মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত ৫ চিকিৎসকসহ গ্রেফতার ৯
প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত ৫ চিকিৎসকসহ গ্রেফতার ৯। ছবি: সংগৃহীত
মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৫ চিকিৎসকসহ নয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
বৃহস্পতিবার (১৪ ডিসেম্বর) সিআইডির মিডিয়া কর্মকর্তা পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। গত ১১ থেকে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিক অভিযানে রাজধানীসহ দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা দিনাজপুর, নীলফামারীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের গ্রেফতার করে সিআইডি। এসময় তাদের কাছ থেকে ৯টি মোবাইল ফোন, ২টি ল্যাপটপ, বিভিন্ন ব্যাংকের চেক ও চেকবই, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদেরকে মিরপুর থানায় চলতি বছরের জুলাই মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দায়েরকৃত মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলেও নিশ্চিত করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রয়েছে মো. সাজ্জাদ হোসেন, ডা. ফয়সাল আহমেদ রাসেল, রায়হানুল ইসলাম সোহান, বকুল রায় শ্রাবণ, মো. আবদুল হাফিজ ওরফে হাপ্পু, ডা. মো. সোহানুর রহমান সোহান এবং ডা: তৌফিকুল হাসান রকি। এছাড়া ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে ডা. ফয়সাল আলম বাদশা ও ডা. ইবরার আলম।
সিআইডির মিডিয়া কর্মকর্তা পুলিশ সুপার আজাদ রহমান বলেন, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে চক্রের মূলহোতা দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার সিংড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেন, নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার বিটস কোচিংয়ের পরিচালক আবদুল হাফিজ ওরফে হাপ্পু এবং পাঁচ চিকিৎসকসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃত আসামিরা মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে। গ্রেফতারকৃত আসামিদের কাছে থেকে চক্রের অন্যান্য সদস্য ও অসাধু উপায়ে বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া অসংখ্য শিক্ষার্থীর নাম পাওয়া গেছে। এর আগে এ চক্রের মাস্টারমাইন্ড জসীম উদ্দিন ভূইয়া মুন্নুর কাছে থেকে উদ্ধার হওয়া গোপন ডায়েরি থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা চক্রের সদস্যদের সন্ধান পায় সিআইডি।
আজাদ রহমান বলেন, এই চক্রটি ২০১০ সাল থেকে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িত। চক্রটির মাস্টার মাইন্ড জসীমের গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী সাজ্জাদ ২০১৭ সালের মেডিকেল প্রশ্নফাঁসের অন্য আরেকটি মামলারও এজাহারনামীয় আসামি। সাজ্জাদ উত্তরবঙ্গের অসংখ্য শিক্ষার্থীকে অনৈতিক উপায়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়ে কোটি টাকার উপরে আয় করেছেন। পূর্বে গ্রেফতারকৃত একাধিক আসামি ১৬৪ এ সাজ্জাদের নাম বলেছে এবং জসীমের গোপন ডায়েরিতেও তার নাম ও ফোন নাম্বার পাওয়া গেছে।
গ্রেফতারকৃত আবদুল হাফিজ ওরফে হাপ্পু নীলফামারির সৈয়দপুর উপজেলার বিটস নামের একটি কোচিং সেন্টারের পরিচালক। এছাড়াও তিনি একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিক। ডা. জিল্লুর হাসান রনির মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি তার কোচিংয়ের শিক্ষার্থীদের অনৈতিক উপায়ে মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। ইতোমধ্যে তাদের বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করেছে সিআইডি।
