প্রখ্যাত রকস্টার জেমসের জন্মদিন আজ
ছবি সংগৃহিত
‘পাগলা হাওয়ার তরে’, ‘গুরু ঘর বানাইলা কী দিয়া’, ‘সুন্দরী তমা আমার’, ‘লিখতে পারি না কোন গান’, ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম’, ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেব’, ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘লাগ ভেলকি লা’, ‘দুষ্ট ছেলের দল’, ‘এই গানই শেষ গান’। এই গানগুলো শুনলেই চোখের সামনে ভেসে আসে গিটার হাতে ঝাঁকড়া চুলের গুমোট মুখের কঠিন একটা চেহারা। ভক্তদের কাছে তিনি ‘গুরু’। অনেকের কাছে তিনি নগর বাউল। তার ভারি কণ্ঠে মাতোয়ারা সব বয়সের সংগীতপ্রেমীরা। তার কনসার্ট মানে আলাদা এক উদ্দীপনা, প্রাণোচ্ছ্বলতা। যেতেই হবে, না গেলে যেন মিস করে ফেলবে অনেক কিছু। এমন একটা ভাবনা।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী নগর বাউল জেমসের ৫৯তম জন্মদিন আজ। এই রকস্টারের জন্ম ১৯৬৪ সালে নওগাঁয়, বড় হয়েছেন চট্টগ্রামে। তাঁর পুরো নাম ফারুক মাহফুজ আনাম জেমস। দেশ ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নগর বাউল জেমস নামেই তাঁর অধিক পরিচিতি।
পরিবারের দ্বিমতে শুরু করেন সংগীতচর্চা। জেমসের গায়কজীবন চাননি বাবা–মা; আর তাই অভিমানী জেমসকে ছাড়তে হয় ঘর। ঘর থেকে পালিয়ে জেমসের ঠিকানা হয় চট্টগ্রামের কদমতলীর পাঠানটুলী রোডে মতিয়ার পুলের আজিজ বোর্ডিংয়ের ৩৬ নম্বর কক্ষে। সেখানে থেকেই তার সংগীতের মূল ক্যারিয়ার শুরু হয়। আজিজ বোর্ডিংয়ে গানের কথা আর সুরের নেশায় ঘুমহীন অনেক রাত কেটেছে জেমসের। সেই স্মৃতিময় আজিজ বোর্ডিং স্মরণে জেমস গেয়েছিলেন একটি গান। তিনি নিজেই গানটি লিখেছিলেন।
১৯৮০ সালে জেমস প্রতিষ্ঠা করেন ব্যান্ড ‘ফিলিংস’। সাত বছর পর এই ব্যান্ডের হয়ে প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’ প্রকাশ করেন। এর কিছু গান দারুণ সাড়া পায়। পরের বছর ‘অনন্যা’ শীর্ষক একটি একক অ্যালবাম নিয়ে আসেন তিনি, যা তাঁকে সংগীত ইন্ডাস্ট্রিতে প্রতিষ্ঠিত করে।
জেমসের গান মানেই কথা ও সুরের এক অনন্য মিশেল। নগর বাউল ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট জেমস। প্রথমে এই ব্যান্ডের সদস্য ছিলেন ফান্টি (ড্রামস), স্বপন (বেজ গিটার), প্যাবলো (ভোকাল ও পিয়ানোবাদক)। তখন জিম মরিসন, মার্ক নাফলার, এরিক ক্ল্যাপটনের গাওয়া গান কাভার করতেন।
ভালো কিছু করার তাড়নায় জেমস একসময় ছাড়েন প্রিয় চট্টগ্রাম। আশির দশকের মাঝামাঝি চলে আসেন ঢাকায়। নতুনভাবে ফিলিংসে যুক্ত হন বেজ গিটারে আওরঙ্গজেব বাবু ও কিবোর্ডে তানভীর। ফিলিংসে পরে যুক্ত হন অর্থহীন ব্যান্ডের বেজবাবা সুমন। নতুন ব্যান্ড, নতুন ধারার গান নিয়ে ১৯৮৭ সালে ফিলিংস প্রকাশ করে প্রথম অ্যালবাম ‘স্টেশন রোড’। এই অ্যালবামের ‘ঝরনা থেকে নদী’, ‘স্টেশন রোড’, ‘আমায় যেতে দাও’, ‘রূপ সাগরে ঝলক’ শ্রোতার মনে দাগ কাটে। পরের বছর ‘অনন্যা’ অ্যালবাম সুপারহিট হয়। এরপর প্রকাশিত হয় ‘জেল থেকে বলছি’, ‘নগরবাউল’, ‘লেইস ফিতা লেইস’, ‘কালেকশন অফ ফিলিংস’, ‘দুষ্টু ছেলের দল’, ‘বিজলি’ । জেমসের একক অ্যালবামগুলো হলো ‘অনন্যা’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘দুঃখিনী দুঃখ করো না’, ‘ঠিক আছে বন্ধু’, ‘আমি তোমাদেরই লোক’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’, ‘তুফান’ ও ‘কাল যমুনা’।
