ঢাকা মেডিকেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ভোগান্তিতে রোগীরা
ভালো চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রোগীরা আসছেন। তারা বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তারদের কাছে গেলে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ে এমআরআই, এক্সরে, সিটি স্ক্যান, আলট্রাসনোগ্রামসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করতে নির্দেশনা দিচ্ছেন।
কিন্তু রোগীরা ফি জমা থেকে শুরু করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গায় চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে যে যার মতো আগে ঢুকে সেবা নিচ্ছেন। আর এমআরআই’র জন্য দীর্ঘ লাইন থাকলেও দিনে তিন-চারটা বেশি করা হচ্ছে না। এর ফলে কেউ সপ্তাহ কেউবা মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করছেন রোগ বালাই সঙ্গে নিয়ে। অনিশ্চয়তার মাধ্যমে দিন পার করছেন রোগীরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, ভালো সেবার জন্য দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে এসে পদে পদে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগ ও প্যাথলজি বিভাগে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে আসা বিভিন্ন রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
ঢাকা মেডিকেলের নতুন বিল্ডিংয়ের রেডিওলজি বিভাগে সকাল ১০টার দিকে দেখা যায় হুইল চেয়ারে বসা কবির হোসেন, বয়স ৫৯ বছর। চুয়াডাঙ্গা থেকে এসেছেন। বিভিন্ন সমস্যার কারণে ডাক্তার সিটিস্ক্যান করতে বলেছেন। তিনি সিটি স্ক্যান করেছেন ঠিকই। তবে এজন্য অনেক বেগ পেতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তার স্ত্রী জান্নাতুন।
পাশের রুমে এমআরআই করা হচ্ছে। এ সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা রফিকুল ইসলাম ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, ‘আমার স্ত্রীকে নিয়ে পঙ্গু হাসপাতাল, বারডেম ঘুরে শেষে ভালো চিকিৎসার আশায় ঢাকা মেডিকেলে এসেছি। আমার স্ত্রী সোজাভাবে দাঁড়াতে পারে না। তাই ডাক্তারকে দেখিয়েছি। এমআরআই করতে বলেছেন। কয়েকদিন অপেক্ষা করে আজ সিরিয়াল পেয়েছি। কিন্তু ঘণ্টাখানেক হয়ে গেল, এখনো ভেতরে যেতে পারিনি।
এত দেরি কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তিন থেকে চারটার বেশি এমআরআই করে না। তাই অনেক সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এ সময় জাহিদ নামে একজন স্টাফ বলেন, দিনে তিন-চারটার বেশি এমআরআই হয় না। সিটি স্ক্যান সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে। কিন্তু এমআরআই সেভাবে হয় না। ডাক্তারদের সুপারিশে এমআরআই করা হয় এখানে। এ ছাড়া ভর্তি রোগীদেরও করা হয়। যারা আগে থেকে সিরিয়াল দিয়েছেন তারাই সুযোগ পাবেন। টাকা জমা দিলেও এর বেশি হবে না, আবার কালকে তাদের আসতে হবে।
এ সময় কুমিল্লা থেকে আসা হাফেজা বেগম বলেন, ভালো হওয়ার জন্য ডাক্তার দেখিয়েছি। এমআরআই করতে হবে। এখানে বৃহস্পতিবার এসেছিলাম। তারা বলেছে, আজকে আসতে, এমআরআই করতে এসেছি। কিন্তু ডাকছে না এখনো। এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। কখন ডাকবে তাও জানিনা। এখনো টাকা জমা নেয়নি। তাই হবে কিনা জানিনা। এভাবেই দুশ্চিন্তার কথা জানান হাজেরা বেগম।
