‘আমার শরীর আছে, কিন্তু প্রাণ নেই’
ইসরাইলি হামলায় গাজায় এক পরিবারের ২১ ফিলিস্তিনি নিহত
২০১৯ সালে তোলা এই ছবির সমস্ত বাচ্চাদের মধ্যে, সামনের দুটি ছেলেই বেঁচে আছে - ছবি : সংগৃহীত
আহমেদ জেগে উঠলেন ভোর ৪টার সময় । স্বাভাবিকভাবে এই সময়ে গভীর ঘুমে থাকলেও এবার তার মনে হচ্ছিল কিছু একটা ঠিক নেই।যুদ্ধের শুরু থেকেই মনোযোগ দিয়ে তার পরিবারের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চেক করে আসছেন লন্ডনে বসবাস করা আহমেদ। ইসরাইল গাজায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার পর থেকেই তার বাবা এবং ভাই-বোনদের সাথে যোগাযোগ করা কঠিন ছিল। কিন্তু দুই দিন আগে তার বোন ওয়াল্লাহর কাছ থেকে একটি বার্তা আসে।
বোমায় তার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ‘বাড়ির ভেতরের জানালা এবং দরজা সব ভাঙ্গা ছিল,’ ওয়াল্লাহ গ্রুপে লিখেছেন। ‘কিন্তু জরুরি বিষয় হলো সৃষ্টিকর্তা আমাদের রক্ষা করেছেন। আমরা সবাই ভালো আছি।’
আহমেদ উত্তরে লিখলেন, ‘বাড়ি ঠিক করা যাবে, গুরুত্বপূর্ণ হলো তুমি নিরাপদ আছো।’
ওয়াল্লাহ আর তার চার সন্তান গাজার মাঝখানে দেইর আল-বালাহতে তাদের বাবার বাড়িতে চলে যান।
সেই রাতে আহমেদ যখন জেগে ওঠেন তার পরিবারের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপটি একেবারে শান্ত ছিল। তিনি আরো বেশ কিছু লোকের বার্তা দেখতে পান, যা পাঠানোর পর মুছে ফেলা হয়েছে।
তিনি গাজায় একজন বন্ধুকে ফোন করেছিলেন কী হচ্ছে তা জানার জন্য। তিনি জানতে পারেন তার পরিবারের সবাই মারা গেছে।
যুদ্ধের শুরু থেকেই আহমেদ এবং তার গাজার ফ্ল্যাটমেটরা জাহান্নামের মতো একটি অবস্থায় আছেন। তাদের ফোন ধ্বংস আর মৃত্যু খবরের ভান্ডার হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিন তাদের জানানো হয় প্রতিবেশী, বন্ধু বা যার সাথে তারা স্কুলে গিয়েছিল তাদের মধ্যে কেউ না কেউ মারা গেছে। কিন্তু তিনি কখনোই ভাবেননি যে এই যুদ্ধ সরাসরি তার পরিবারের দিকে আসবে।
তাদের বাড়ি দেইর আল-বালাহর মাঝখানে এমন এক এলাকায় যা আগে কখনও লক্ষ্যবস্তু হয়নি।
‘আমি ভেবেছিলাম, এটি তাদের জন্য কঠিন সময় কিন্তু তারা সবাই ঠিক থাকবে,’ বলেন তিনি। ‘আমি এটাই ভেবেছিলাম।’
বিমান হামলায় যখন তাদের বাড়িটি ভেঙে পড়ে তখন সব মিলিয়ে ২১ জন মানুষ মারা গেছে, যাদের মধ্যে ছিল আহমেদের বাবা, তার তিন বোন, দুই ভাই এবং তাদের ১৫ জন সন্তান। নিহতদের তালিকা এতটাই দীর্ঘ ছিল যে তার পরিবারের নিহত প্রতিটি ব্যক্তির নাম ও বয়স বলার সময় তিনি বারবার আটকে যাচ্ছিলেন। শিশুদের মধ্যে তার ১৩ বছর বয়সী ভাতিজা ইসলাম ছিল সবচেয়ে বড়। তাকেই আহমদ সবচেয়ে বেশি চিনতেন। আহমেদের ৯ ভাইবোনের মধ্যে কেবল তিনি আর তার দুই বোন বেঁচে আছেন।
হামলার পরের দিনগুলোতে তিন বছর বয়সী ওমরসহ প্রতিটি শিশুর ছবি অনলাইনে পোস্ট করেন আহমেদ। এরপর তার বোনের কাছ থেকে ফোন আসার পর তিনি জানতে পারেন ওমর বেঁচে আছে। ‘এটি আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্ত ছিল,’ বলেন তিনি।
বোমা পড়ার সময় ওমর তার মা শিমা ও বাবা ও মুহাম্মদের সাথে বিছানায় ছিলেন। মুহাম্মদ নিহত হলেও অলৌকিকভাবে বেঁচে যান শিমা ও ওমর। জীবিত উদ্ধার করা অন্যজন আহমেদের ১১ বছর বয়সী ভাতিজি মালাক। তার শরীরের ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
