পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরি বিক্রি! দুর্নীতির বীজ থেকে অপরাধের মহীরুহ
মাত্র কয়েক বছর আগে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির দাবিতে ঢাকার শাহবাগ চত্বরে জোয়ার নামিয়ে এনেছিল বাংলাদেশের ছাত্র ও যুবসমাজ। গঙ্গাপারের শহর কলকাতায়ও গত প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ছাত্রছাত্রী তথা যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা তাঁদের ন্যায্য চাকরির দাবিতে আন্দোলন করে চলেছেন। ধারে ও ভারে কিংবা চরিত্রে শাহবাগের আন্দোলনের সঙ্গে কলকাতার যুব-আন্দোলনের মিল না থাকলেও স্পিরিটটা মোটামুটি একই রকম।
আন্দোলনকারীরা প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় পাশ করে ইন্টারভিউয়ের পর্ব শেষ করে চাকরির প্যানেলে নাম তুলে ফেলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, তাঁদের সেই ন্যায্য চাকরি পেয়ে গিয়ে চাকরি শুরু করে দিয়েছেন হাজার হাজার অযোগ্য প্রার্থীরা। চাকরির দাবিতে সেই থেকে তাঁদের আন্দোলনের সূত্রপাত।
এর পরের পর্যায়ে কলকাতা হাইকোর্টের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় তদন্ত এবং বিচার প্রক্রিয়া। সেখানে দেখা গিয়েছে, রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী, বিধায়ক এবং শিক্ষা দপ্তরের শীর্ষ স্তরের আধিকারিকরা মিলে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সেই সরকারি শিক্ষকের চাকরি বিক্রি করে দিয়েছেন অযোগ্য প্রার্থীদের। সাত থেকে ১৮ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছে সেই চাকরিগুলি। এখনও চলছে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া।
এই মুহূর্তে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ শিক্ষা দপ্তরের প্রায় সব শীর্ষ কর্তাই জেলে রয়েছেন। এই শীর্ষ নেতাদের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দেড়শো কোটি টাকারও বেশি নগদ অর্থ (চাকরি বিক্রির টাকা)। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে অনশনরত সেই চাকরিপ্রার্থীদের ওপর চড়াও হয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুলিশ। লাঠিপেটা করে তুলে দেওয়া হয় সেই চাকরি প্রার্থীদের। ওই ঘটনার পর থেকে কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে উত্তপ্ত হয়ে রয়েছে পরিস্থিতি।
বিরোধী দলগুলি রাস্তায় নেমে এসেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই বিষোদ্গার করতে শুরু করেছেন অপর্ণা সেনের মতো সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। কয়েকটি পরিসংখ্যানের ওপর নজর রাখলে বোঝা যাবে চুরির পর চুরির অভিযোগে বিদ্ধ পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যকে ঠিক কোন খাদের কিনারায় নিয়ে এসেছে।
পরিসংখ্যান ১: তৃণমূল কংগ্রেস শাসিত পশ্চিমবঙ্গ। শিক্ষক/শিক্ষিকা নিয়োগ দুর্নীতির জেরে হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী রাজপথে আমরণ গণঅনশন করছেন। তাঁরা প্রতীকী লাশ হয়েছেন। এ রাজ্যে গত বাম সরকারের ৩৪ বছরে এমন দেখা যায়নি।
পরিসংখ্যান ২: বিজেপি জোট শাসিত রাজ্য ত্রিপুরা। কর্মচ্যুত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আত্মহত্যা ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সংখ্যা ১৪২ জন। বাংলাভাষী এই রাজ্যে গত ২৫ বছরের বাম আমলে এমনটি হয়নি। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা এই দুটি রাজ্য থেকেই বাম সরকার গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরে গেছে। দুটি রাজ্যেই ক্ষমতায় দক্ষিণপন্থীরা। দুই রাজ্যে শিক্ষক/শিক্ষিকা নিয়োগের ক্ষেত্রে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
পরিসংখ্যান ৩: সিপিআইএম নেতৃত্বে কেরল সরকার ঘোষণা করেছে বিপুল শিক্ষক/শিক্ষিকা নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি। দেশের প্রথম সারির সব গণমাধ্যমের খবর, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতায় যে কোনও উন্নত দেশকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে কেরল সরকার। উপরোক্ত পরিসংখ্যানগুলি জানিয়ে দিচ্ছে সবই সরকারের ইচ্ছে। অভিযোগ, সদিচ্ছার অভাব হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। যেমন বিজেপি শাসিত ত্রিপুরায় কর্মচ্যুত শিক্ষকের মৃত্যুর পর অর্থাভাবে তাঁর স্ত্রী চিতায় উঠে সন্তানসহ সহমরণ করতে যান। শতাধিক শিক্ষক/শিক্ষিকার মৃত্যু হয়।