গ্রেফতারকৃত ডা. সোহানুর রহমান সোহান বিট’স কোচিং সেন্টারের পরিচালক আবদুল হাফিজ ওরফে হাপ্পুর কাছ থেকে ২০১৩ সালে প্রশ্ন পেয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল ভর্তি হন। বর্তমানে বিসিএস স্বাস্থ্য কর্মকর্তা হিসেবে পার্বতীপুরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত রয়েছেন তিনি।
গ্রেফতারকৃত ডা. ফয়সাল আহমেদ রাসেল চেয়ারম্যান সাজ্জাদ হোসেনের মাধ্যমে ২০১০ সালে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পেয়ে জাতীয় মেধায় ১১তম স্থান লাভ করেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এরপর যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে দিনাজপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ে সার্ভেইলান্স মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগ দেন। ডা. ফয়সাল পরবর্তীতে প্রশ্নফাঁস ব্যবসার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়েন।
গ্রেফতারকৃত ডা. তৌফিকুল ইসলাম রকি পূর্বে গ্রেফতারকৃত আসামি ডা. জিল্লুর হাসান রনির গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ছিলেন। তারা দুজনই রংপুর মেডিকেল থেকে পাশ করেছেন। সেই সুবাদে প্রশ্নফাঁসের ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। রকি বিট’স কোচিংয়েও ক্লাস নিতেন। রকি, হাপ্পু এবং রনি মিলে অনৈতিক উপায়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন মেডিকেলে ভর্তি করিয়েছেন। ডা. রনি তার জবানবন্দিতে ডা. রকির কথা বলেছেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা গ্রেফতারকৃত আসামি ডা. ইবরার আলমও ডা. জিল্লুর হাসান রনির সহযোগী ছিলেন। তার কথাও ডা. রনি জবানবন্দিতে বলেছেন। ইবরার ২০১৩ এবং ২০১৫ সালের ভর্তি পরীক্ষার আগের রাতে ডা. রনির মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে তা সরবরাহ করেছিলেন। এদের অনেকেই বিভিন্ন মেডিকেলে চান্স পেয়েছে।
গ্রেফতারকৃত আসামি রায়হানুল ইসলাম সোহান এবং বকুল রায় শ্রাবণ দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার বাসিন্দা। দুজনই একই স্কুলে পড়ার সুবাদে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। রায়হানুল ২০১৫ সালে তার এক মামার মাধ্যমে মেডিক্যালের ফাঁসকৃত প্রশ্ন পায় এবং বকুলকে তা সরবরাহ করে। বকুল তার ৪ ভর্তিচ্ছু ছোট ভাইয়ের কাছে সেই প্রশ্ন বিক্রি করে। ৪ জনই দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে চান্স পেয়েছে।
গ্রেফতারকৃত ডা. সাইফুল আলম বাদশা ২০১০ সালে সাজ্জাদ হোসেনের মাধ্যমে প্রশ্ন পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এরপর প্রশ্নফাঁস ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে তিনি একাধিক শিক্ষার্থীকে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে মেডিকেল ভর্তি করিয়েছেন।
এর আগে দেশে বিগত ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বছরে ১০ বার মেডিকেল ভর্তির প্রশ্নফাঁস করেছে একটি চক্র। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন মেডিকেল ভর্তির কোচিং সেন্টারের আড়ালে প্রশ্নফাঁসের কারবার চালিয়ে আসছিলেন বলে জানিয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে চক্রটি প্রতি বছর গড়ে ১৫০ জনের মতো শিক্ষার্থীকে দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে ভর্তি করিয়েছে। অর্থাৎ দেশে ফাঁস হওয়া প্রশ্নে বিগত ১৬ বছরে দেড় হাজার ডাক্তারেরও বেশি চিকিৎসক বের হয়েছেন। যারা বর্তমানে চিকিৎসা সেবার সাথে যুক্ত রয়েছেন। তবে, প্রশ্নফাঁস করে মেডিকেলে ভর্তি হয়েছেন এমন শতাধিক শিক্ষার্থীর নাম পাওয়ার কথা জানিয়েছে সিআইডি। চক্রের সদস্যদের ধরতে বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা এবং গ্রেপ্তার অব্যাহত রেখেছে সিআইডি।