১১ দিনেও মেলে না করোনার রিপোর্ট
মোহাম্মদ উকিলের বয়স ৬৫ বছর। চোখের চিকিৎসা করাতে গেছেন হাসপাতালে। চিকিৎসা এগিয়ে নেওয়ার একপর্যায়ে প্রয়োজন হয়েছে করোনা পরীক্ষার। কিন্তু ওই হাসপাতালে করোনা পরীক্ষা হয় না।
সাধ্যের মধ্যে করোনা পরীক্ষা করাতে তিনি গেলেন রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সরকারি এই হাসপাতালে গত ১৭ আগস্ট করোনা পরীক্ষার ফি জমা দেন তিনি। এর ৬ দিন পর ২৩ আগস্ট পরীক্ষার জন্য নমুনা দেওয়ার ডাক পান তিনি এবং ওই দিনই নমুনা দিয়ে আসেন। নিয়ম অনুযায়ী ৪৮ ঘণ্টা পর রিপোর্ট নেওয়ার জন্য ফর্মে দেওয়া তার মোবাইল নাম্বারে বার্তা যাওয়ার কথা।
রিপোর্ট গ্রহণের জন্য যথাসময়ে তার মোবাইল ফোনে বার্তাও যায়। বার্তা পেয়ে তিনি রিপোর্ট নেওয়ার জন্য হাসপাতালের নিচতলায় নির্ধারিত কাউন্টারে যান। কিন্তু কাউন্টার থেকে তাকে বলা হয়, এখনো রিপোর্ট আসেনি। এরপর তিনি হাসপাতালের যে জায়গায় নমুনা দিয়েছিলেন সেখানে যান। সেখান থেকে তাকে পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট আরেকটি কক্ষে। সেখান থেকে আবার তাকে পাঠানো হয় নমুনা সংগ্রহ কক্ষে।
রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য মোহাম্মদ উকিল প্রতিদিনই এভাবে ধরনা দিয়ে আসছিলেন সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। সর্বশেষ রবিবারও (২৮ আগস্ট) করোনার রিপোর্ট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। তখন কথা হয় ঢাকাপ্রকাশ-এর সঙ্গে।
এসময় তিনি বলেন, ১৫ দিন ধরে করোনা টেস্টের জন্য ঘুরছি। গত বুধবারের আগের বুধবার (১৭ আগস্ট) টেস্টের টাকা জমা দেওয়ার সুযোগ পেলাম। এরপর স্যাম্পল দেওয়ার জন্য গত মঙ্গলবার (২৩ আগস্ট) ডেট পেলাম। পরে রিপোর্ট নেওয়ার জন্য একদিন পর (২৫ আগস্ট) ম্যাসেজ পেলাম। ওই দিন থেকে রিপোর্টের জন্য ঘুরছি। এরা কেবল এখান থেকে সেখানে পাঠাচ্ছে। বলছে রিপোর্ট এখনো আসেনি। কিন্তু আমার তো রিপোর্ট নেওয়ার জন্য ম্যাসেজ আসছে। এদিকে আমার চোখের অবস্থা প্রতিদিন একটু একটু করে খারাপের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু রিপোর্টের জন্য চিকিৎসাও এগোনো যাচ্ছে না। কী আর করা, এখন চলে যাচ্ছি। কালকে আবার আসব আরকি।
উকিল বলেন, ১৫ দিন ধরে এই রিপোর্টের জন্য ঘুরছি। টাকা জমা দিয়েছি, তাও ১১ দিন হয়ে গেল। এখনো রিপোর্ট পাইনি।
নমুনা সংগ্রহের জন্য নির্ধারিত স্থানের পাশে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে মোহাম্মদ উকিলের ভোগান্তির বক্তব্য ভিডিও ধারণ করার সময় এক যুবক এসে পাশে দাঁড়ান। তিনি উকিলের টাকা জমার রশিদটি হাত থেকে নিয়ে দেখেন। তারপর তাকে নিয়ে আবার রিপোর্ট ডেলিভারি দেওয়ার কাউন্টারে যান। এই প্রতিবেদকের পেশাগত পরিচয় জেনে তাকেও সঙ্গে যাওয়ার অনুরোধ করেন। যুবকের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি নিজেকে অন্য রোগীর সহযোগী বলে দাবি করেন। তবে তিনি তার নাম বলতে রাজি না হয়ে তার সঙ্গে যাওয়ার আহ্বান জানান।