আমি যখন আহমেদের সাথে দেখা করি তিনি আমাকে হাসপাতালে মালাকের একটি ছবি দেখান। তার পুরো শরীর ব্যান্ডেজে ঢাকা ছিল। চুল ছোট থাকায় প্রথমে আমি তাকে ছেলে ভেবেছিলাম। আহমেদ বলল, আগে অনেক লম্বা ছিল, নিশ্চয়ই আগুনে পুড়ে গেছে।
হামলার সময় মালাকের বাবা বাড়িতে না থাকায় তিনি বেঁচে যান। কিন্তু তার স্ত্রী ও আরো দুই সন্তান মারা গেছে। আহমেদ যখন তাকে মেসেজ করে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করার পর তিনি উত্তরে লিখেছেন, ‘আমার শরীর আছে, কিন্তু প্রাণ নেই।’
ইসরাইল আক্রমণ বাড়ানোয় সেই সময় গাজা থেকে ফোনের সিগন্যাল সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আহমেদ কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি। দুই দিন পর আবার সিগন্যাল পেলে তিনি জানতে পারেন মালাকের মৃত্যু হয়েছে।
চিকিৎসাসামগ্রী কমে যাওয়ায় ও আরো জরুরি কেস আসায় তাকে আইসিইউ ইউনিট থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে হয়। সে অনেক ব্যথায় ভুগছিল। তিন সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং শেষের জনের মৃত্যু দেখে তার বাবা আহমেদকে জানান, ‘আমি প্রতিদিন এক শ’ বার মারা যাচ্ছি।’
যোগাযোগ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবার ঠিক আগে আহমেদ জানতে পারেন তার মামার বাড়িতেও হামলা হয়েছে। সেখানে কারা নিহত হয়েছে সে বিষয়ে তিনি এখনো নিশ্চিত নন।
আমরা তিনজনের সাথে কথা বলেছি যাদের প্রত্যেকে গাজায় পরিবারের ২০ জনের বেশি সদস্যদের হারিয়েছে। তাদের মধ্যে একজন দারবিশ আল-মানামা। তিনি তার পরিবারের ৪৪ জন সদস্যকে হারিয়েছেন। দুর্বোধ্য মাত্রায় তারা এই দুঃখের মোকাবেলা করছে।
লন্ডনের একজন স্থপতি ও শিক্ষাবিদ ইয়ারা শরীফ আমাকে এক সপ্তাহ আগের ইসরাইলি হামলায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া তার খালার বাড়ির ছবি পাঠিয়েছেন।
‘এটি মাঝখানে বড় উঠোনসহ খুব সুন্দর একটি বাড়ি ছিল’, বলেন ইয়ারা। এই বাড়িতে ছেলেরা তাদের বাবা-মায়ের ফ্ল্যাটের উপরে নিজেদের পরিবারের জন্য ফ্ল্যাট তৈরি করেছিলেন - যার অর্থ দাঁড়ায় এক ঝাপটায় একাধিক প্রজন্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।
এই হামলায় ইয়ারার খালা, খালু তার দুই চাচাতো ভাই এবং তাদের ১০ সন্তানের পাশাপাশি বর্ধিত পরিবারের ছয় সদস্যসহ ২০ জন নিহত হয়।
তাদের মধ্যে কয়েকজনের লাশ ধ্বংসস্তূপ থেকে টেনে আনা তোলা হয়, যা পরে হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত নিহতের তালিকায় সংখ্যায় পাওয়া গেছে।
ইয়ারা আমাদের প্রতিটি নামের পাশে লাল দাগ দেয়া তালিকার একটি স্ক্রিনশট পাঠিয়েছে। তালিকার ডানদিকে তাদের বয়স লেখা ছিল। সামার বয়স ছিল ১৬, যমজ দুই ভাই ওমর এবং ফাহমির বয়স ছিল ১৪, আব্দুল ১৩ বছর, ফাতিমা ১০, ওবায়দা সাত, চাচাতো ভাই আলেমান এবং ফাতিমা উভয়ের বয়স পাঁচ, ইউসুফ চার এবং সারা এবং আনাস ছিলেন তিন বছর বয়সী।
ইয়ারার দুই চাচাতো ভাই জীবিত আছে। তবে তারা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। কারণ যারা মিডিয়াতে কথা বলছেন তাদের টার্গেট করা হচ্ছে এমন গুজব নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন।
