ফিরে দেখা ২০২১
নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় শি জিনপিং, পরাশক্তির পথে চীন
সম্প্রতি তাইওয়ানকে চীনের অঙ্গীভূত করার ঘোষণা দিয়েছেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং৷ এর আগে বিভিন্ন সময় চীনের পক্ষ থেকে এমন উত্তেজক মন্তব্য করা হলেও, এতটা সামরিক শক্তি প্রদর্শন করেনি বেইজিং। চীনা প্রেসিডেন্টের এ ঘোষণায় শুধু রাষ্ট্র হিসেবে চীনের বিশ্বশক্তি হয়ে উঠার বিষয়টিই সামনে আসেনি, এর মধ্য দিয়ে শি জিনপিং তার নিজের ক্ষমতা আরও নিরঙ্কুশ করছেন। বিশ্লেষকদের মতে, শি জিনপিং নিজের রাজনৈতিক ক্ষমতা আরও সংহত করতেই তাইওয়ানের পথে আরেক ধাপ অগ্রসর হলেন। সেই সঙ্গে আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি আরও স্পষ্ট করছেন শি জিনপিং।
উল্লেখ্য, আজকের চীন নামে সমাজতন্ত্রের কথা বললেও, এর মূল ভিত্তি বাজার অর্থনীতি। চীনের বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা মাও সে-তুঙয়ের নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে বিপ্লব হয়। ক্ষমতায় আসে কমিউনিস্ট পার্টি। এরপর চীন সমাজতন্ত্রের পথে এগোনো শুরু করে। ১৯৭৬ সালে মাও সে-তুঙয়ের মৃত্যু হয়। বদলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। তেং শিয়াও পিংয়ের নেতৃত্বে ১৯৮০’র দশকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি বাজার-অর্থনীতির তত্ত্ব ঊর্ধ্বে তুলে ধরে। তখন থেকে চীন যে সমাজতন্ত্রের কথা বলছে, তাকে তারা ব্যাখ্যা করেছে চীনা বৈশিষ্ট্যের সমাজতন্ত্র, যার মূল ভিত্তি বাজার অর্থনীতি।
এ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর গড়ে উঠে দুর্নীতির আধিপত্য। আর দুর্নীতিবিরোধী প্রচারই ছিল চীনের বর্তমান শাসক শি জিনপিংয়ের মূল হাতিয়ার। যাকে ভিত্তি করে ক্রমাগত ভিন্নমত দমনের পথে এগিয়েছেন তিনি। পরবর্তী সময়ে শি ভূরাজনীতির উপর ভিত্তি করে আন্তর্জাতিক মহলে নিজের প্রভাব বলয় বিস্তৃত করেছেন। চীনকে পরাশক্তি হিসেবে গড়ে তোলার পথে তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করার ক্ষেত্রেও এগিয়েছেন বহুদূর। যেখানে দালিলিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ‘শি জিনপিং চিন্তাধারা’।
গত ১১ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার) এশিয়া-প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন সম্মেলনের ফাঁকে এক ভার্চুয়াল বিজনেস কনফারেন্সে শি জিনপিং বলেন, ভূরাজনৈতিক স্বার্থের ভিত্তিতে ছোট জোট গঠনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে বাধ্য। এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত আবার ফিরিয়ে আনা উচিত নয় বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দেন। সেইসঙ্গে করোনা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বৃহৎ পরিসরে আন্তঃসহযোগিতার আহ্বানও জানান।
উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে টিকা আরও সহজলভ্য করে টিকাদানে বৈষম্য দূর করতে যৌথ প্রচেষ্টার আহ্বান জানান চীনের প্রেসিডেন্ট। আর স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে টিকা প্রাপ্তি যত কঠিন হচ্ছে, ততই টিকা প্রাপ্তি সহজ করছে চীন। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন টিকার বাজারে অন্যতম অংশীদার হয়ে উঠেছে চীন; সেইসঙ্গে রয়েছে এর সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক প্রভাব।
সম্প্রতি অকাস, কোয়াডের মতো জোট গঠন করে চীনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে এসব জোটের বিপরীতে চীন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সংহত করার দিকে এগিয়েছে। চীনা বিনিয়োগ ও ঋণের সঙ্গে এবার নতুন যোগ হয়েছে চীনা টিকা। আর এগুলোকে একটি আদর্শ ও আগ্রাসী প্যাকেজ আকারে বিলিয়ে নিজের শক্তির জানান দেওয়ার পথে এগুচ্ছে শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বাধীন চীন।
একচ্ছত্র আধিপত্য
