বসন্তের আগেই স্তব্ধ কোকিল
ছবি- আনন্দবাজার পত্রিকা
বাবা ডাকতেন লক্ষ্মী বলেই। অর্থের তাগিদেই ১৩ বছর বয়সে মেকাপ, জমকালো আলো, লোকজন, গ্লামারের প্যাঁচে পড়তে হয়েছিল তাকে। অভিনয় করতে হয়েছিল সিনেমায়। কিন্তু ঝলমলে জগতের কৃত্রিম আলো সহ্য করতে পারেননি তিনি। কী করেই বা পারবেন! তিনি নিজেই তো আলো। যদিও তখন তিনি জানতেন না, তার আলোতেই একদিন আলোকিত হবে উপমহাদেশের সংগীত জগত। কণ্ঠে ভর করেছিলেন সরস্বতী। মন-প্রাণ ঢেলে দিলেন সুরসমুদ্রে। হয়ে উঠলেন উপমহাদেশের কোকিল। খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গেলেন বিশ্ব দরবারে। তিনি লতা মঙ্গেশকর।
সংগীতপ্রেমীরা ভালোবেসে কোকিলকণ্ঠী নামে ডাকতেন। বসন্তের আর মাত্র কয়েকদিন বাকি। তার আগেই তিনি চলে গেলেন অন্য জগতে। রোববার সকালে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে এ সংগীত কিংবদন্তী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সুর সম্রাজ্ঞী, কোকিল কণ্ঠী, বিখ্যাত সংগীত শিল্পী, সংগীতের কিংবদন্তী- কোনো বিশেষণেই যেন সম্পূর্ণ প্রকাশ পায় না তার পুরোটা। লতা মঙ্গেশকর, লতা মঙ্গেশকরই।
ভারতীয় গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতার একবার বলেছিলেন, ‘মাইকেল অ্যাঞ্জেলো মানেই যেমন চিত্রকলা, শেক্সপিয়ার মানেই যেমন ইংরেজি সাহিত্য, তেমনই ভারতীয় সিনেমার গান মানেই লতা মঙ্গেশকর।’
১৯২৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের ইন্দোরে এক মরাঠি পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। মাত্র নয় বছর বয়সে বাবার সঙ্গে প্রথম মঞ্চে উঠেছিলেন তিনি। বাবার কাছেই শুরু অভিনয় ও গান শেখা। কিন্তু ১৩ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর তাকেই ধরতে হয়েছিল পরিবারের হাল।
এ কিংবদন্তীকে বই প্রকাশ করেছেন ভারতীয় লেখক যতীন মিশ্র। তার বই ‘লতা সুর গাথা’তে লতা মঙ্গেশকর বলেছেন, ‘প্রায়ই রেকর্ডিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি, আর ভীষণ খিদে পেত আমার। তখন রেকর্ডিং স্টুডিওতে ক্যান্টিন থাকত। নানা রকম খাবার পাওয়া যেত কি না, সে বিষয়ে আমার মনে নেই। তবে চা-বিস্কুট খুঁজে পাওয়া যেত তা বেশ মনে আছে। সারা দিনে এক কাপ চা আর দু-চারটে বিস্কুট খেয়েই কেটে যেত। এমনও দিন গেছে, যে দিন শুধু জল খেয়ে সারাদিন রেকর্ডিং করছি, কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারাক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরত— যে ভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে।’
১৯৪২ সালে মারাঠি গান গেয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন এ সুর সম্রাজ্ঞী। এরপর ১৯৪৬ সালে তিনি প্রথম হিন্দি সিনেমার জন্য গান করেন। বসন্ত জোগলেকরের ‘আপ কি সেবা মে’ ছবিতে তিনি ‘পা লাগু কার জোরি’ গানটি গেয়েছিলেন। দুই বছর পর সুরকার গুলাম হায়দারের সহযোগিতায় গান ‘মজবুর’ ছবিতে ‘দিল মেরা তোরা’ গানটি। এরপর লতাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
তবে পরের পথটি সোজাও ছিল না। অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেই এগোতে হয়েছে তাকে। ‘বড্ড সরু গলা’ বলে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন মুম্বাইয়ের বাঙালি প্রযোজক শশধর মুখোপাধ্যায়। উর্দু সিনেমায় গান গাওয়ার পর দিলীপ কুমার আপত্তি তুলেছিলেন উর্দু উচ্চারণ নিয়ে। এরপর উচ্চারণ ঠিক করতে উর্দুর শিক্ষক রেখেছিলেন লতা।
ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষার পাশাপাশি গেয়েছেন বিদেশি ভাষার গানও। ৩০ হাজারেরও বেশি গান গেয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েয়েছেন সংগীতের এ কিংবদন্তী। ১৯৭১ সালের মধ্যেই লতা রেকর্ড করে ফেলেছিলেন প্রায় ২৫ হাজার গান!
পুরস্কারের ঝুড়িও বেশ ভারী। শ্রেষ্ঠ প্লে-ব্যাক শিল্পীর পুরস্কার পেয়েছেন ২৩ বার। পেয়েছেন মধ্যপ্রদেশ সরকারের তানসেন পুরস্কার, ভারত সরকারের চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান 'দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার' ও 'পদ্মভূষণ'। ২০০১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার 'ভারতরত্ন'! এর বাইরে রয়েছে দেশ-বিদেশের অগণিত ভক্তদের ভালোবাসা। এ ছাড়া পুরস্কারের ক্ষেত্রে ছাড়িয়েছেন দেশের গণ্ডি। পেয়েছেন ফ্রান্সের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান অফিসার দে লা লিজিয়ঁ দ্য ’নর।
সংগীত পরিচালনার জন্যও পেয়েছেন পুরস্কার। মারাঠি চলচ্চিত্রে ‘আনন্দ ঘন’ ছদ্মনামে গানের পরিচালনাও করেছেন তিনি। পুরস্কার পাওয়ার পরই রহস্য ভেদ হয় মারাঠি চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক আনন্দ ঘন-র।
ভারতের আরেক সংগীত কিংবদন্তী মান্না দে বলেছিলেন, ‘যে যত ভালো গানই গাক। লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠে ঈশ্বর বাস করেন। ওর মতো কেউ গাইতে পারবে না।’ এভাবেই তিনি বেঁচে থাকবেন ভক্ত-শ্রোতার হৃদয়ে। যার কণ্ঠে ঈশ্বরের বাসা তিনিই তো পারবেন মানুষকে প্রভাবিত করতে, উজ্জীবিত করতে, মানুষের হৃদয়ে বাসা বাঁধতে।
১৯৬৩ সালে ভারত ও চীনের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাদের উজ্জীবিত করেছেন লতা গেয়েছিলেন ‘ইয়ে মেরে ওয়াতান কি লোগো’ গানটি। তার একই গান ব্যবহার করা হয়েছিল কার্গিলের যুদ্ধেও।
মৃত্যু সইতে পারতেন না তিনি। তাই চিকিৎসকের কড়া নির্দেশ ছিল কোনো মৃতদেহের সামনে যেন তিনি না যান। অবশেষে মৃত্যু পৌঁছে গেল তার-ই দুয়ারে। পাড়ি দিলেন অন্য সুরের জগতে। অগণিত ভক্ত-শ্রোতার কণ্ঠে-কানে-মনে রেখে গেলেন নিজের অবিনশ্বর সুর। শেষ হলো সংগীতের শুধু একটি নয়, কয়েকটি অধ্যায়ের।
লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে দুদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। রোববার সন্ধ্যায় মুম্বইয়ের শিবাজি পার্কে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্পন্ন হবে তার শেষকৃত্য।
এসএন