেছেন তিনি। তার হাত ধরেই সর্বশেষ মে মাসের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় জয় এসেছে মমতার। প্রশান্ত কিশোরের এই সাফল্যের যেমন প্রশংসা হয়েছে, তেমনি নিন্দিতও হয়েছেন তিনি।
২০১০ সালের কথা। প্রশান্ত কিশোর তখন আফ্রিকায় ইউনিসেফে কর্মরত। ভারতের পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোর স্বাস্থ্য খাতের বেহাল নিয়ে একটি চিঠি লিখলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বরাবর। সেই চিঠি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কাড়তে পারেনি। তবে এর একটি কপি পেয়ে পিকের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। চিঠিতে গুজরাটের স্বাস্থ্য খাতের সমালোচনা করা হলেও মোদি দেখেছিলেন ভিন্ন কিছু। তিনি পিকের সাথে দেখা করতে চান। ২০১১ সালের অক্টোবরে মোদির সাথে প্রশান্তের সাক্ষাৎ হয় এবং মোদি তাকে নিজের সোশ্যাল সেক্টর পলিসি অ্যাডভাইজার হিসেবে নিয়োগ দেন। ২০১২ সালে গুজরাটের বিধানসভার নির্বাচনের প্রচারণা ও কৌশল নির্ধারণের মূল ক্রীড়ানক ছিলেন পিকে। ২০০১ সাল থেকেই গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদি। তবে কথিত উন্নয়নের নামে যে প্রচারণা ছিল, এর বিপরীতে ছিল ২০০২ সালে গুজরাটে সাম্প্রদায়িক হিংস্রতার আখ্যান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মিডিয়াকে টার্গেট করে প্রচারণা চালানো হয়। এর ফল পাওয়া যায় হাতেনাতে। গুজরাটে আরও একবার মুখ্যমন্ত্রী হন মোদি। এবার সমর্থন ছাড়িয়ে যায় রাজ্যের গণ্ডি।
২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগেই টালমাটাল অবস্থা ছিল কংগ্রেসের। সেখানে মোদিকে কেন্দ্র করে একইরকম প্রচারণা শুরু করা হয়। বিজেপির ভেতরে মোদিবিরোধী আডবানির অংশটিকে কোণঠাসা করে ফেলা হয়। এই পুরো গেমপ্ল্যানের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন পিকে এন্ড কোং। এরপর মূলধারার প্রায় সব মিডিয়া–খেলা থেকে বিনোদনের চ্যানেল বা খবরের চ্যানেলের প্রাইমটাইম–সব স্লটেই ছিল–‘আব কি বার মোদি সরকার’-এর প্রচারণা। প্রশ্ন তোলা হতে থাকে–মোদির বিকল্প কে? সেই সঙ্গে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী সম্পর্কে কুৎসা এবং তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়ে থাকে টকশো থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যন্ত। এই প্রচার কৌশলকেই ভারতের কেন্দ্রে মোদির ক্ষমতায় আসার মূল কারণ বলে মনে করা হয়।
এ প্রসঙ্গে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রাভীশ কুমার বলেন, ‘মোদিকে গুজরাট থেকে দিল্লির মসনদে তুলে আনার পেছনে অনেকের হাত রয়েছে, অনেকের পয়সা খরচ হয়েছে। তবে এর পেছনে যে মানুষটির মাথা রয়েছে, তিনি প্রশান্ত কিশোর।’
লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে সিটিজেনস ফর অ্যাকাউন্টেবল গভরন্যান্স (সিএজি) নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এই কথিত অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে ভারতের প্রখ্যাত আইআইটি ও আইআইএমের পেশাদার বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এর মধ্যে অনেকের বিশ্বখ্যাত থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। সিএজিকে স্বাধীন নীতিনির্ধারণী বা থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করা হলেও এর কাজ ছিল নির্বাচনকে মোদির অনুকূলে নিয়ে আসতে নীতিনির্ধারণ করা। ভারতের মোট ১৫টি রাজ্যে সিএজি সফলভাবে মোদির প্রচারণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। প্রায় পাঁচ লাখ স্বেচ্ছাসেবী সংগ্রহ করে তাদের অনেককেই বেতনভুক্ত করেছিল। সাম্প্রদায়িক প্রপাগান্ডা চালাতে বিজেপির যে আইটি সেল গড়ে উঠে, কার্যত এর মূল চিন্তকও এই প্রশান্ত কিশোর।