২০১২ সালে শি জিনপিং দলের নেতা ও চীনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপরই তিনি দেশের অভ্যন্তরে ভিন্নমত দমন এবং বহির্বিশ্বে চীনকে পরাশক্তি হিসেবে দাঁড় করানোর তোড়জোর শুরু করেন।
২০১৮ সালে চীনের সংবিধানে শিন জিনপিংয়ের ‘নতুন জামানায় চীনা বৈশিষ্ট্যের সমাজতন্ত্র ও এ সম্পর্কিত ভাবনা’ রচনাবলী অন্তর্ভুক্ত হয়। সিপিসির কর্মীদের জন্য সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা কার্ল মার্ক্স, ভ্লাদিমির লেনিন, মাও সে-তুঙ-এর রচনাবলী পড়ার পাশাপাশি জিনপিংয়ের প্রবন্ধ অধ্যয়নও বাধ্যতামূলক করা হয়।
২০২০ সালে চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টিতে ২৪ লাখ ৩০ হাজার নতুন সদস্য যুক্ত হন। ২০১৩ সালে শি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে গত বছরই সবচেয়ে বেশি লোক দলটিতে যোগ দিয়েছেন। এখন দলটির সদস্য সংখ্যা ৯ কোটি ৫১ লাখ ৫০ হাজার বলে গত আগস্টে প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে।
দেশটিতে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের রেওয়াজ থাকলেও সম্প্রতি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিসি) প্লেনামে ১৫ বছর মেয়াদি কর্মসূচির কথা জানিয়েছেন শি। কার্যত এর মধ্য দিয়ে ওই সময়কাল পর্যন্ত তার ক্ষমতায় থাকার বাসনাই প্রকাশিত হয়েছে। শুধু অর্থনীতি বা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেই নয়; শি জিনপিং নিজেকে ‘মহান নেতা’ হিসেবে দেখাতে শিশু-কিশোর-তরুণদের মস্তিষ্কে তার বক্তব্য ঢোকাতেও কাজ করে যাচ্ছেন। যা তার ক্ষমতা আরও সংহত করতে কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ২৪ আগস্ট (মঙ্গলবার) এক বিবৃতিতে চীনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, তরুণ প্রজন্মের মনে দেশপ্রেম দৃঢ় করতে এবং সিপিসির প্রতি আনুগত্য বাড়াতে দেশের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের রচনাবলী ‘নতুন জামানায় চীনা বৈশিষ্ট্যের সমাজতন্ত্র ও এ সম্পর্কিত ভাবনা’র বিভিন্ন প্রবন্ধ অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
উগ্র-জাতীয়তাবাদে সংখ্যালঘু নির্মূলীকরণ
চীনের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কথিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল শিনজিয়াং। বেশ কয়েক বছর ধরেই সেখানে উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে। এটিকে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হিসেবে উল্লেখ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা। জুন মাসে বিশ্বের সাত বড় অর্থনীতির জোট জি-৭ থেকেও চীনের প্রতি এ সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়েছে।
শিনজিয়াংয়ের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে মঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও ভারতের। তাই বিশ্বব্যাপী তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লেও, চীন এ প্রশ্নে রাষ্ট্রবাদকে জাতীয়তাবাদের মোড়ক দিয়ে নিজের অবস্থানকে সঠিক হিসেবে তুলে ধরছে।
শিনজিয়াংয়ে চীন সরকারের দমন-পীড়নের কারণে উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জনসংখ্যার ওপর প্রভাব বিশ্লেষণ করে জার্মানির গবেষক অ্যাডরিন জেনজ ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানান, চীনা সরকারের নতুন কাঠামোগত নিপীড়নে আগামী ২০ বছরে এ অঞ্চলে উইঘুরদের জনসংখ্যা হতে পারে ৮৬ লাখ থেকে এক কোটি পাঁচ লাখ। এখন তাদের জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি ২০ লাখ।
এক গবেষণায় জেনজ দেখিয়েছেন, উইঘুরদের বিষয়ে চীন সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে। সেখানকার নারীরাই শি জিনপিং সরকারের মূল লক্ষ্য। ২০১৯ সালের মধ্যে শিনজিয়াং কর্তৃপক্ষ সেখানকার চারটি সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর জবরদস্তিমূলক জন্ম নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ জন্য সন্তান জন্মদানে সক্ষম ৮০ শতাংশ নারীকে জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা ধরনের সার্জারি ও বন্ধ্যত্বকরণ কর্মসূচি নেওয়া হয়। চীনের ফাঁস হওয়া সরকারি নথিতে দেখা যায়, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে শিনজিয়াং প্রদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মহার প্রায় ৪৯ শতাংশ কমেছে।
