কৃত্রিম পায়ে এভারেস্ট জয় করে নেপালি সৈনিকের বিশ্ব রেকর্ড
বলা হয় 'ওয়ান্স অ্যা সোলজার, অলওয়েজ অ্যা সোলজার', একজন সৈনিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সৈনিক। আর এ কথাটিই যেন অক্ষরে অক্ষরে প্রমাণ দিলেন নেপালের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হরি বুধামাগার। কৃত্রিম পায়ে ভর করে তিনি জয় করেছেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্ট, সৃষ্টি করেছেন ইতিহাস। তার এই অসাধারণ কৃতিত্ব বিশ্বব্যাপী শারীরিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন ব্যক্তিদের জন্য অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করবে।
বুধামাগার ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি হাঁটু পর্যন্ত কৃত্রিম পায়ে ভর করে এভারেস্ট জয় করেছেন। শুক্রবার (১৯ মে) বিকাল ৩টায় তিনি এভারেস্টের চূড়ায় পা রাখেন।
এর আগে দুই পা নেই এমন ক্যাটাগরিতে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত কাটা পায়ে কৃত্রিম পা লাগিয়ে ২০১৮ এভারেস্ট জয় করে বিশ্ব রেকর্ড করেন চীনের শিয়া বোও। তখন তার বয়স ছিল ৬৯ বছর।
কৃত্রিম পায়ে এভারেস্ট জয় করার বেশ কয়েকটি ঘটনা থাকলেও হাঁটি পর্যন্ত কাটা পায়ে কৃত্রিম পা লাগিয়ে এভারেস্ট জয়ের ঘটনা এবারই প্রথম।
হিমালয় কন্যা নেপালেই বেড়ে ওঠা বুধামাগারের। কিশোর বয়স থেকেই স্বপ্ন ছিল এভারেস্ট জয় করার। কিন্তু ২০১০ সালে আফগানিস্তানে ব্রিটিশ গুর্খার সৈনিক হিসেবে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় উভয় পা হারান এই নেপালি সৈনিক। তারপরই ফিকে হয়ে আসে আজন্ম লালিত স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে আরও বালি চাপা দেয় ২০১৭ সালে নেপাল সরকারের করা পর্বতারোহন নীতিমালা। সেই নীতিমালায় অন্ধ, উভয় পা প্রতিবন্ধী, এবং একাকী ব্যক্তির পর্বোতারোহন নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে ২০১৮ সালে এভারেস্টে আরোহনের ইচ্ছা থাকলেও তা ত্যাগ করতে হয়।
কিন্তু বিধাতা মনে হয় চাইছিলেন অন্য কিছু। সে সময় বুধামাগার এই নিষেধাজ্ঞার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং একে 'বৈষম্য' বলে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।এই নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে আদালতে রিট করা হলে নেপাল সুপ্রিম কোর্ট রিটের অনুকূলে রায় দেন এবং ২০১৮ সালে আদালত নীতিমালাটি বাতিল করেন।
বুধামাগারের ঐতিহাসিক এ যাত্রার সবচেয়ে বড় বাধা আদালত তো সরিয়ে দিলেন বটে কিন্তু তার চেয়েও বড় সীমাবদ্ধতা ছিল তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা। যা আদৌ জয় করা সম্ভব হবে কি না সে নিয়ে চিন্তিত ছিলেন বুধামাগার। কিন্তু 'সৈনিক সর্বদা সৈনিক' এই মন্ত্রে দীক্ষিত বুধামাগার পিছু হটেননি। শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অবশেষে তিনি পৌঁছে গেলেন এভারেস্টের চূড়ায়, দেখিয়ে দিলেন জয় লাভের অদম্য স্পৃহা থাকলে যে কোনো বাধাই অতিক্রম করা সম্ভব।
বুধামাগারের জন্ম ১৯৭৯ সালে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী তে যোগদান করেন। সেনাবাহিনীতে তিনি একাধারে কমব্যাট মেডিক, স্নাইপার এবং কভার্ট সার্ভিলেন্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেনাবাহিনী থেকে অবসরে চলে এলেও বসে থাকেননি বুধামাগার। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েই নিজেকে গলফ, স্কি, স্কাই ডাইভিং, কায়াকি, রক ক্লাইম্বসহ বিভিন্ন খেলায় ব্যস্ত রেখেছেন। এমনকি তিনি হুইলচেয়ার রাগবি ও হুইলচেয়ার বাস্কেটবলও খেলেছেন। ইতিহাসে প্রথম উভয় পা বিহীন ব্যক্তি হিসেবে ২০ হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বিশ্ব রেকর্ডও করেছেন ৪৪ বছর বয়সী এই সৈনিক।
২০২০ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মন্ট ব্ল্যাঙ্ক (৪ হাজার ৮১০ মিটার), কিলিমানিজারো (৫ হাজার ৮৯৫ মিটার), চুলু ফার ইস্ট (৬ হাজার ৫৯ মিটার), মেরা পিক (৬ হাজার ৪৭৬ মিটার) পর্বত শৃঙ্গের চূড়ায় উঠে রেকর্ড করেছেন বুধামাগার এবং সবশেষ মাউন্ট এভারেস্টের (৮ হাজার ৮৪৮ মিটার) চূড়ায় উঠে বিশ্ব রেকর্ড করে আবারও ইতিহাস সৃষ্টি করলেন এই যুদ্ধাহত সৈনিক।
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদ সংস্থা বিবিসিকে বুধামাগার বলেছেন, 'আমার কল্পনার চেয়েও এটি অনেক বেশি কঠিন ছিল'
তিনি বলেন, 'আমার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য অক্ষমতা সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তন করা এবং মানুষকে বাধা ডিঙিয়ে জয় লাভ করতে অনুপ্রাণিত করা। আপনার স্বপ্ন যতই বড় হোক না কেন, আপনার অক্ষমতা যতই চ্যালেঞ্জিং হোক না কেন, দৃঢ় মানসিকতা থাকলে সবকিছুই সম্ভব।'
পরিবারের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বুধামাগার বলেছেন, 'যখনই কোনো জটিল পরিস্থিতির সম্মুখীন হই আমি আমার অসাধারণ পরিবারের কথা মনে করি যারা আমাকে পথ অতিক্রম করতে অনবরত সাহস জুগিয়েছেন।'
হরি বুধামাগারের অবিশ্বাস্য এই কীর্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, 'আত্মা কোনো বাধা মানে না'। জীবনে চলার পথ যতই জটিল হোক না কেন, যতই বাধা বিপত্তি থাকুক না কেন লক্ষ্য অর্জন করতে, বিজয় ছিনিয়ে আনতে বুধামাগারের জীবনের গল্প নিঃসন্দেহে অগণিত ব্যক্তিকে অনুপ্রাণিত করবে।
/এএস