ব্যবসায়ী ও টিভি ব্যক্তিত্ব হিলারি ডিভি আর নেই
ব্রিটেনের বিখ্যাত নারী উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, দাতা, নির্মাতা, টিভি উপস্থাপক ও অনুষ্ঠানের বিচারক হিলারি ডিভি ১১ জুন মারা গিয়েছেন। তিনি দীর্ঘকাল ধরে রোগে ভুগছিলেন। তার মরক্কোর ছুটি কাটানোর বাড়িতে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন। বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তার জীবন গল্পের চেয়ে সত্য।
মোটে সাত বছরে তার বাবা দেউলিয়া হয়ে গিয়েছেন। তার একটি সেন্ট্রাল হিটিং কম্পানি ছিল। এরপর থেকে তারা ধুঁকে, ধুঁকে চলেছেন। তার ১০ মার্চ, ১৯৫৭ সালে জন্মানো এই মেয়েটির পুরো নাম হিলারি লরেইন ব্রুস্টার। তারা চার ভাই, বোন। বড় হয়েছেন ল্যাঙ্কাশায়ারের বোল্টনে। ১৬ বছরের মেয়েটিকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হলো ও ১৭ বছর বয়সে অল্প কিছুদিনের জন্য উইমেন্স রয়্যাল এয়ার ফোর্সে যোগ দিলেন। এয়ার ট্রাফিক কনট্রোল ও হিসাব বিভাগে ছিলেন। বিমান বাহিনীর সবচেয়ে বড় স্টেশন রাফ ব্রাইজ নর্টনে বদলি হলেন। পরে তিনি লন্ডনে চাকরি ছেড়ে চলে গেলেন।
নিজের ভাগ্য গড়েছিলেন হিলারি ডিভি একটি সামান্য কিন্তু চমৎকার উপায়ে। তার এই কম্পানির নাম ‘পল-এক্স’। একটি খড়ের গাদা ভেতরে দিয়ে কার্গোর বাক্স তৈরির কম্পানি। ১৯৯৬ সালে শুরু করেছেন। তার দেশের তৃতীয় কার্গো পণ্য ব্যবস্থাপনা নেটওয়াক হয়েছে। ল্যাকাশায়ার থেকে প্রতিদিন প্রায় ৮ হাজার তার এই খড়ের গদির মালামালের বাক্সগুলো ব্যবহার হতো। ৯০ জনের বেশি কর্মী ছিল এক সময়। বছরে ৫৯.৯৪৭ মিলিয়ন পাউন্ড আয় করতো।
এরপর এই কৃতী নারী উদ্যোক্তাকে নিয়ে অনেকগুলো টিভি প্রগ্রাম হয়েছে। সিক্রেট মিলিয়নিয়ার অনুষ্ঠানে এসেছেন ২০০৮ সালে। এখানে তিনি দি ব্ল্যাক ডোর মিউজিক প্রজেক্ট ও সাইক কমিউনিটি সেন্টারের জন্য ৭০ হাজারের বেশি পাউন্ড দান করেছেন। এরপরই গণমাধ্যমের চোখে পড়ে গেলেন। ২০১০ সালের মার্চে চ্যানেল ৫’র দি বিজনেস ইন্সপেক্টরের উপস্থাপনা করেছেন। এটি চার পর্বের প্রামাণ্যচিত্র। এই প্রথম হিলারি ডিভির প্রখর ব্যবসা বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ধুঁকতে থাকা ছোট ব্যবসায়ীদের লাভজনক কম্পানি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ব্যবহার চোখে পড়লো।
এরপর ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি টু’র ড্রাগনস ডেন প্যানেলে যোগ দিলেন। ২০১২ সালে তিনি ঘোষণা দিলেন, সিরিজটি জুনে ছেড়ে দিচ্ছেন। কেননা, তার একটি চমকপ্রদ চুক্তি হয়েছে দুই বছরের জন্য চ্যানেল ফোরের সঙ্গে।
ফলে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি তার শেষ প্রগ্রামটি উপস্থাপনা করলেন বিবিসি টুতে। নাম ছিল হিলারি ডিভি’র ‘উইম্যান অ্যাট দি টপ’। এই প্রকল্পে ওপেন ইউনিভার্সিটি ও বিবিসি টু যৌথভাবে কাজ করেছে।