অপরদিকে, অন্য অঞ্চল থেকে হান জাতিসত্তার মানুষদের এনে সেখানে সেটেলার বসতি নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে উইঘুর ও অন্যান্য জাতিসত্তাকে সংখ্যাগত পরিমাপে আরও ছোট করে ফেলা হচ্ছে। চীন সরকারের নতুন নীতির কারণে শিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুরদের জনসংখ্যা কমলেও হান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়বে। কারণ চীন সম্প্রতি এক সন্তান নীতি থেকে তিন সন্তান নীতি গ্রহণ করেছে।
চীনের জাতিগত নিপীড়নের বিষয়টি সম্প্রতি সামনে এনেছে লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তারা বলেছে, ‘ভয়ংকর দুর্ভোগের’ মধ্যে বসবাস করছে, সেখানকার বাসিন্দারা। অ্যামনেস্টি ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত গবেষণা করেছে। তারা ১২৮ জনের সাক্ষাৎকার নিয়েছে। তার মধ্যে ৫৫ জন চীনের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ছিলেন। আর ৬৮ জন সেসব পরিবারের সদস্য, যে পরিবার থেকে কেউ হারিয়ে গেছেন বা তাদের আটক করা হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। রিপোর্ট বলছে, শিনজিয়াংয়ে ১০ লাখের বেশি মানুষকে বন্দিশিবিরে পাঠানো হয়েছে। অন্যদের ভয় দেখানোর জন্য চীন তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সাইটগুলোও বন্ধ করে দিয়েছে। গত ১০ জুন এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
কোন পথে এগোচ্ছেন শি
যদিও ভূরাজনীতিতে ক্রমাগত জায়গা হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র; তবুও এখন পর্যন্ত বিশ্বে পরাশক্তির এক নম্বর স্থান তাদেরই দখলে। তবে শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বাধীন চীন এ ভূমিকায় উঠে আসতে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। শি জিনপিং এরই মধ্যে পরাশক্তি হয়ে ওঠার লক্ষ্যও নির্ধারণ করেছেন।
কয়েক বছর আগেও মার্কিন বিশেষজ্ঞদের অনেকেই চীনকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে একটি পার্শ্ব চরিত্রের ভূমিকায় ভাবতেন। অথবা একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আমলে নিতেন; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আধিপত্যের লড়াইয়ে যাবে না বলে মনে করতেন। তবে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সঙ্গে সরাসরি নেতৃত্বের লড়াইয়ে নামার বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য নিয়েই চীনের বর্তমান সব কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। দুটি পথ ধরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছানোর সুযোগ রয়েছে চীনের।
প্রথমটি হলো যুক্তরাষ্ট্র মডেল। এ পথটি চীনের আশপাশ, বিশেষ করে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হবে। অর্থাৎ, নিজ অঞ্চলে আধিপত্য অর্জন করে এরপর ধীরে ধীরে এগোতে হবে দেশটিকে; যেমনটি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় পথটি প্রথমটির তুলনায় একেবারেই ভিন্ন। কারণ এ পথে কৌশলগত ঐতিহাসিক আইন-কানুন ও ভূরাজনীতিকে তোয়াক্কা করা হবে না। এ ক্ষেত্রে চীনকে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অপ্রতিরোধ্য শক্তিমত্তার অবস্থান তৈরিতে গুরুত্ব কম দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের নিজেদের কাছে টানার ওপর জোর দিতে হবে। শুধু তা-ই নয়, চীনকে তার অবস্থান পোক্ত করতে হবে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে। এখন প্রশ্ন হলো চীন কোন পথ গ্রহণ করছে।
