টান টান উত্তেজনায় অস্থিতিশীল বিশ্ব রাজনীতি

বিদায় নিচ্ছে ২০২২। রাত ১২ বাজলেই শুরু হবে নতুন বছর। পুরোনো বছরের ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তির গ্লানি ভুলে প্রাপ্তি আর সফলতাকে উপজীব্য করে স্বাগত জানানো হবে ২০২৩ সালকে। সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় নতুন করে পথচলার প্রত্যয় ব্যক্ত করবেন বিশ্ববাসী।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিদায়ী বছরটি ছিল টানটান উত্তেজনাপূর্ণ। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক রাজনীতির মোড় ঘুরেছে বারবার। বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পেয়েছে নতুন মাত্রা।
ইউক্রেন-রাশিয়া দ্বন্দ্বে টালমাটাল বিশ্ব
বিদায়ী বছরে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের চেষ্টাকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার চাপা ক্ষোভ রূপ নেয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। রাশিয়ার পরামর্শ ও নিষেধ বারবার প্রত্যাখাত হওয়ায় ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আক্রমণ চালায় রাশিয়া। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের তথ্যনুসারে এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে উভয় পক্ষের মৃতের সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। যার মধ্যে ৪২৮ জন শিশু এবং আহতের সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। একই সঙ্গে এই যুদ্ধের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, মে মাসের শেষের দিকে আনুমানিক ৮০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ৮ নভেম্বরের মধ্যে ৭৮ লাখ ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে পালিয়েছে।
কেবল প্রাণহানী বা শরনার্থী সংকট নয় এই যুদ্ধের বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতিতেও। জ্বালানি তেলের সংকট, দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্দ্ধগতি, পণ্য সরবরাহে সৃষ্ট জটিলতা এবং খাদ্য ঘাটতি প্রভৃতি বিষয়ে অস্থিতিশীল হয়ে বিশ্ববাজার। এ অস্থিরতা কাটাতে এখনো লড়াই করে চলছে পুরো বিশ্ব। দরজায় কড়া নাড়তে থাকা ২০২৩ সালে যে এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটবে— এমন কোনো সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন না অর্থনীতিবিদরা। বরং তাদের আশঙ্কা আগামী বছর পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে। এমনকি অনেক দেশ দুর্বিক্ষের মত পরিস্থিতির সম্মুখীনও হতে পারে।
বাংলাদেশ নিয়ে মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন ইস্যুতে নাম উঠে এসেছে বাংলাদেশেরও। র্যাবের উপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও কুটনৈতিক তৎপরতা ছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশ নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র। ২২ ডিসেম্বর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কোর নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মন্তব্য করেন, ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের শাহীনবাগে যাওয়াকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের চেষ্টা বলে মনে করে রাশিয়া। ২৫ ডিসেম্বর ঢাকার রুশ দূতাবাস সেই বিবৃতিটি প্রচার করে। একইসঙ্গে মস্কোর দৃষ্টিতে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের কী ভূমিকা এবং ইউরোপে তার প্রভাব কেমন, তা তুলে ধরতে টুইটারে একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করে রুশ দূতাবাস। মারিয়া জাখারোভা বলেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকার সুরক্ষার কথা বলে ক্রমাগত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
তাইওয়ান ইস্যুতে নাখোশ চীন
দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ান চীনের অংশ হওয়ায় তাইওয়ান ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বিশ্বকে নাক না গলাতে পরামর্শ দিয়েছিল চীন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব এশিয়ায় সফরসূচিতে তালিকাভুক্ত না থাকা সত্ত্বেও আগস্টে তাইওয়ান যান যুক্তরাষ্ট্রের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি এবং তার প্রতিনিধিদল। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তাইওয়ানে একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা পাঠানোর কারনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে। ফলাফল হিসেবে ৭ অক্টোবর চায়নার প্রতি রপ্তানি নীতিমালায় পরিবর্তন আনে যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিবর্তনের উদ্দেশ্য ছিল উন্নত কম্পিউটার টেকনলজির বিকাশ এবং সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদনে চীনের সক্ষমতাকে বাধাগ্রস্থ করা। এর মাধ্যমে চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি এবং জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগ প্রতিফলিত হয়। অবশ্য পরবর্তীতে বালিতে জি টুয়েন্টি সম্মেলনের সাইডলাইন বৈঠকে ১৪ নভেম্বর জো বাইডেন এবং শি জিনপিং মুখোমুখি হন এবং ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে চলা সেই বৈঠকে তারা তাইওয়ান এবং উত্তর কোরিয়া নিয়ে উত্তেজনা ও ইউক্রেন যুদ্ধের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন।
রানির বিদায়
বিদায়ী বছরে হারানোর তালিকায় সবার আগে যে ঘটনাটি সবার আগে উঠে আসবে সেটি হল সবচেয়ে বেশি সময় রাজত্বকারী ব্রিটিশ রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু। ৮ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ডে বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি মারা যান। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের শাসনামলে যুদ্ধোত্তর মন্দা, সাম্রাজ্য ভেঙে কমনওয়েলথে উত্তরণ, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্তি এবং বের হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাগুলো ঘটেছে। তিনি সিংহাসনে আরোহণের ৭০ বছর পর ৯৬ বছর বয়সে মারা যান। রানির মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্র তৃতীয় চার্লস ইংল্যান্ডের নতুন রাজা হন।
করোনার কাটা ঘায়ে মাঙ্কিপক্সের নুনের ছিটা
২০১৯ সালে চীনের উহান প্রদেশ থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ২০২২ সালের শেষ দিকে অনেকটাই কমে আসে। তিন বছর ধরে করোনার চোখ রাঙানি ও মৃত্যুর মিছিল ভ্যাকসিন এবং চিকিৎসা সাফল্যের কারণে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। কিন্তু এরই মধ্যে নতুন বিপাকে পড়ে বিশ্ব। ২০২২ সালের মে মাসের শুরু থেকে মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নামকরণ করে এমপক্স। ২০২২ সালে বিশ্বের ১১০টি দেশে এমপক্স শনাক্ত হয়। ডব্লিউএইচওর তথ্যানুসারে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভাইরাসটিতে ৮২ হাজার ৮২৮ জন আক্রান্ত হয়েছেন। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঝুঁকি মূল্যায়ন করে ভাইরাসটিকে মাঝারি হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে। তবে জনস্বাস্থ্য উদ্বেগের জন্য আন্তর্জাতিক জরুরি অবস্থা হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বেসামাল ইমরান খান
বিদায়ী বছরের এপ্রিলে পাকিস্তান পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা হারান দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। এখন পর্যন্ত দেশটিতে কোনো প্রধানমন্ত্রীই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ইমরান খান অবশ্য ক্ষমতা হারিয়ে চুপ থাকেননি। তিনি উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ইসলামাবাদে ধারাবাহিক প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দেন। আগস্টে তার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সন্ত্রাসবিরোধী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ আনে সরকার। নভেম্বরে তাকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তিনি আহত হন। ইমরান এ হামলার জন্য শরীফ ও জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের দায়ী করেন এবং দেশে আগাম নির্বাচনের দাবি জানান।
শ্রীলঙ্কায় পারিবারিক শাসনের অবসান
বেশ কয়েক বছরের অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অদূরদর্শী নীতিনির্ধারণ ও সুশাসনের সামগ্রিক অভাবে বিদায়ী বছরে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা। করোনা মহামারির কারণে অর্থনৈতিক সংকট আরও তীব্র হয়। এই অর্থনৈতিক সংকট শ্রীলঙ্কায় ব্যাপক বিক্ষোভের জন্ম দেয়, যা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছিল। খাদ্য, জ্বালানি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র ঘাটতি সৃষ্টি হলে প্রতিবাদকারীরা গোতাবায়ার সরকারি বাসভবনে হামলা চালালে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। এভাবে দেশটিতে প্রায় ২০ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা একটি পারিবারিক শাসনের অবসান ঘটে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন ২০ জুলাই অনুষ্ঠিত সংসদীয় ভোটে জয়ী হওয়া রনিল বিক্রমাসিংহে।
/এএস