তবে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে প্রশান্তের দূরত্ব বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে মোদির সঙ্গ ছাড়েন তিনি। তখন সিএজিকে পরিবর্তন করে গড়ে তোলেন ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি (আইপ্যাক)।
২০১৫ সালে প্রশান্ত বিহারের বিধানসভা নির্বাচনে মনোনিবেশ করেন। এবার জনতা দলের (জেডিইউ) প্রধান এবং বিহারের দুবারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার তৃতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রশান্তের দ্বারস্থ হন। আইপ্যাক নীতিশের সঙ্গে কাজ করার আগে তার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা ছিল না। পিকের ছোঁয়ায় রাতারাতি বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি।
প্রথমে বিহারের ভোটারদের ঘরে ঘরে, এরপর পঞ্চায়েত, ব্লক লেভেল ও সবশেষ জেলা পর্যায়ে প্রচারণা চালানো শুরু হয়। সেই সঙ্গে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ায় প্রচারণা চলতে থাকে। ভাড়া করা স্ক্রিপ্ট রাইটাররা নীতিশের ভাষণ ঠিকঠাক করে দিতেন। যেমনটা হয়েছিল মোদির ক্ষেত্রে। নীতিশ কুমার বড় সাফল্য পান। তবে এতেও সরকার গঠন সম্ভব ছিল না। নীতিশ কুমারের দল জেডিইউ লালু প্রসাদের আরজেডির সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করে। মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেন নীতিশ। প্রশান্তকে জেডিইউর সহ-সভাপতির পদে বসান নীতিশ। যদিও বিজেপির সঙ্গে জোট ও নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভিন্নতার কারণে দল ছাড়েন পিকে।
এরপর ২০১৬ সালে পাঞ্জাব ও উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য প্রশান্ত কিশোর ও তার দলকে ভাড়া করে কংগ্রেস। পাঞ্জাবে খাদের কিনারা থেকে নির্বাচনে জিতে গেলেও উত্তরপ্রদেশে ভরাডুবি হয় কংগ্রেসের। ২০১৭ সালে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন পিকে; কিন্তু তার পরামর্শ না শোনায় নির্বাচনের মাঝপথেই কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয় প্রশান্তের।
২০১৭ সালের মে থেকে অন্ধ্রপ্রদেশে স্থানীয় রাজনৈতিক দল ওয়াইএসসিআরপি'র দল প্রধান জগমোহন রেড্ডির পক্ষে কাজ করেন প্রশান্ত কিশোর। টানা দুই বছর ধরে কাজ করে রেড্ডিকে বিপুল সাফল্য এনে দেন তিনি। সেখানকার বিধানসভা নির্বাচনে ১৭৫টি আসনের মধ্যে দেড় শতাধিক আসন পেয়েছে ওয়াইএসসিআরপি। বিধানসভার পর লোকসভা নির্বাচনেও সাফল্য পেয়েছে জগমোহনের দল। সারাদেশে বিজেপি বিপুল সাফল্য পেলেও অন্ধ্রপ্রদেশে সুবিধা করতে পারেনি। সেখানকার ২৫টি আসনের মধ্যে ২৩টি আসন পেয়েছে রেড্ডি দল।
২০২০ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে যে সাম্প্রদায়িক আবহ চলছিল, অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন যে, সেখানে হয়তো বিজেপিই ক্ষমতায় আসছে। তবে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনদের সেই আশা গুঁড়েবালি করার পেছনেও মূল কারিগর ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। আর ২০১৯ সাল থেকেই পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন প্রশান্ত কিশোর। সঙ্গে ছিল তার সংগঠন আইপ্যাক।