রেডিওলোজি বিভাগের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হচ্ছে এক্সরে। বিভিন্ন এলাকা থেকে এক্সরে করতে এসেছেন অনেকেই। এসময় কাচপুর থেকে আসা ৬০ বছরের নজরুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে যেতে পারছি না। কিন্তু অনেকেই লাইনে না থেকেও ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন। ভালো চিকিৎসা করতে এসে চরম ভোগান্তি রে বাবা এখানে’।
এদিকে ভালো চিকিৎসার জন্য বিভিন্নভাবে রক্ত পরীক্ষারও নির্দেশনা দেন ডাক্তাররা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা জহির ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘শনিবারে রক্ত পরীক্ষা করেছি। একদিন পরই ২০৮ রুমে রিপোর্ট দেওয়ার কথা। কিন্তু আজ সকালে এসেও কোনো রিপোর্ট পাচ্ছি না। কেচি গেটের ভেতর থেকে একবার বলছে দুপুরে, আবার বলছে বিকালে। কোনো নিশ্চয়তা পাচ্ছি না, কখন পাব রিপোর্ট। আসল ঘটনা কি তা বুঝা যাচ্ছে না’।
একই অভিযোগ করেন কাচপুর থেকে আসা কোহিনুরও।
ঝালকাঠি থেকে আসা আব্দুল আউয়াল বলেন, এমআরআই করতে হবে মাসখানেক হয়ে গেছে। ডেট পাচ্ছি না, অবশেষে আজ ডেট পেয়েছি। কিন্তু এখনো বাইরে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। আজকে পাব কিনা সন্দেহ।
এদিকে রেডিওলজি বিভাগের নিচতলায় দেখা যায়, হোসনেয়ারা বেঞ্চে শুয়ে আছেন। এক্সরে করতে হবে কিন্তু তার স্বজন লাইনে দাঁড়িয়েও সিরিয়াল পাচ্ছে না। অথচ অনেকে এসেই ‘ম্যানেজ’ করে এক্সরে করিয়ে নিচ্ছেন বলে তার মেয়ে তানিয়া অভিযোগ করেন।
এ বিভাগের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হচ্ছে আলট্রাসনোগ্রাম। কুমিল্লা থেকে আসা জাহিদ নামে একজন অভিযোগ করে ঢাকাপ্রকাশকে বলেন, সকাল আটটায় এসে ব্যাংকের সিরিয়াল দিয়েছি। সামনে ২০ জন ছিল, টাকা জমা দিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রামের সামনে এসে দেখি ৪০ জন। এখনো আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। বাইরে থেকে অনেকে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছেন। কিন্তু আমি যেতে পারছি না। তার পেছনে নোয়াখালী থেকে আসা আমেনা বেগম একই অভিযোগ করে বলেন, এখানে কোনো লাইনের বালায় নাই রে বাবা। আমি বয়স্ক মানুষ তাও দাঁড়িয়ে। অনেকেই আগেই চলে যাচ্ছে। যাদের কেউ আছে মনে হয় ঢুকে পড়ছে।
সার্বিক ব্যাপারে জানতে চাইলে রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শাহরিয়া হক জেরিন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমাদের দুইটা এমআরআই মেশিন ছিল। একটা দুই বছর হলো নষ্ট হয়ে গেছে। তাই পরিচালককে জানানো হয়েছে। শুনেছি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েও এমআরআই মেশিনের চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। আপাতত একটা দিয়েই ২৪ ঘণ্টা সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। দিনে ২০ থেকে ২৩টা এমআরআই করা হচ্ছে। আমাদের অন্যান্য মেশিন ভালো আছে। তাই সাধ্যমতো সেবা দেওয়া হচ্ছে।
রোগীরা ঠিকমতো রিপোর্ট পান না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় ডাক্তাররা ছুটিতে থাকে, অনেকে দেরিতে আসে। এ জন্য সময় মতো দিতে দেরি হয়। এ ছাড়া টেকনেশিয়ানেরও অভাবে রয়েছে। তারা সংখ্যায় বেশি থাকলে পরীক্ষা দ্রুত করা যায়। সাধারণত প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রোগীর চাপ বেশি থাকে। তাই একটু ভিড় দেখা যায়। সিরিয়াল মেইনটেইন করার জন্য আনসার বাহিনী রয়েছে। তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারপরও কেউ সেবা না পেয়ে অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেডএ/আরএ/