গণতন্ত্রের প্রতীক থেকে অস্পৃশ্য সু চি!
মিয়ানমারের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের 'মূর্ত প্রতীক' ছিলেন অং সান সু চি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় অহিংস সংগ্রামের নজির স্থাপনের জন্য ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পান তিনি। কয়েক মেয়াদে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দী ছিলেন তিনি। সেই অং সান সু চি ২০১৭ সালে দেশটির রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে নিজের অবস্থানের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি হন। রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো নির্যাতন অস্বীকার করে হারান নোবেল।
২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পান সু চি। ধারণা করা হচ্ছিল এবার বুঝি মিয়ানমারে গণতন্ত্র আসবে। সু চির হাত ধরে তার দেশে মানবাধিকার সমুন্নত হবে। ধীরে ধীরে গণতন্ত্রের পথে হাঁটবে মিয়ানমার। দেশটিতে শান্তি-স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে এমনটাই আশা ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের।
এরপর ২০১৫ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল জয় পায়। ২০১৬ সালের শুরুর দিকে দলটি ক্ষমতা নেয়। সাংবিধানিক বিধিনিষেধের কারণে প্রেসিডেন্ট হতে ব্যর্থ হন সু চি। এই পদে তিনি তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী থিন কিউকে বসান। সু চি নিজে হন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কার্যত সু চিই সরকার চালান। আর মিয়ানমারে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন আনার পরিবর্তে সেনাবাহিনীর সঙ্গে অনেকটা মানিয়ে চলেন সু চি। সেনাবাহিনীর অবস্থানের বিরুদ্ধে যায়, এমন কাজ থেকে বিরত থাকে তার সরকার।
আর ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে আবারও সু চির দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে, কারচুপির অভিযোগ এনে, সে নির্বাচন বানচাল করে সামরিক জান্তা। চলতি বছর ১ ফেব্রুয়ারি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। গ্রেফতার করা হয় অং সান সু চিসহ তার দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) শীর্ষ নেতাদের।
সেনা হেফাজতে নেওয়ার চার মাস পর গত জুনে বিচার শুরু হয় সু চির। সেনাবিরোধী উসকানি, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন ভঙ্গসহ তার বিরুদ্ধে ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছে।
আজ সোমবার( ৬ ডিসেম্বর) মিয়ানমারের একটি আদালত করোনা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ ভঙ্গ ও সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ এনে অং সান সু চিকে চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। সু চির বিরুদ্ধে দায়ের করা ১১ মামলার মধ্যে এদিন দুটি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। তার বিরুদ্ধের এ পর্যন্ত হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে প্রথম রায় ঘোষণা হলো আজ। সু চির বিরুদ্ধে হওয়া সবগুলো মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তার ১০৪ বছরের বেশি কারাদণ্ড হতে পারে।
সু চির পাশাপাশি আটক থাকা এনএলডির অন্য সদস্যদেরও বিচার চলছে। গত মাসের শুরুতে সাবেক একজন মন্ত্রীকে ৭৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সু চির এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে দেওয়া হয়েছে ২০ বছরের কারাদণ্ড।
রাজধানীর নেপিদোতে বিশেষ সেনা আদালতে সু চির বিচারকাজ চলছে। সেখানে সাংবাদিকদের প্রবেশের অনুমতি নেই। সু চির আইনজীবীরাও সংবাদমাধ্যমে কথা বলতে পারেন না।
৪ বছরের সাজা পাওয়া সু চির আরও মামলার রায় বাকি। মামলাগুলোর রায়ে সু চির ১০৪ বছর সাজা হলে আমৃত্যু কাটাতে হবে জেলে। সু চির গণতন্ত্রের আন্দোলন, গৃহবন্দীত্ব থেকে দেশ পরিচালনা সমস্ত দায়িত্বের অবাসান কি তবে শেষ হবে ১০৪ বছরের সাজায়?