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের পর প্রশান্ত কিশোর একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন। ৪৪ বছর বয়সী এই পরামর্শক বলেছিলেন, ‘আমি দায়িত্ব ছেড়ে দিচ্ছি। আমি এবার অন্য কিছু করতে চাই।’ কিন্তু সম্প্রতি আবারও আলোচনায় এসেছেন প্রশান্ত কিশোর। কারণ, কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীসহ বিভিন্ন দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিচক্ষণ এ ভোটকুশলী। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপিবিরোধী একটি জোট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। প্রশান্ত কিশোরের ভাষ্য, সবই জল্পনা। তিনি বলেন, ‘আমি অবশ্যই এমন কিছু করব না, যেটা আমি আগে করেছি। আমরা কাছে অল্প কিছু বিকল্প সুযোগ আছে। কিন্তু আমি এখনো সিদ্ধান্ত নিইনি। এমনটা হতে পারে, আমি এমন কিছু করছি, যার সঙ্গে সরাসরি রাজনীতি নেই। আমি এই সিদ্ধান্ত নিলে আনুষ্ঠানিকভাবে তা জানাব।’
গত ২৪ জানুয়ারি (সোমবার) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আগামী লোকসভা নির্বাচন সম্পর্কে প্রশান্ত কিশোরের মত, বিজেপিকে হারানো সম্ভব। তবে এখন যে নেতারা চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন, তাদের দিয়ে সম্ভব না। তবে চলতি মাসে হওয়া পাঁচ বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে খুব বেশি প্রভাবিত করবে না বলেই মনে করেন তিনি।
প্রশান্ত কিশোর বলেন, এটা খুবই সম্ভব যে, বিজেপি এ দফায় সবকিছুতে জিতেছে এবং এরপরও ২০২৪ সালের নির্বাচনে হারতে পারে। ২০১২ সালে উত্তর প্রদেশের ভোটে জিতেছিল সমাজবাদী পার্টি (এসপি); উত্তরাখণ্ড ও মণিপুরে জিতেছিল কংগ্রেস, পাঞ্জাবে জিতেছিল আকালি দল। এরপরও ২০১৪ সালের ফলাফল ছিল খুব ভিন্ন।
২০২৪ সালের নির্বাচনে বিজেপিকে হারানোর কৌশল কেমন হতে হবে, তার একটি নীলনকশা তুলে ধরেছেন প্রশান্ত কিশোর। তিনি বলেন, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু ও কেরালায় সব মিলিয়ে আনুমানিক ২০০টি লোকসভা আসন রয়েছে। বিজেপি জনপ্রিয়তার চূড়ায় থাকার সময় এর মধ্যে মাত্র ৫০টির আসনে জিতেছিল। এই ২০০ আসন বাদ দিলে বাকি থাকে ৩৫০টি আসন। এর মধ্যে বেশিরভাগ আসনেই জেতার সামর্থ্য রাখে বিজেপি।
যদি কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, অন্যান্য দল অথবা এসব দল যদি নিজেদের মধ্যে একটি জোট গঠন করে এবং তাদের হাতে থাকা সব শক্তি ও কৌশল কাজে লাগিয়ে এর মধ্য থেকে ১০০ বা ২০০ আসন বের করে আনতে পারে, তাহলে বিরোধীরা ২৫০ থেকে ২৬০ আসনে জিততে পারবে। এ ছাড়া উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে আরও ১০০টি আসনে জয়ের মাধ্যমে বিজেপিকে হারানো সম্ভব জানিয়ে প্রশান্ত কিশোর বলেন, ‘আমি এমন একটি বিরোধী জোট গঠনে সাহায্য করতে চাই, যেটি ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করতে পারবে।’
প্রশান্ত বলেন, হিন্দুত্ব, উগ্র জাতীয়তাবাদ ও জনকল্যাণের মতো ইস্যুগুলো ব্যবহার করে বিজেপি সমীহ জাগানোর মতো একটি রাজনৈতিক আখ্যান তৈরি করেছে। এগুলোই দলটির শক্তির ভিত্তি। বিজেপিকে হারাতে চাইলে কথিত মহাজোট গঠন ছাড়াও এ তিনটির মধ্যে অন্তত দুটি বিষয়ে বিজেপির চেয়ে এগিয়ে যেতে হবে বিরোধীদের।
ভোটে জেতার উপায় বাতলে দিয়ে প্রশান্ত কিশোর বলেন, বিহারে ২০১৫ সাল থেকে কোনো একটি মহাজোট কিন্তু সফল হতে পারেনি। শুধু দল ও তাদের নেতাদের একজোট হওয়াই যথেষ্ট নয়; এ জন্য বিশেষ এক অবস্থান তৈরির জন্য একধরনের আখ্যান থাকা প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে নিজেদের সুসংহতও হবে।
