গৌতম আদানির নির্মাণাধীন নৌবন্দরে হামলা
একটি নৌবন্দরের নির্মাণে জেলেদের বাধাদানের সময় তাদের সমর্থনে এগিয়ে একজন আর্চবিশপ ও কয়েকজন যাজকের বিপক্ষে সহিংসতার পুলিশের অভিযোগের তদন্তের নিন্দা জানিয়েছে ভারতের একটি গির্জা।
ভারতের কমিউনিস্ট শাসিত একমাত্র রাজ্য কেরালার রাজধানী তিরুভনন্তপুরমের একটি অঞ্চল ভিজানজামেতে নতুন এই নৌবন্দরটি তৈরি করা হচ্ছে। সেখানে নদীতে মাছ ধরা জেলেদের অভিযোগ, বন্দরটির পেছনে প্রায় ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হচ্ছে এবং বন্দরটি তাদের মাছ ধরার ক্ষেত্রগুলোকে আক্রান্ত করেছে, উপকূলীয় ক্ষয়ের কারণ হয়েছে ও তাদের জীবন-জীবিকাকে হুমকির মধ্যে ফেলছে।
বিশ্বের তৃতীয় ও এশিয়ার শীর্ষ ধনী আদানি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম আদানি প্রকল্পটি পরিচালনা করছেন। কেরালার পুলিশ সোমবার ৩ হাজার প্রতিরোধকারীর বিপক্ষে অভিযোগ দায়ের করেছে। তাদের মধ্যে আছেন তিরুভনন্তপুরমের আর্চবিশপ থমাস জে. ন্যাটো ও কয়েকজন সিনিয়র ফাদার।
তারা তিরুভন্তম ক্যাথলিক আর্চডায়াসিসের অংশ। তাদের বিপক্ষে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার আরও অভিযোগ, তাদের ভিজানজামের একটি পুলিশ স্টেশনে আক্রমণে যোগসাজশ আছে। রবিবার শেষের দিকে হামলায় ২৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন।
এই জেলেরা একটি গণপ্রতিরোধের ডাকের মাধ্যমে স্টেশনটিতে আক্রমণ করেছেন পাঁচজন মানুষকে ছিনিয়ে নিতে, যাদের বিপক্ষে পাশের সাগরের ওপর নির্মাণাধীন নৌবন্দরটির নির্মাণ কাজ ব্যর্থ করে দেবার অভিযোগ রয়েছে। এই প্রতিরোধকারীদের গির্জাটি সমর্থন করেছে।
তবে দি ল্যাটিন ক্যাথলিক আর্চডায়াসিসের ফাদার এডিসন দ্য ন্যাশনালকে বলেছেন, ‘মানুষজন স্টেশনটিতে মানুষগুলোকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য গিয়েছিল। কিছু মানুষ পাথর ছুঁড়তে শুরু করল। ফলে পুলিশ লাঠিচার্জ করতে লাগলো। সেটি ঘুরে গেল ক্যাথলিকদের ওপর...তারপরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। যাজকরা এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন না।’
তিনি আরও বলেছেন, ‘যাজকরা মানুষের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদের প্রতি সুবিচার চাইছেন। এটি গরীব ও ধনীর একটি লড়াই। মানুষকে আইনে বন্দী করা বেআইনি মনে হচ্ছে এবং যাজকদের প্রতিও, যারা মানুষদের অধিকার প্রদানের জন্য প্রতিরোধ করছেন।’
শত, শত জেলে, যারা এই জেলে সমাজের মানুষ, তারা একেবারে গরিব; তারা তাদের উপকূলরেখা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন করা সম্পন্ন হয়েছে-এই অভিযোগে গৌতম আদানির বিপক্ষে নেমেছেন।
শনিবার শেষের দিকে পুলিশ সেই পাঁচজনকে ডিটেনশনে নিয়েছে। তারা একটি সহিংসতার মাধ্যমে এই বন্দরের বিরুদ্ধে এবং বন্দর নির্মাণের বিরুদ্ধে নেমে সংঘর্ষ করেছেন। তারা ২৪টিরও বেশি লরিকে আটকে দিয়েছেন। সেগুলোকে বন্দরের নির্মাণ সামগ্রী রয়েছে। সেগুলোকে তারা বন্দর এলাকার মধ্যে ঢুকতে দেননি।
যদিও কেরালার হাইকোর্ট আবারও নির্মাণ কাজটি শুরু করার আদেশ জারি করেছিল। পুলিশ তাদের অভিযোগে আরো জানিয়েছে, এই ৩ হাজারের বেশি জনতা পুলিশ স্টেশনটির ওপর হামলে পড়েছে শনিবার শেষের দিকে। তারা তান্ডব চালিয়েছে এবং পুলিশের যানবাহনগুলো পুড়িয়েছে। দুই ডজনের বেশি পুলিশ সদস্যকে আহত করেছে। তারা আটকদের ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেছে।