২০১৩ সালের এপ্রিলে চ্যানেল ফোরে ‘দি ইন্টার্ন’ নামের একটি ব্যবসা প্রামাণ্যচিত্রের ধারাবাহিক তিনি উপস্থাপনা ও নিমার্ণ শুরু করলেন। প্রতি সপ্তাহে তিনজন তরুণ ইন্টার্নকে তিনি তাদের স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রশিক্ষণ দিতেন।
২০১৪ সালের জুনে তিনি ‘রানিং দি শপ’ নামের একটি অনুষ্ঠান ধারণ শুরু করলেন চ্যানেল ফোরে। ২০১৫ সালের ৯ জুন থেকে সম্প্রচার শুরু হলো।
আইটিভি দুপুরের খাবারের সময় আলাপ (আইটিভি লাঞ্চ টাইম চ্যাট) নামের অনুষ্ঠানে অতিথি প্যানেল আলোচক ও উপস্থাপক হিসেবে নতুন কাজ শুরু করলেন। ২০১৫ সালের ১৮ জুন থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত ছিলেন।
তাকে ২০০৮ সালের ‘ভাইটালাইজ উইম্যান অব দি ইয়ার’ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। ভাইটালাইজ মানে সতেজ। তার মানে তিনি সতেজ বা প্রাণবন্ত নারীর বছরের সেরা পুরস্কারটি লাভ করেছেন। ২০০৯ সালে ব্রিটেনের ‘দি চার্টাড ইনস্টিটিউট অব লজিস্টিক অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট’ তাকে আজীবন সম্মানসূচক পদক প্রদান করেছে। ২০১০ সালে তাকে জন্মস্থান ল্যাঙ্কাশায়ারেরর ‘দি ইউনিভার্সিটি অব ল্যাঙ্কাশায়ার’ সম্মানসূচক পিএইচডি প্রদান করেছে। ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেইট উইকলি তাকে বছরের সেরা ব্যক্তিত্বের পুরস্কার দিয়েছে ২০১০ সালে। তার বোল্টনের ইউনিভার্সিটি অব বোল্টন তাকে ২০১২ সালে ব্যবসায় প্রশাসনে ‘পিএইচডি’ দিয়েছে ব্যবসায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে।
তিনি ব্রিটেনের রানীর ‘সিবিই’ পদক লাভ করেছেন ২০১৩ সালে। এই পদকটি তার পরিবহন ও দাতব্যের স্বীকৃতি। তাকে ২০১৪ সালে দি ইউনিভার্সিটি অব ওলভারহ্যাম্পটন দিয়েছে ‘ব্যবসায় পিএইচডি’। ‘ব্রিট্রিশ সিটিজেন অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেছেন সমাজে ব্যবসায়ীর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে।
তিনি বোল্টনের কাছের স্টাফোর্ডশায়ারে বাস করতেন। এরপর চলে গিয়েছেন ডার্বিশায়ারে। তার লন্ডন, মরক্কো, স্পেন ও ফ্লোরিডাতে বাড়ি আছে। একটি রাজকীয় বাড়ি ৫.৪২ মিলিয়ন মাকিন ডলারে বিক্রি করেছেন। দুইবার বিয়ে ভেঙেছেন। একজনের আগের ঘরে পাঁচটি ছেলেমেয়ে ছিল। তার একটি ছেলে হয়েছে, নাম মেভিণ্ট। তার মাদকাসক্তি ছিল। ২০১৩ সালে ভালোভাবে উত্তরণ ঘটেছে বলে জানিয়েছেন মা।
২০১২ সালের ২৮ অক্টোবর বিবিসি রেডিও ৪’র তিনি তার জীবনের গল্প বলেছেন। অনেকগুলো দাতব্য সংস্থার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একটির নাম কেয়ারেজ ট্রাস্ট। তারা অসুস্থ শিশু বা প্রতিবন্ধীতায় আক্রান্তদের নিয়মিত পয়সার বিনিময়ে সব দিক দেখাশোনার ব্যবস্থা করতেন। ২০১২ সালে হয়েছেন তাদের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। তার খদের বাক্সগুলোর প্রতিটি থেকে তিনি একটি পেনি করে দান করতেন সেখানে। তার এই প্রকল্পের নাম দিয়েছেন প্রতিটি তৃণশয্যায় একটি পেনি। স্ট্রোক অ্যাসোসিয়েশনের তিনি একজন দাতা নির্বাচিত হয়েছেন ২০১০ সালে।
ওএস।