ভারতের লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে প্রায় ২০০ আসনের ইস্যুটিকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে তুলে ধরেন প্রশান্ত কিশোর। এসব আসনে মূলত বিজেপি ও কংগ্রেসের দ্বিমুখী লড়াই দেখা যায়। বিজেপি গত দুটি নির্বাচনে এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ আসনে জিতেছিল। অর্থাৎ ১৯০ আসনে জিতেছিল বিজেপি; যদিও এসব আসন ছিল দোদুল্যমান। একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে এসব আসনে এগিয়ে যায় বিজেপি এবং শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের থেকে জয় ছিনিয়ে নেয়।
প্রশান্ত কিশোর বলেন, ‘যেসব দল ও নেতা বিজেপিকে হারাতে চায়, তাদের টানা ৫ থেকে ১০ বছর ধরে কাজ করতে হবে। এটা পাঁচ মাসে সম্ভব নয়। আবার এটা হতেও পারে, কারণ এটাই তো গণতন্ত্রের শক্তি।’
তৃণমূলের লক্ষ্য ‘প্যারালাল ক্যাপিটাল’
তৃণমূল কংগ্রেস এবার বিভিন্ন রাজ্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তার পেছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থাকলেও, একটা বড় হাত যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রয়েছে সেটি খুবই স্পষ্ট। নির্বাচনে সাহায্যের জন্য প্রশান্ত কিশোরকে নিয়ে আসা, ২০২৬ পর্যন্ত আইপ্যাককে বুক করে রাখা, ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাজ্যে ঢোকার চেষ্টা করা, এগুলোর পেছনে কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা বড় হাত রয়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই অভিষেক নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন। তৃণমূল কংগ্রেস নিরঙ্কুশ জয়লাভ করার পর অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই গুরুত্ব আরও বেড়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক পারদর্শিতা অনস্বীকার্য। কিন্তু এর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেসকে বিভিন্ন রাজ্যে ঢুকানোর চেষ্টা করেছেন এবং সেখানে হোঁচট খেয়েছেন। এবারের চেষ্টায় যাতে সে হোঁচটটা না খাওয়া হয়, তার দায়িত্ব। তারই সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসে রূপ আগামীতে কিরকম হবে, সে দায়িত্ব কিন্তু অনেকটাই তার কাঁধে তুলে নিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু প্রশ্ন যেটা রয়ে যায়, সেটা হচ্ছে তাহলে ২০২৪-এ কি তৃণমূল কংগ্রেসের টার্গেট? দিল্লিতে দিদিকে চাই এরকম স্লোগান চারদিকে শোনা যাচ্ছে বটে, তার কোনো সম্ভাবনা রয়েছে বলে খাতা-কলমে এখনও পর্যন্ত কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিজেপিকে তলিয়ে দিয়ে একেবারে গদি থেকে ফেলে দিতে পারবে, এ মুহূর্তে এরকম কোনে গেইম প্ল্যান এখনও সামনে আসেনি। এরকম কোনো ফর্মূলা বিরোধীরা পেয়েছে, তার কোনো অভিযোগ এখনও বিরোধীরা পাইনি। তাই আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে হতে পারে যে, দিল্লিই টার্গেট কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের মূল টার্গেট হলো উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো। মূল লক্ষ্য হলো, উত্ত-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতে বিজেপিকে আটকে দেওয়া। সেখানে তৃণমূল কংগ্রেস যদি কোনোভাবে নিজেকে একটু ঢুকিয়ে দিতে পারে, তাহলে গোটা উত্তর ভারতের পলিটিক্যাল রিজনালে একটা টার্গেট ‘প্যারালাল ক্যাপিটাল’ তৈরি হবে কলকাতায়। কলকাতা হবে মূল ঘাঁটি। আর সেখান থেকে তৃণমূল কংগ্রেস উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য অপারেট করবে।
