টাটাকে নিয়ে মমতার কলকাতায় নতুন বিতর্ক
ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতায় নতুন করে উঠে এসেছে একটি পুরনো বিতর্ক। ২০১১ সালে ৩৬ বছরের বামফ্রন্ট সরকারকে হঠিয়ে যখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিলেন, এই প্রসঙ্গটি তখনকার।
ঢাকাপ্রকাশ-এর পাঠকদের পুরনো সেই ঘটনা একটু মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। ভারতের অন্যতম বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠী টাটা গ্রুপ তথা তাদের কর্ণধার (টাটা সনস-এর চেয়ারম্যান) রতন টাটা চেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার সিঙ্গুরে মধ্যবিত্তদের জন্য গাড়ি (টাটা ন্যানো) তৈরির একটি কারখানা করবেন।
তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার এবং সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাগ্রহে টাটাদের পশ্চিমবঙ্গে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন।
কিন্তু উর্বর কৃষিজমি দখল করে শিল্প গড়া হচ্ছে এই অভিযোগ তুলে রীতিমতো জঙ্গি আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল। এর পরের পর্যায় দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে।
প্রথমত টাটারা বাধ্য হয় সিঙ্গুর ছেড়ে প্রকল্পটি নিয়ে গুজরাতে নরেন্দ্র মোদির রাজ্যে চলে যেতে। সেখানে আনন্দ থেকে পরে ন্যানো গাড়ি বাজারে এসেছিল। আর দ্বিতীয় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট সরকারের পতন।
কিন্তু সেই পুরনো প্রসঙ্গ আবার নতুন করে প্রাসঙ্গিক হল কেন? হলো তার কারণ, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি (গত বুধবার) মন্তব্য করেছেন, টাটাদের আমি সিঙ্গুর থেকে তাড়াইনি। ওদের এই রাজ্য থেকে তাড়িয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারই। তার এই মন্তব্য নিয়েই জলঘোলা শুরু হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী নেতা-নেত্রী, রাজনৈতিক কর্মী, সংবাদমাধ্যম এবং সুশীল সমাজের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, সেদিন কী ঘটেছিল তা এখনো ভুলে যাওয়ার মতো পুরনো হয়নি। সকলেই তা জানে। তাহলে কী এমন কারণ ঘটলো যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমান রাজ্যের রাজনৈতিক চালচিত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক একটি পুরনো ঘটনা তুলে ধরলেন? এবং তাও পুরোপুরি বিকৃত একটি ভাষ্য?
এবার দেখা যাক সেদিনের ঘটনা পরম্পরা কেমন ছিল? গত দু’দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব বাংলা ও ইংরাজি সংবাদমাধ্যমে সেই সময়কার কাগজের ছবি দিয়ে সে কথা লিখেছে। ধিক্কারের বন্যা বয়ে গেছে সমাজমাধ্যমেও। সিঙ্গুর থেকে টাটাদের ন্যানো প্রকল্প সরে যাওয়ার দায় তাঁর নয়। তার জন্য দায়ী তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার।
বুধবার (১৯ অক্টোবর) শিলিগুড়িতে বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠান থেকে এমনই মন্তব্য করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতার দাবি, তৎকালীন শাসক সিপিএম কৃষকদের থেকে জোর করে জমি ছিনিয়ে নিয়েছিল! ক্ষমতায় আসার পর তিনি সেই জমি ফিরিয়ে দিয়েছেন। তার ওই মন্তব্যের জেরে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
প্রসঙ্গত, সিঙ্গুরে ন্যানো প্রকল্পের জন্য ৯৯৭ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন বাম সরকার। তার মধ্যে প্রায় ৪০০ একর জমির দাতা ছিলেন ‘অনিচ্ছুক’।
ইতিহাস বলছে, ২০০৬ সালের ১৮ মে সিঙ্গুরে ছোট গাড়ি তৈরির প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন রতন টাটা। ২৫ মে থেকে ৯৯৭ একর কৃষিজমি অধিগ্রহণের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। তার নেতৃত্বে ছিল বিরোধী তৃণমূল।
গোপালনগর, বেড়াবেড়ি, বাজেমেলিয়া, খাসেরভেড়ি, সিংহেরভেড়িসহ বেশ কয়েকটি আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশি হামলার অভিযোগ ওঠে। আহত হন বেশ কয়েক জন গ্রামবাসীও।
২০০৬-এর ৩০ নভেম্বর সিঙ্গুরে গিয়ে আক্রান্ত হন তৎকালীন বিরোধীনেত্রী মমতা। সেই অশান্তির রেশ এসে পৌঁছায় রাজ্য বিধানসভায়। সেদিন বিরোধী দল তৃণমূলের বিধায়কদের একাংশ বিধানসভার আসবাব ভাঙচুর করেছিলেন বলে বামেদের অভিযোগ।
