ফিরে দেখা ২০২১
ইসরায়েল-আরব বন্ধুত্ব বিপাকে ফিলিস্তিন
সময়টা ১৯৪৮ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলার বাহিনীর পরাজয় ঘটে। এই যুদ্ধে বেশ ক্ষতি হয় বৃটেনেরও। অর্থনৈতিক মন্দা আবার রাজনৈতিক অস্থিরতা সব মিলিয়েই বৃটেন আস্তে আস্তে নিজের কলোনি সবখান থেকেই গুটিয়ে নেয়। বৃটেন সেবার ফিলিস্তিনি এবং ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্র দেওয়ার কথা বলে ফিলিস্তিন অঞ্চলের কর্তৃত্ব ছেড়ে দেয়। কিন্তু বৃটিশরা দেশ ভাগ করে দিয়ে যায় না। তারা এর দায়িত্ব দেয় জাতিসংঘকে।
জাতিসংঘই তখনই ফিলিস্তিন অঞ্চলকে দুই ভাগ করে দুটি দেশ করে দেয়। যেখানের প্রায় ৫৫ শতাংশ দেওয়া হয় ইহুদিদের এবং প্রায় ৪৫ শতাংশ দেওয়া হয় ফিলিস্তিনের। এবং এটাও বলা হয় যেহেতু জেরুজালেম ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমান তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ভূমি তাই এর ক্ষমতা দুই দেশের কারো কাছেই থাকবে না। এর কর্তৃত্ব থাকবে জাতিসংঘের কাছে। ইহুদিরা জাতসংঘের এই প্রস্তাব মেনে নেয় এবং ১৪ মে ১৯৪৮ সালে দেশের নাম ইসরাইল রেখে নিজেদের দেশের যাত্রা শুরু করে। এভাবেই তৈরি হয় ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্বে সূত্রপাত।
অতীতে দেখা গেছে যদি কোনো ইসরায়েলি সরকার অধিকৃত পশ্চিম তীরের জমি অধিগ্রহণের ঘোষণা দিত, আরব বিশ্বের দেশগুলোতে প্রতিবাদের ঝড় উঠতো। কিন্তু চলতি বছরের জুন মাসে যখন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহু পশ্চিম তীরের জর্ডান উপত্যকার একটি অংশকে নিজের দেশের অংশ করে নেয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, অবাক হলেও সত্য যে আরব দুনিয়ায় তেমন কোন প্রতিবাদ বা উচ্চবাচ্যই শোনা যায়নি।
ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র তৈরির শেষ সম্ভাবনাও নস্যাৎ হয়ে যাবে-ফিলিস্তিনিদের কাছ থেকে বারবার এই আশঙ্কা জানানো হলেও, সৌদি আরব এবং তার আরব মিত্ররা চুপচাপ ছিল। এ ঘটনার দু’মাস না যেতেই দুটি উপসাগরীয় আরব রাজতন্ত্র ইসরায়েলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করে ফেলে।
এদিকে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সুসম্পর্কের কারণে ফিলিস্তিনিরা আরবদের কাছে প্রতারিত হয়েছে বলে মনে করছে। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের মনোভাব এখন আরব বিমুখী।
এর আগে ইউএই এবং বাহরাইন ওয়াশিংটনে গিয়ে চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সেদিনই বিনইয়ামিন নেতানিয়াহুকে পাশে নিয়ে দাবি করেন যে আরো অন্ততঃ পাঁচটি আরব দেশ ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। হতাশ, ক্রুদ্ধ ফিলিস্তিনিরা দেখছে যে গত অর্ধ শতাব্দী ধরে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব ঘুচিয়ে স্বাধীন একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রতি পুরো আরব বিশ্বের যে ঐক্যবদ্ধ সমর্থন, তাতে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। তথ্য সূত্র বিবিসি।