ইয়ারার বোনেরা গাজার বিভিন্ন প্রান্তে আছে কিন্তু জানাজা বা শোকের জন্য তারা একে অপরের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। ইয়ারার চাচাতো ভাই তাকে দেয়া বার্তায় লিখেছে, ‘মুহাম্মদ, তার মা ও দুই শিশুর লাশ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে রয়েছে।’
আব্দুল রাহাম ও তার চাচাতো যমজ ভাই ওমর ও ফাহমি। ধ্বংসস্তূপ থেকে ফাহমির লাশ এখনোও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
গাজায় খননকারী মেশিন চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি নেই এবং যেটি এখনো চলছে সেটি দিয়ে জীবিতদের উদ্ধারের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
শুক্রবার আহমেদের সাথে বসে আমি যখন খবর দেখছিলাম তখন মৃতদের তালিকা পর্দায় ওঠে। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তার পরিবারের কেউ এটিতে ছিল কিনা। ‘মাত্র ১২ জন,’ বলেন তিনি। বাকি নয়জনকে এখনো উদ্ধার করা যায়নি।
গত সপ্তাহে বোমা হামলার সময় নিজের বাড়িতে থাকা তার বড় বোন ধ্বংসস্তূপ দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি কারণ সেখানকার পঁচা লাশের গন্ধ সহ্য করা কঠিন।
শুক্রবার থেকে আহমেদ তার কোনো বোনের সাথে কথা বলেনি। তাদের ফোন কাজ করছে না আর সে এখনো জানে না যে তাদের কি হয়েছে।
বোমা হামলার পর থেকে তিনি কী অনুভব করছেন তা বর্ণনা করার জন্য তিনি শব্দ খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, কান্না করা অর্থহীন কারণ তা কিছুই পরিবর্তন করবে না।
আর তিনি অস্থির বোধ করছিলেন : ‘আমার মনে হয় আমি স্থির থাকতে পারি না। আমি স্থির হয়ে বসতে পারি না। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না।’
‘কিছু দিয়েই এই অনুভূতি থামানো সম্ভব না।’
নিহতদের মধ্যে একজন আহমেদের ছোট ভাই মাহমুদ। তিনি আহমেদের মতো উই আর নট নাম্বারস নামের একটি এনজিওতে কাজ করতেন। এনজিওটি তরুণ ফিলিস্তিনিদের তাদের গল্প বিশ্বকে বলার প্রশিক্ষণ দেয়।
মাহমুদকে অস্ট্রেলিয়ায় মাস্টার্স করার জন্য স্কলারশিপের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধের এক সপ্তাহ পরে তিনি আহমেদকে বলেছিলেন তিনি সেখানে যেতে চান না কারণ গাজার বোমাবর্ষণ নিয়ে পশ্চিমারা যে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে তাতে তিনি খুবই ক্ষুব্ধ ছিলেন।
তিনি টুইটারে পোস্ট করেছিলেন, ‘আমার হৃদয় আর এগুলো সামলাতে পারছে না। আমাদের গণহত্যা করা হচ্ছে।’ এক সপ্তাহ পর তার বাবার বাড়িতে তাকে হত্যা করা হয়।
বাবার কথা বলতে গিয়ে আহমেদ জানান, তার চেনা সবচেয়ে দয়ালু মানুষ ছিলেন তার বাবা। একটি বাড়ি নির্মাণ করতে আর তার পরিবারকে শিক্ষিত করতে তিনি ট্যাক্সি চালানো আর নির্মাণ কাজের মতো কঠোর পরিশ্রম করতেন। তিনি মনোযোগ দিয়ে সব খবর শুনতেন আর বিশ্বাস করতেন যে এই সংঘাতের একমাত্র সমাধান হলো এক-রাষ্ট্র সমাধান, যেখানে ইহুদি আর ফিলিস্তিনিরা একে অপরের সাথে শান্তিতে বসবাস করবে।
কিন্তু আহমেদ যখন তার একমাত্র বেঁচে থাকা ভাতিজার কথা ভাবেন যে ওমর কী বিশ্বাস করবে? এই যুদ্ধ তার কাছ থেকে এমন অনেক মানুষকে কেড়ে নিয়েছে, যাদের সে ভালোবাসতো। সূত্র : বিবিসি