শুরু থেকেই গিটার বাজানোয় দারুণ পটু ছিলেন জেমস। আর তার কণ্ঠের মোহ সে তো অদ্বিতীয়। শুধু গানই গাওয়াই নয়, গান লেখার পাশাপাশি সুরও করেন এই শিল্পী। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে নিজের লেখা গানের পাশাপাশি কবি শামসুর রাহমান, প্রিন্স মাহমুদ, সিবলির লেখা গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের গানেও কণ্ঠ দিয়েছেন জেমস।সেখানেও তিনি সফল।
নব্বইয়ের দশকের পুরোটা সময় তরুণদের কণ্ঠে শোনা যেত জেমসের বিখ্যাত সব গান। সুপারহিট সেই গানগুলো আজও মুগ্ধতা ছড়ায় চারপাশে। জেমসের গানের জনপ্রিয়তা শুধু দেশে নয়, পৌঁছেছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। ২০০৪ সালে কলকাতার সংগীত পরিচালক প্রিতমের সঙ্গে গান নিয়ে কাজ করেন জেমস। শুধু বাংলা গান নয়, বলিউডে হিন্দি গান গেয়েও জনপ্রিয়তা অর্জন করেন জেমস। ২০০৫ সালে বলিউডে গ্যাংস্টার চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া ‘ভিগি ভিগি’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং এক মাসেরও বেশি সময় গানটি বলিউড টপচার্টের শীর্ষে ছিল। ২০০৬ সালে আবারও বলিউডের ছবিতে কণ্ঠ দেন। ২০০৭ সালে তিনি ‘লাইফ ইন এ মেট্রো’ চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন। চলচ্চিত্রে তার গাওয়া গান দুটি হল রিশতে এবং আলবিদা। আর তাতেই বাজিমাত। এই গানগুলো শ্রোতাদের মুখে মুখে। তবে ২০১৩ সালে ‘ওয়ার্নিং’ সিনেমার ‘বেবাসি’ গানের পর আর বলিউডে পাওয়া যায়নি জেমসকে।
এ বিষয়ে ভক্তদের আগ্রহ থাকলেও গত ৯ বছরে একেবারেই মুখ খোলেননি জেমস। এ বছরের ৩০ এপ্রিল নিজের গাওয়া নতুন গান ‘আই লাভ ইউ’ প্রকাশের দিন বলেছিলেন, ‘বলিউডে তখন ক্যারিয়ার গড়তে পারতাম। খুব সহজ ছিল। কিন্তু সেখানে স্থায়ী হলে আমাকে বাংলাদেশটা ছাড়তে হতো। যেটা আমাকে দিয়ে সম্ভব নয়। আরও বড় প্রলোভন দিলেও দেশ আমি ছাড়তে প্রস্তুত নই। তাই আর বলিউডে কন্টিনিউ করা হয়নি। বিশ্বজোড়া খ্যাতি সত্ত্বেও জেমসের পা বরাবরই থেকেছে মাটিতে। সাদামাটা চালচলন, সৃষ্টির প্রতি নৈবেদ্য এবং ফটোগ্রাফির প্রতি ভালোবাসা বার বার রক তারকার খ্যাতির আড়ালে তার আপামর মানুষের শিল্পী পরিচয়কেই সামনে এনেছে।
সংগীতের জন্য সেদিন যদি তিনি ঘর ছেড়ে না পালাতেন তাহলে আজ আমরা পেতাম না সংগীতের একজন কিংবদন্তীকে। যে কিংবদন্তির সুরের মূর্ছনায় চার দশক ধরে ডুবে আছি আমরা।
চলচ্চিত্রে সর্বশেষ এই শিল্পীকে ২০১৭ সালে ‘সত্ত্বা’ ছবিতে গাইতে দেখা যায়। এই ছবির ‘তোর প্রেমেতে অন্ধ আমি’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং সেই বছর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও অর্জন করে।