নতুন প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, প্রথমে আঞ্চলিক পর্যায়ে আধিপত্য স্থাপনের পর বৈশ্বিকভাবে প্রভাবশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে চীনকে। তবে এ আধিপত্য স্থাপনের অর্থ কোনো দেশকে জোরপূর্বক দখল নয়। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কার্যকর প্রভাব বিস্তারের অধিকার অর্জন করতে হবে। এ ছাড়া অঞ্চলটিতে থাকা মার্কিন মিত্র জোটের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করতে হবে ও চীনের উপকূল থেকে মার্কিন সামরিক শক্তিকে ফেরত পাঠাতে হবে। চীন যদি এসবের কিছু করতে না পারে, তাহলে আঞ্চলিক পরিসরে নিজেকে শক্তিশালী অবস্থানে নিতে পারবে না। ফলে আন্তর্জাতিকভাবে পরাক্রমশালী হয়ে ওঠার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের যে শক্তি বা ক্ষমতা, তা দেশটির আধিপত্যশীল আঞ্চলিক অবস্থানের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। চীন সে পথেই হাঁটছে। এরই মধ্যে চীনা কর্মকর্তারা ‘এশিয়ানদের জন্য এশিয়া’ এ স্লোগান বাস্তবায়নে মনোযোগ দিয়েছে। অর্থাৎ, এ অঞ্চলে কোনো সমস্যা হলে, তা নিজেরাই সমাধান করবে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মধ্যস্ততা থাকবে না। এ ছাড়া তাইওয়ানকে আয়ত্তে আনতে সামরিক শক্তিও বাড়িয়ে চলেছে পিপলস লিবারেশন আর্মি। আর এটি সম্ভব হলে পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন একচ্ছত্র আধিপত্য প্রশ্নের মুখে পড়বে। এর মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রভাব বাড়বে অবধারিতভাবে।
গত ৯ অক্টোবর (শনিবার) সর্বশেষ রাজবংশের পতনের বার্ষিকী উপলক্ষে রাজনীতিবিদ, সামরিক কর্মকর্তা ও সুধীসমাজের লোকজনের সামনে চীনের বিখ্যাত ‘গ্রেট হল অব দ্য পিপলে’ দেওয়া ভাষণে চীনা প্রেসিডেন্ট তাইওয়ানে স্বাধীনতা আন্দোলনকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ উল্লেখ করে বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতা দমনে চীনের গৌরবময় ঐতিহ্য আছে৷ এটি পুনরেত্রীকরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা এবং পুনঃশক্তিসঞ্চারের পথে লুকিয়ে থাকা একটি মহাবিপদ৷ জাতীয় নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় চীনের জনগণের যে দৃঢ় সংকল্প, তীব্র ইচ্ছা ও সামর্থ্য রয়েছে, তাকে খাটো করে দেখা উচিত নয়৷ মাতৃভূমির পূনরেকত্রীকরণের যে ঐতিহাসিক প্রচেষ্টা তা অবশ্যই পূরণ হবে এবং এটি হতেই হবে।’
এবারই প্রথম শি জিনপিং তাইওয়ান প্রশ্নে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন, তা নয়। বরং সাম্প্রতিককালে এ অসহিষ্ণুতা ক্রমাগত বেড়েছে। এর আগে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ১০০ বছর উদযাপন উপলক্ষে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, ‘তাইওয়ান চীনের অংশ। মূল চীন থেকে তাকে যদি কেউ আলাদা করতে চায়, তাহলে শাস্তি পেতে হবে।’ ওই আগ্রাসী ভাষণে তিনি আরও বলেন, ‘এক সময় চীনের মানুষদের হত্যা করা হতো। তাদের নিয়ে হাসাহাসি করা হতো। সে যুগ চলে গেছে। ১৪০ কোটির দেশের বিরুদ্ধে কেউ সে কাজ করার চেষ্টা করলে তার মাথা ভেঙে দেওয়া হবে। গ্রেট ওয়াল অব স্টিলে মাথা থেতলে দেওয়া হবে।’
নিউ লং মার্চ
উচ্চ প্রযুক্তি সম্পন্ন সামরিক প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রই এগিয়ে আছে এবং খুব সহজেই চীন তা ছাড়িয়ে যেতে পারছে না। তাই সঙ্গী করতে হচ্ছে রাশিয়াকে।
আর তাই চীন পশ্চিমের পরিবর্তে পূর্বের দিকে বেশি ধাবিত হচ্ছে। ইউরোশিয়ার বিশাল ভূখণ্ড ও ভারত মহাসাগর পর্যন্ত চীনকে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকায় আসতে চাইছে চীন। এশিয়া থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বিতাড়িত করা অথবা মার্কিন নৌবাহিনী থেকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল মুক্ত করতে পারবে না চীন এমন বিষয় মেনে নিয়েই বৈশ্বিক অর্থনৈতিক নীতিমালা, প্রযুক্তির মান ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ ও নিজেদের ভাবমূর্তি উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে।