সু চি ও মিয়ানমার
মিয়ানমারের স্বাধীনতার নায়ক জেনারেল অং সানের মেয়ে অং সান সু চি। তার যখন দুই বছর বয়স তখন তার বাবাকে হত্যা করা হয়েছিল। ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে বার্মা (বর্তমানে মিয়ানমার)। তার মাত্র দুই বছর পর এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।
স্বাধীনতা লাভের মাত্র ১৪ বছর পরে অভ্যূত্থানের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতা দখল করেন সামরিক নেতা নে উইন। তিনি বেসামরিক রাজনৈতিক নেতাদেরকে রাজনৈতিক প্রশাসনিক অঙ্গন থেকে দূরে সরিয়ে দিয়ে সামরিক জান্তার মাধ্যমে বহু বছর ধরে দেশটি শাসন করেন।
১৯৮৮ সালে সু চি বিদেশ থেকে দেশে ফিরে এসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংগ্রাম শুরু করেন। এই আন্দোলন দমনের জন্য ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার গুলি চালিয়ে শতাধিক বিক্ষোভকারী নেতা-কর্মীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৯৮৯ সালের জুলাই মাসে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সাহসী স্পষ্টভাষী সমালোচক বলে দেশে-বিদেশে পরিচিতি পাওয়া অংসাং সু চিকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতাসীন সামরিক সরকার।
১৯৯১ সালে সু চিকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। তার এই সন্মান লাভ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গৌরবান্বিত করা হয় একই সাথে আবার মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের প্রতিদ অনাস্থাও প্রকাশ করা হয়।
২০১০ সালের ৭ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত মিয়ানমারের প্রথম গণতান্ত্রিক পদ্ধতির নির্বাচনে জান্তাপন্থী একটি দল জয়লাভ করে। তবে সে ভোটে ব্যাপক কারচুপি ও পক্ষ পাতিত্বমূলক বলে বিস্তর অভিযোগ উত্থাপিত হলে সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্যাসি ঐ ভোট বর্জন করে।
২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর তারিখে দুই দশকেরও বেশী একটানা আটক থাকার পর এনএলডি প্রধান অং সাং সু চিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
২০১২ সালে সু চি একটি উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে বিজয়ী হন এবং জীবনে প্রথম বারের মত সংসদে আসন গ্রহণ করার সুযোগ পান।
২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু সে দেশের সামরিক শাসকদের তত্ত্বাবধানে অনুমোদিত সংবিধানের অধীনে সেনারা তাদের হাতে ক্ষমতা ধরে রাখতে সু চিকে প্রেসিডেন্ট হতে দেয় নি। তখন সরকারের নেতৃত্ব প্রদানের জন্য সু চির দাবি আংশিক মেনে নিয়ে তার জন্য ষ্টেট কাউন্সিলার নামে নতুন পদ তৈরী করা হয়।
২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট বিদ্রোহীরা পশ্চিামঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যের সামরিক ফাঁড়িতে হামলা চালায়। এতে সামরিক বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য নিহত হয়। এর প্রতিক্রিয়া সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর বেপরোয়া ধ্বংস যজ্ঞ চালায়। এর পর প্রায় সাত থেকে দশ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আত্মরক্ষা করে।
২০১৯ সালের ১১ ডিসেম্বর হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারে গণহত্যা চালানো এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেশত্যাগ বাধ্য করার প্রতিবাদে গাম্বিয়া কর্তৃক দায়েরকৃত মামলার শুনানীতে হাজির হয়ে সু চি, গণহত্যা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেন। ফলে তিনি বিশ্বব্যাপী নিন্দার পাত্রে পরিণত হন। এক পর্যায়ে নোবেল কমিটি সূ চিকে প্রদত্ত নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রত্যাহার করে নেন।
২০২০ সালের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে। তবে ২৯ জানুয়ারি সামরিক শাসক ভোটে কারচুপির অভিযোগ এনে নির্বাচন বানচাল করে দেয়।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সু চিকে আবারও গৃহবন্দী করে সামরিক বাহিনী এবং এক বছরের জন্য দেশটিতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণ নেয়।
কেএফ/