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির বিশ্লেষকদের মধ্যে এখন আর তেমন কোনো সন্দেহ নেই যে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা-সংগ্রাম এখন আরব বিশ্বের অনেকগুলো দেশে অগ্রাধিকারের তালিকায় ক্রমশঃ নিচে নামছে। আরব বসন্তের ধাক্কা, সিরিয়া-লিবিয়া-ইয়েমেন-ইরাকে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের হুমকি, তেলের দাম পড়ে যাওয়া-এসব কারণে অনেক আরব সরকার অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে এখন এতটাই ব্যতিব্যস্ত যে ফিলিস্তিন ইস্যু তাদের কাছে এখন আর বড় কোনো এজেন্ডা নয়। পশ্চিম তীরের নাবলুসের কাছে একটি ইহুদি বসতির বাইরে সৈন্যদের দিকে ইট ছুঁড়ছে ফিলিস্তিনী কিশোর-তরুনরা। অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতির জনসংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে।
প্রয়াত সৌদি বাদশাহ আব্দুলাহ’র উদ্যোগে ২০০২ সালে ২২টি আরব দেশ একযোগে ঘোষণা দেয় যে যতক্ষণ না ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা ফিলিস্তিনি জমি ছেড়ে দিয়ে পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী মেনে নিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা না করতে দিচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আরব-ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। মোহামেদ এয়াহিয়া বলেন, সৌদি আরব নিজেরাই তাদের সেই উদ্যোগকে দুর্বল করে দিয়েছে।
তার প্রথম প্রকাশ্য ইঙ্গিত পাওয়া যায় যখন ২০১৮ সালের এপ্রিলে যখন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে মার্কিন ইহুদি নেতাদের সাথে এক বৈঠকে খোলাখুলি ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের কড় সমালোচনা করে বলেন, দাবি-দাওয়া নিয়ে তাদের নমনীয় হতে হবে। ওই বৈঠক নিয়ে সে সময়কার বিভিন্ন মিডিয়া রিপোর্টে লেখা হয়, যুবরাজ বিন সালমান খোলাখুলি বলেন, ফিলিস্তিন সঙ্কটের সমাধান সৌদি আরব চায়, কিন্তু ‘ইরানের মোকাবেলা এখন তাদের কাছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার।‘ তথ্য সূত্র বিবিসি
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতি এবং মুসলিম দুনিয়ার নেতৃত্ব নিয়ে টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে আরব দেশগুলো এখন কয়েকটি গ্র“পে জোটবদ্ধ হয়ে পড়েছে, যা ইসরায়েলকে তার রাজনৈতিক ইচ্ছা হাসিলে অনেক সুবিধা করে দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সান-ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং পশ্চিম এশিয়া বিশেষজ্ঞ আহমেদ কুরুবলেন, আরব দেশগুলোর মধ্যে এখন যে বিভক্তি এবং বিরোধ তা সা¤প্রতিক ইতিহাসে আর দেখা যায়নি।
লন্ডনে গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ এল-দাহশান বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে এক সময় ফিলিস্তিনি ইস্যুতে আরব দেশগুলোর রাস্তায় যতটা আবেগ চোখে পড়তো, এখন ততটা নেই। একটি কারণ, তার মতে, আরব দেশগুলোকে নতুন একটি প্রজন্মের মধ্যে ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের ইতিহাসের প্রত্যক্ষ কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ফলে, তাদের বাবা-দাদাদের ফিলিস্তিন নিয়ে যতটা আবেগ আছে, তাদের মধ্যে ততটা নেই। ’কিন্তু তাই বলে আবেগ পুরোপুরি চলে যাচ্ছে, তা কোনভাবেই তা বলা যাবে না। আপনি যদি এখনও আমার জন্মস্থান মিশরে যান, দেখতে পাবেন ছোটো একটি শহরে হয়ত স্থানীয় কোনো ইস্যুতে মানুষজন জড় হয়ে প্রতিবাদ করছে এবং তাদের কয়েকজনের হাতে ফিলিস্তিনি পতাকা। ওই জমায়েতের সাথে ফিলিস্তিনের কোন সম্পর্কই হয়ত নেই, কিন্তু তাদের হাতে সেই পতাকা।’ তথ্য সূত্র বিবিসি