এরই মধ্যে ইউরেশিয়া ও আফ্রিকাজুড়ে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ শুরু করেছে চীন। অর্থায়ন সহযোগিতার মাধ্যমে বেশ কয়েকটি মহাদেশকে সংযুক্তকারী এ ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক নির্মাণযজ্ঞের কেন্দ্রে অবস্থান করছে চীন। আবার চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ২০১৭ সালের কংগ্রেসে ‘সাইবার সুপার পাওয়ার’ হয়ে ওঠার যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, ‘ডিজিটাল সিল্ক রোড’ তারই উন্নত রূপ। চীনা প্রযুক্তির বিকাশ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোয় পরিচালকের ভূমিকায় আসীন হওয়া ও চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি বাণিজ্যিক সুবিধা নিয়ে আসাই এ ডিজিটাল সিল্ক রোডের অন্যতম উদ্দেশ্য।
দেশকে পরাশক্তির ভূমিকায় পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে শি জিনপিংয়ের পক্ষ থেকে প্রথম ঘোষণাটি আসে ২০১৭ সালে। সে সময় তিনি বলেন, চীন একটি ‘নতুন যুগে’ প্রবেশ করেছে এবং তারা অবশ্যই ‘বিশ্বে একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকবে’। এর দুই বছর পর ওয়াশিংটনের সঙ্গে বেইজিংয়ের নাজুক সম্পর্ক বোঝাতে প্রেসিডেন্ট শি ‘নিউ লং মার্চ’ আইডিয়াকে ব্যবহার করেন। আর এ কথিত লং মার্চে সামরিক ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের বিষয়টিকেই উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল- এ চার বছরের মধ্যে জার্মানি, ভারত, স্পেন ও ব্রিটেনের সম্মিলিত সংখ্যার চেয়েও বেশি জাহাজ সমুদ্রে ভাসিয়েছে চীন। এ ছাড়া ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে নিজেদের অগ্রাধিকার ধরে রাখতে উচ্চপ্রযুক্তি শিল্পে আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে দেশটি। উপকূলবর্তী গুরুত্বপূর্ণ নৌপথগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেও নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে তারা।
এশিয়া-ভূমধ্যসাগরসহ অন্যান্য অঞ্চলেও অর্থনৈতিক প্রভাব বিস্তারে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেইজিং। শি জিনপিং প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে দেশটির সামাজিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সিপিসির উপস্থিতি ও নিয়ন্ত্রণ আরও বেড়েছে।
আগ্রাসী অর্থনীতির পাশাপাশি নানারকম উদ্ভাবনে বিপুল পরিমাণ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের সুবাদে কৃত্রিম মেধা থেকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজির মতো ভিত্তিগত প্রযুক্তিগুলোয় নেতা হয়ে উঠতে পারে চীন।
তবে পরাশক্তি হয়ে উঠতে যে দুটি পথের কথা উল্লেখ করা হলো, শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীন কার্যত এর এক মিশ্রণের মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে। চীনকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা চলছে, তা শুধু অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে নয়। এর রাজনৈতিক-মতবাদিক দ্বন্দ্বও গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সরকার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতেই ক্ষমতাধর কর্তৃত্ববাদী চীনা শাসকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে বাধ্য। তবে ইদানীং যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ বিশ্বব্যাপী যে উগ্র-ডানপন্থার উত্থান ঘটছে, সেখানে পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার দ্বন্দ্বই প্রধান হয়ে উঠেছে। আর বেইজিং যে তার লক্ষ্য থেকে সরে আসছে না, তা বলাই বাহুল্য।
এসব বিষয় বিচারে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় শি জিনপিং এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বই শুধু নন; তিনি সবচেয়ে শক্তিশালীও বটে!
এসএ/এসএন/