পুলিশ লাঠি (ব্যাটন) চার্জ করেছে ও কয়েকটি টিয়ার গ্যাসের সেল ছুঁড়েছে, যাতে এই উন্মত্ত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া সম্ভব হয়। তারা তাদের লক্ষ্য করে বন্দরের পাথর ছুঁড়েছে এবং শিলাবৃষ্টির মতো পুলিশ অফিসারদের উপরও পড়েছে।
পুলিশের কর্মকর্তা রামু পিভি বলেছেন, ‘আমাদের অফিসারদের আটজন আহত হয়েছেন। ইনপেক্টরদের একজনকে তার পায়ের অপারেশনের জন্য সার্জারিতে যেতে হয়েছে। তার পা আক্রমণটিতে ভেঙে গিয়েছে।’
তিনি আরও জানিয়েছেন, ‘এই স্টেশনে আমাদের ৮০ জন অফিসার ও বিভিন্ন পদের পুলিশ সদস্য ছিলেন। তারা প্রায় সন্ধ্যা ৬টায় আমাদের আক্রমণ শুরু করেছে। পরের তিনটি ঘন্টা তারা টানা আক্রমণ করেছে। এরপর অতিরিক্ত বাহিনী এলো এবং তারা অ্যাকশনে নামলেন। আমি সেখানে ছিলাম। তারা বৃষ্টির মতো পাথর ছুঁড়েছে, কাঠের টুকরো মেরেছে। আমরা ক্যাথলিক ধর্মযাজকদের আসামী করেছি। কারণ তারা তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।’
স্থানীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ফুটেজগুলোতে দেখা গিয়েছে, সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন ও তাদের রক্ত ঝরছে।
পুলিশ এবং দাঙ্গাবিরোধী অতিরিক্ত সদস্য সেই এলাকাতে প্রেরণ করা হয়েছিল। যাতে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন, গণমাধ্যম জানিয়েছে রাজ্য সরকারের মারফতে। তবে পরিস্থিতি এখনো উত্তপ্ত।
তবে গির্জার পক্ষে ফাদার এডিসন পুলিশের পাল্টা যুক্তি দেখিয়েছেন এবং একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘যখন পুলিশবাহিনী কোনোখানে থাকে, সেখানে একত্রে ৩ হাজার মানুষ থাকতে পারে না। আমরা একটি তদন্ত চাই ও নজরদারি ক্যামেরাগুলোর বিশ্লেষণ চাই যে, আসলে কী ঘটেছে। কীভাবে এর শুরু হয়েছে। মানুষকে কেবল অভিযুক্ত করা হচ্ছে তা চাই না।’
সরকারী কর্তৃপক্ষ সেই অঞ্চলে এক সপ্তাহের জন্য যেকোনো ধরণের নেশাজাতীয় দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করেছেন। নৌবন্দর বিরোধী প্রতিরোধকারীদের বেশিরভাগই স্থানীয় এবং জেলে, তাদের নেতৃত্ব প্রদান করে লাতিন গির্জাটি।
তারা আগস্ট থেকে এই প্রকল্প বিরোধী। তাদের দাবি, একটি স্থগিত পরিবেশগত পর্যালোচনা কার্যকরের পর কার্যক্রমটি করা উচিত। পরিবেশগত পর্যালোচনাটি উপকূলীয় এলাকাটির বাস্তুসংস্থানের ওপর প্রভাব নিয়ে করা হয়েছে।
২০১৫ সালে এই প্রকল্পটি নিমাণ শুরু করার জন্য অনুমোদন করা হয়েছে। তবে বারবার স্থানীয় সমাজগুলোর মানুষরা দেরি করিয়ে দিয়েছেন। তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছেন। একদল আছেন বন্দরের পক্ষে, আরেকদল বিপক্ষে।
প্রতিরোধকারীরা একটি বিরাট পাথরের প্রতিরোধ তৈরি করেছেন এবং এর মাধ্যমে প্রধান বন্দর এলাকায় প্রবেশ বন্ধ করেছেন। যেটি প্রধান আন্তর্জাতিক জাহাজ পথের অর্ন্তভুক্ত।
রাজ্য সরকার ও উন্নয়নকারী পরিবেশগত বিপর্যয়ের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা এই মামলাটিকে কেরালা হাই কোর্টে নিয়ে গিয়েছেন। গেল সপ্তাহে আদালত আদেশ দিয়েছেন, অবশ্যই প্রতিরোধকারীরা নির্মাণকাজ ধ্বংস করতে পারবেন না এবং তাদের জীবন-জীবিকার অধিকার প্রদানও করতে হবে।
ওএফএস/