সিঙ্গুরের ‘অনিচ্ছুক’ কৃষকদের জমি ফেরানোর দাবিতে ২৬ দিন (৩-২৮ ডিসেম্বর, ২০০৬) ধর্মতলার মোড়ে অনশন-অবস্থান করেছিলেন মমতা। তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর তৎপরতায় রাজভবনে আলোচনা হয়েছিল সেই ঘটনা নিয়ে।
মমতার অনশন মঞ্চে এসেছিলেন বিভিন্ন দলের নেতা। সমর্থন এসেছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফেও। অনশন মঞ্চে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও। সকলের সনির্বন্ধ অনুরোধে অনশন প্রত্যাহার করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী।
১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গুরের বাজেমেলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ১৬ বছরের কিশোরী তাপসী মালিকের মৃত্যু ঘিরে রাজনৈতিক চাপান-উতোর শুরু হয়। খুনের জন্য সিপিএমকে দায়ী করে তাপসীর পরিবার এবং তৃণমূল। মে মাসে সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো প্রকল্প রূপায়ণের পথ সুগম করতে তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার। কিন্তু তা সফল হয়নি।
২১ মে রাজ্যের পঞ্চায়েতে ভোটে সিঙ্গুর-সহ বিভিন্ন এলাকায় জয়ী হয় তৃণমূল। আগস্টে নতুন করে শুরু হয় জমিরক্ষা আন্দোলন। ২৪ অগস্ট থেকে টানা ১৫ দিন দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে অবস্থান করেন মমতা। ন্যানো কারখানা রাজ্যের বাইরে সরানোর হুঁশিয়ারি রতন টাটার।
৩ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরে কারখানা নির্মাণের কাজ স্থগিত করে টাটা মোটরস। পাশাপাশিই অন্য রাজ্যে জমির খোঁজ শুরু করে তারা। ৩ অক্টোবর সিঙ্গুর থেকে প্রকল্প সরানোর ঘোষণা করেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার। ৭ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানো হয়, ন্যানো কারখানার পরবর্তী গন্তব্য নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য গুজরাতের সানন্দে। তখন মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী।
এরপর চলে দীর্ঘ মামলা মোকদ্দমা। জমি পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে একদিকে টাটা, অন্যদিকে রাজ্য সরকার। ২০১৬-র ৩১ অগস্ট ঐতিহাসিক রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত ২০০৬ সালের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বাতিল করে জানায়, বাম জমানায় আইন মেনে জমি নেওয়া হয়নি। ১২ সপ্তাহের মধ্যে টাটাকে জমি ফেরানোর নির্দেশও দেওয়া হয়।
২০১৬-র ৩১ অগস্ট ঐতিহাসিক রায় দেয় সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত ২০০৬ সালের জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বাতিল করে জানায়, বাম জমানায় আইন মেনে জমি নেওয়া হয়নি। ১২ সপ্তাহের মধ্যে টাটাকে জমি ফেরানোর নির্দেশও দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১৩ মে মমতার বাংলা জয়ের একাদশ বর্ষপূর্তির আগে সিঙ্গুর নিয়ে ইনস্টাগ্রামে একটি পোস্ট করেন টাটা গোষ্ঠীর ‘চেয়ারম্যান এমিরেটাস’ রতন টাটা।
সেখানে তিনি তার স্বপ্নের ন্যানো প্রকল্প শুরু করার ‘আসল কারণ’ লিখেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে ন্যানো প্রকল্প তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় রতন টাটা আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘‘আমি বলেছিলাম আমার মাথায় বন্দুক ঠেকালেও আমি ন্যানো প্রকল্প ছেড়ে যাব না। কিন্তু মমতা তো ট্রিগারই টেনে দিলেন।’’
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মাথা পর্যন্ত দুর্নীতির অভিযোগে ডুবে রয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্রিসভার নম্বর টু পার্থ চট্টোপাধ্যায় সহ শিক্ষা দফতরের প্রায় সব শীর্ষ স্থানীয় পদাধিকারীরা জেলে রয়েছেন। তার পাশাপাশি কয়লা, গরু পাচার, বালি পাচার, খাদ্যশস্য পাচার, লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি বিক্রিসহ একাধিক অভিযোগের তদন্ত চলছে তৃণমূল সরকারের নেতা ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে।
এমনকি মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার পরিবারের বিরুদ্ধেও চলছে দুই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই এবং ইডি-র তদন্ত। এমন একটা পরিস্থিতিতে মমতার এগারো বছর আগেকার টাটা প্রসঙ্গ উত্থাপন কি মানুষের নজর ঘোরানোর লক্ষ্যেই? উঠছে প্রশ্ন।
এমএমএ/