অগ্নিগর্ভ মণিপুর, দেখা মাত্রই গুলির নির্দেশ
‘আমার রাজ্য মণিপুর জ্বলছে! পরিস্থিতি খুব খারাপ। দয়া করে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন…’, বুধবার (৩ মে) কাতর আবেদন রেখেছিলেন মণিপুর তথা ভারতের গর্ব, বক্সিং তারকা মেরি কম। উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে গোটা রাজ্য, দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছে, আগুন জ্বলছে, মোকাবিলায় রাস্তায় নেমেছে সেনা এবং আধাসেনা। কিন্তু তার পরেও সামলাতে গিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছে উত্তর পূর্বের এই রাজ্যের বিজেপি সরকার। শেষমেশ বৃহস্পতিবার (৪ মে) রাজ্য প্রশাসন হুমকি দিয়ে জানিয়েছে, চরম পরিস্থিতিতে দেখা মাত্রই গুলি করা হবে।
মণিপুরের পরিস্থিতি যেন প্রতি মুহূর্তে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে । রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এবার খাস ইম্ফলের রাস্তায় উত্তেজিত জনতার রোষের মুখে পড়লেন রাজ্যের এক বিজেপি বিধায়ক । মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর রাজ্য সচিবালয় থেকে ফেরার পথে ভিংযাগিন ভালতে নামে এক বিধায়ক আহত হন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানেই চিকিৎসা চলছে তার।
মণিপুরে সংঘাতের সূত্রপাত বুধবার থেকে। সেখানকার হাইকোর্ট সরকারের উদ্দেশে নির্দেশ দিয়েছে, মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি তালিকাভুক্ত করা যায় কি না তা বিবেচনা করতে। তারপরেই জনজাতি ছাত্রদের উত্তাল আন্দোলন মণিপুরে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। এমনই পরিস্থিতি যে বৃহস্পতিবার বিকালে রাজ্যপালের অনুমতিক্রমে মণিপুরের বিজেপি সরকার দেখা মাত্রই গুলি অর্থাৎ শ্যুট অ্যাট সাইট অর্ডার জারি করেছে।
বুধবার বিকালেই মণিপুরের বিজেপি সরকার অধিকাংশ জেলায় কার্ফু জারি করেছিল। কিছু জায়গায় মোবাইল পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছিল আগেই। সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পরপরই বিষ্ণুপুর ও চুরাচাঁদপুর জেলার সীমান্তবর্তী এলাকায় সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। যদিও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছে এন বীরেন সিংয়ের সরকার। তারমধ্যেই বৃহস্পতিবার আক্রান্ত হলেন ভালতে। গতবারের বিজেপি সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন তিনি। কুকি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি তিনি। তার গাড়ির ওপরই এদিন চড়াও হন আন্দোলনকারীরা। বিধায়ক ও তার গাড়ির চালক আহত হন। দু’জনকেই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে, মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সেই বৈঠকে ছিলেন রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। শুধু তাই নয়, মণিপুরের তিন পড়শি রাজ্য মিজোরাম, অসম ও নাগাল্যান্ডের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গেও ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন শাহ।
মণিপুরে রাজনৈতিক বা জাতিগত উত্তেজনা নতুন নয়। তবে সাম্প্রতিক এই উত্তেজনাকে জানতে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকটা বছর, খানিকটা মণিপুরের ভূগোলেও চোখ বোলাতে হবে।