এর আগে বিজেপিও কিন্তু একই কাজ করেছিল। বিজেপিও উত্তর-পূর্ব ভারতে একটা একটা করে রাজ্যগুলো নিজেদের দখলে নিয়েছিল। বিজেপির আগে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোকে কোনো দলই সেভাবে রাজনৈতিক প্রাধান্য দেয়নি। বিজেপিই প্রথমে বুঝতে পারে যে, এখানে একটা পলিটিক্যাল পটেনশিয়াল রয়েছে। সেটাকে ধরে তারা ধীরে ধীরে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতে নিজেদের ভিত্তি গড়ে তোলে। তবে সমস্যাটা হলো–যখন বড় বড় ন্যাশনাল এজেন্ডার কথা আসে, তখনই বিজেপিকে লোকসভার বেশি আসন আছে, অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রের দিকে তাকাতে হয়। তবে উত্তর-পূর্ব ভারতের এজেন্ডা এমদমই ভিন্ন। উগ্র-জাতীয়তাবাদ বা হিন্দুত্ব উত্তর-পূর্ব ভারতে সেভাবে কাজ করে না। হিন্দু-মুসলিম সমস্যা উত্তর-পূর্ব ভারতে কাজ করে না। তবে উত্তর-পূর্ব ভারতে নিজস্ব কিছু কমিউনিটির মধ্যে সমস্যা আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়–আসামে আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং বাংলাভাষীদের মধ্যে একটা সমস্যার কথা অথবা রাজ্যগুলোর সীমানা নির্ধারণ নিয়ে সমস্যার কথা। তবে সেখানে কিন্তু গোরক্ষার ইস্যু নেই। উত্তর-পূর্ব রাজ্যের প্রায় সবাই মাংসাশী। আপনি খুঁজলেও হয়তো নিরামিষী খুঁজে পাবেন না। কাজেই গোবলয় বলতে আমরা ভারতের যে অংশটাকে বুঝি, সেখানে বিজেপির একটা শক্ত ভিত্তি রয়েছে; তার সঙ্গে কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনীতি একেবারেই আলাদা। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজনীতির একটা আলাদা পরিসর রয়েছে।
সবশেষে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো–যদি আমরা ধরে নিই, প্রধানবিরোধী দল হওয়াটাই তৃণমূল কংগ্রেসের লক্ষ্য এবং যদি ধরে নেওয়া হয়, তারা প্রধান বিরোধী দল হয়ে গেল, তারপর তারা সেখান থেকে এগোবে কী করে? বিজেপিশাসিত প্রায় সবগুলো রাজ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও প্রশাসনকে ব্যবহার করা হচ্ছে যথেচ্ছভাবে। গণআন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে প্রচারণা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিন্দুত্ব, জাতীয়তাবাদ, জনকল্যাণ–বিজেপির এই তিন ইস্যুকে টার্গেট করে বিজেপিবিরোধী মহাজোট গঠন করতে ছাড় দিতে হবে সব দলকেই। এ ছাড়া ভোটের মাঠে বিজেপি তথা মোদির ইমেজের সামনে এককভাবে কেউ দাঁড়াতে পারবে না।
মব লিঞ্চিংয়ের ঘটনাগুলো এখন হয়ত ব্যাপক অর্থে এসেছে। তবে এটি এবারই প্রথম হচ্ছে না। ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় এর শেকড় রয়েছে বহু আগে থেকেই। ভারতে সেন্সাস অনুসারে, প্রতি ১৬ মিনিটে একজন নারী ধর্ষণের শিকার হন। প্রতি আধঘণ্টায় একজন দলিত নির্যাতিত হন। এটা শুধু বিজেপি ক্ষমতায় আছে বলেই হয়নি। এটা আগেও হতো, এখনো হচ্ছে। এটি ভারত রাষ্ট্রের পুরো রাজনৈতিক কাঠামোর বিষয়। যার ফলে আদিবাসী, দলিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ওই কাঠামো দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। বাম ফ্রন্ট, কংগ্রেস, বিজেপি, বা তৃণমূল কংগ্রেস–তাদের সবার মূল চালিকাশক্তি কিন্তু উচ্চবর্ণ। তাদের কর্মী দলিত হতে পারেন; কিন্তু তাদের পার্টির নীতিনির্ধারকরা সবাই উচ্চবর্ণের। তার মানে, একটি উচ্চবর্ণের দলকে সরিয়ে অন্য একটি উচ্চবর্ণের দল ক্ষমতায় আসছে। তাদের মাঝে কিছু তফাৎ আছে–কেউ খানিকটা গণতান্ত্রিক, কেউ কম গণতান্ত্রিক, কেউ গণতান্ত্রিক নয়; কিন্তু মৌলিক কোনো পরিবর্তন যে এর মধ্য দিয়ে হচ্ছে না–এটি হলফ করেই বলে দেওয়া যায়।
এসএ/