কাউন্টারে গিয়ে ওই যুবক উকিলের কাছে জানতে চান যে, রিপোর্ট নেওয়ার জন্য তিনি মোবাইল ফোনে বার্তা পেয়েছেন কিনা। উকিল বললেন, হ্যাঁ আছে তো। কাউন্টারে কর্তব্যরতদের দিকে দেখিয়ে বললেন, স্যাররাও তো আমার এই ম্যাসেজ পড়েছেন। বলতে বলতে তিনি বার্তাটি যুবককে দেখান। যুবক বার্তাটি পড়েন। একপর্যায়ে কাউন্টারে থাকা ব্যক্তি যুবককে ‘ভাই’ সম্বোধন করে সব রিপোর্টের ফাইল তার দিকে এগিয়ে দেন। ওই যুবক ফাইল থেকে উকিলের রিপোর্টটি বের করে তাকে দিয়ে দেন।
এতদিন ঘুরে তিনি রিপোর্ট পাচ্ছিলেন না। কিন্তু এখন এক মুহূর্তে কীভাবে পাওয়া গেল? এই প্রশ্নের জবাবে যুবক এবং কাউন্টার থেকে ফাইল এগিয়ে দেওয়া ব্যক্তি প্রায় সমস্বরে বললেন, তার রিপোর্টটি মাত্রই এসেছে।
তবে উকিলের হাতে পাওয়া রিপোর্টে লেখা আছে, রিপোর্টটি প্রস্তুত হয়েছে নির্ধারিত ২৫ আগস্টেই। তা ছাড়া রিপোর্টে প্রিন্ট ডেটও লেখা আছে ২৫ আগস্ট।
হাসপাতালের নিচতলায় রিপোর্ট ডেলিভারির নির্ধারিত স্থানে কিছু সময় দাঁড়িয়ে আরও কয়েকজন ভুক্তভোগীকে এমন অভিযোগ করতে দেখা গেছে। কিন্তু ভোগান্তি আরও বাড়ার শঙ্কায় তারা কেউ উদ্ধৃত হতে রাজি হননি।
তবে রিপোর্টের জন্য দিনের পর দিন ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে তারা বলছেন, রোগী বা তাদের লোকজন হন্যে হয়ে একসময় যেন বাড়তি টাকা-পয়সা দিয়ে রিপোর্ট পাওয়ার চেষ্টা করে, সেজন্যে রিপোর্ট ডেলিভারির জন্য প্রস্তুত থাকলেও ইচ্ছে করেই তারা তা দেন না। এখানে একটি দালাল চক্র আছে। তারা ভুক্তভোগীদের ফুসলিয়ে বাড়তি টাকা আদায়ের জন্য এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখে।
দালাল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, অবশ্যই হাসপাতালে দালাল আছে। দালাল তো সারাক্ষণ হাঁটতেই থাকে। আমরা ব্যবস্থা নেই। আপনারা দালাল চিহ্নিত করে দেন। আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব। জিরো টলারেন্সের ব্যাপার।
তিনি আরও বলেন, করোনার রিপোর্ট বা অন্যান্য রিপোর্ট অনেকের পেতে দেরি হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে অনেকে বুঝে না কখন তাদের রিপোর্ট হয়েছে। অনেক সময় রোগীরা করোনা রিপোর্ট নিতে আসার সময় তার মোবাইলে যাওয়া এসএমএস দেখাতে পারে না। তারা এসএমএস ডিলিট করে দেয়, হয়তো তার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছে।
এমএ/এসজি