ভারতের উত্তর-পূর্বের অন্যতম বৈচিত্র্যময় পাহাড়ি রাজ্য মণিপুর। এর ঠিক মাঝখানে রয়েছে প্রায় দুই হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে এক উপবৃত্তাকার উপত্যকা, তাকে ঘিরে রয়েছে সুউচ্চ হরিৎ পাহাড়। এই উপবৃত্তাকার উপত্যকা আয়তনের দিক থেকে মোট রাজ্যের ১০ শতাংশ। কিন্তু জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ বসবাস করেন এখানে। যার বেশিরভাগই মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনজাতি। মণিপুর প্রায় ৩৪টি ছোট বড় নানা জনগোষ্ঠীর বাসভূমি। মেইতেইরা তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ। তাদের অধিকাংশই এই উপত্যকা অঞ্চলে থাকেন। বাকি রাজ্যের ৯০ শতাংশ পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বাকি জনগোষ্ঠীর বসবাস। তাতে বসবাসকারী ৩৪টি জনগোষ্ঠীদের ‘নাগা’ অথবা ‘কুকি’— এই দুই ‘চিহ্নিত উপজাতি’-তে বিভক্ত করা হয়েছে। এই চিহ্নিত বা স্বীকৃত উপজাতিরা অত্যন্ত পরিশ্রমী, স্বাধীনচেতা এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার ফলশ্রুতিতে ধর্মে অধিকাংশই খ্রিস্টধর্মাবলম্বী।
এবারের সমস্যার শেকড়ে রয়েছে মেইতেই জনজাতির সঙ্গে কুকিসহ বিভিন্ন স্বীকৃত উপজাতিদের এক আইনি লড়াই। অকুস্থল— একেবারে মণিপুর হাইকোর্ট।
প্রায় এক দশক ধরে নানাভাবে মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইরা আইনিভাবে তফশিলি উপজাতি বা ‘শিডিউলড ট্রাইব’ (এসটি) তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য দাবি জানিয়ে আসছিল। তাদের বক্তব্য, স্বাধীনতার আগে স্বাধীন মণিপুর রাজ্যে তাদের ‘উপজাতি’ হিসেবেই স্বীকৃতি ছিল। স্বাধীনতা ও তারপর ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে মণিপুরের অন্তর্ভুক্তির পর তাদের এই তকমা চলে যায়। ফলে জমি থেকে ঐতিহ্য, ভাষা, পোশাক সবখানে স্বকীয়তা বজায় রাখার যে সুবিধাগুলি তফসিলি উপজাতিরা পেয়ে থাকেন, তারা তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এই মর্মে তারা আবেদন রেখেছিলেন মণিপুর হাইকোর্টে। হাইকোর্ট সব আবেদন শুনে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, চার সপ্তাহের মধ্যে আবেদনকারীদের দাবিদাওয়া যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে রাজ্যের অবস্থান জানাতে। কিন্তু এতেই বেজায় চটেছেন মণিপুরের বাকি উপজাতিরা। তাদের বক্তব্য, এতে অন্যায়ভাবে সুবিধে পেয়ে যাবেন মেইতেইরা এবং তাতে আখেরে ক্ষতি হবে নাগা, কুকিসহ বাকি উপজাতিদের। এমনিতেই মেইতেইরা যথেষ্ট অগ্রসর। রাজ্যের বেশিরভাগ বসতি যেহেতু উপত্যকায়, বিধানসভার আসনও বেশিরভাগ ওখানেই। মেইতেইরাও বিধানসভায় প্রবলভাবে গরিষ্ঠ। মেইতেই ভাষাকে সংবিধানের বাইশটি সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া মেইতেইরা বেশিরভাগ হিন্দু হওয়ায় এমনিতেই তফশিলি জাতি (এসসি) বা অন্যান্য অনগ্রসর জাতি (ওবিসি) সংরক্ষণের সুযোগ পান। তারা তফশিলি উপজাতি-ভুক্ত হলে বাকি উপজাতিদের কাজের ক্ষেত্রে বা পড়াশোনায় বা চাকরিবাকরিতে যেটুকু যা সুযোগ-সুবিধে ছিল, তাও থাকবে না।
কুকি উপজাতিদের মুখপাত্ররা জানিয়েছেন, রাজ্যে কুকি-সহ বিভিন্ন উপজাতিদের দাবিদাওয়া মেইতেইদের দাপটে চাপা পড়ে গেছে। সংখ্যালঘু হিসেবে যেটুকু যা তাদের ন্যায্য পাওনা, এবার তা থেকেও তাদের বঞ্চিত করতে চায় মেইতেইরা। ফলে হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে মিছিলের ডাক দিয়েছিল উপজাতি ছাত্রদের সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অফ মণিপুর’। যেখান থেকে সংঘাত তথা গৃহযুদ্ধের শুরু। এই হিংসার ঘটনায় তীব্র চাপের মুখে মণিপুরের বীরেন সিংহের নেতৃত্বে বিজেপি সরকার।
আরএ/