এদিকে টেক চাকরি প্রার্থীদের কলকাতায় গণঅনশনের জীবন্ত লাশ হওয়া ছবি ভয়াবহ ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছ। বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়েছে এই ছবি। সামাজিক মাধ্যমে প্রশ্ন উঠছে যদি এই প্রতীকী লাশ বাস্তব হয়ে যায়? গত সোমবার থেকে সল্টলেকে অনশন বিক্ষোভ জারি রেখেছেন চাকরি প্রার্থীরা৷ অন্ন, জল কিছুই নামেনি গলা দিয়ে। যার জেরে অচল হয়ে পড়ছে শরীর৷ তবুও আন্দোলনে অনড় ২০১৪ সালের টেক পাশ চাকরি প্রার্থীরা।
বৃহস্পতিবারও জারি রয়েছে আমরণ অনশন৷ শরীরের ওপর সাদা কাপড় জড়িয়ে নিজেরাই হয়েছেন জীবন্ত লাশ৷ চাকরি প্রার্থীদের বক্তব্য, দীর্ঘ চার দিনের পরেও নমনীয় হচ্ছে না সরকার৷ তাদের বক্তব্য, সরকার অনেক ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী সিদ্ধান্ত নিতে পারে তবে এক্ষেত্রে কেন নিচ্ছেন না৷ তাদের কথায়, এমনিতেই আমাদের মরতে হবে৷ মরতে হলে এখানেই মরব৷ তবে যোগ্য নিয়োগ-দাবি অর্জন না হওয়া অবধি আন্দোলন জারি রাখার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা। প্রয়োজনে সরকার অচল করতেও প্রস্তুত তাঁরা।
শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগে দুর্নীতির পাহাড় তৈরি হয়েছে ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় আদালতের নির্দেশে ভুয়ো শিক্ষক নিয়োগ খুঁজতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন স্কুল সার্ভিস কমিশন, মধ্য শিক্ষা পর্ষদ এবং মামলাকারীদের আইনজীবীরা। আগামী নভেম্বর মাসেই আদালতের কাছে ভুয়ো নিয়োগের রিপোর্ট পেশ করা হবে। আগামী ১৬ নভেম্বর হাইকোর্টে জমা দেওয়া হবে সেই রিপোর্ট। ভুয়ো নিয়োগের তালিকায় যেসব শিক্ষকদের নাম রয়েছে,সেই তালিকা সুদীর্ঘ। যার ফলে আগামী মাসে হাজার হাজার ভুয়ো এবং টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষক চাকরি খোয়াতে চলেছেন।
গত কয়েক বছরে নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির পাহাড় তৈরি হয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে বেনিয়মের নজির এখন রাজ্যের জেলায় জেলায়। গত কয়েক বছরে এই যে দুর্নীতি, তাতে ভুয়ো নিয়োগের সংখ্যা কত? কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশে তা খুঁজে বের করতেই স্কুল সার্ভিস কমিশনের দফতরে বৈঠকে বসে তিন পক্ষ। ইতিমধ্যেই ভুয়ো নিয়োগ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে তথ্য জমা দিয়েছে সিবিআই। সেই তথ্যের সঙ্গে স্কুল সার্ভিস কমিশনের দেওয়া তথ্য মিলিয়ে দেখা হবে। তারপরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে রাজ্যের সর্বোচ্চ আদালত।
প্রসঙ্গত, স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় জড়িয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়-সহ কমিশনের উপদেষ্টা কমিটির একাধিক সদস্য, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি-সহ সামিল রয়েছেন মিডলম্যানরাও। নিয়োগ দুর্নীতির সঙ্গে কারা যুক্ত? কীভাবে এতগুলো বছর ধরে এই নিয়োগ দুর্নীতি চলছিল? এর সাথে আরও কারা কারা যুক্ত রয়েছেন? তদন্তের জন্য সবটাই জানতে বারবার সকলকে হেফাজতে নিচ্ছে সিবিআই। সম্প্রতি (গত বুধবার) সিবিআই দাবি করে, 'কী করে অপরাধ করলে বাঁচতে হবে সবটাই পরিকল্পনা রেখেছিলেন সকলেই'।
আদালতের কাছে সিবিআই আরও দাবি করেছে, এঁরা প্রত্যেকে প্রভাবশালী। সিবিআই কী তদন্ত করছে, কাকে ডাকছে, কী তদন্ত করছে, তা এঁরা জেনে নিতেন। সাক্ষীদের কী প্রশ্ন করা হয়েছে, তাও জেনে নিতেন। বাঁচার জন্য রাস্তা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন”। সিবিআইয়ের তরফে আদালতকে জানানো হয়েছে,নিয়োগ দুর্নীতি সঙ্গে যারা যুক্ত, সকলকেই আদালতের সামনে আনতে চায় সিবিআই।
এএজেড