সিসেম স্ট্রিট্রের এমিলিও দেলগার্দো মারা গিয়েছেন
গার্ডিয়ান ও সিএনএন অবলম্বনে : অভিনেতা ও গায়ক এমিলিও দেলগার্দো, ৪৫ বছর টানা উঞ্চ ও পারিবারিক সদস্যের মতো যিনি শিশুদের টিভি সিরিজ নাটক ‘সিসেম স্ট্রিট’-এ অভিনয় করেছেন, একজন দোকানের মালিক হিসেবে; তার বিখ্যাত সেই দোকানের নাম ‘ফিক্স-আইটি’; তিনি মারা গিয়েছেন গতকাল বৃহস্পতিবার ১০ মার্চ। তার পরের স্ত্রী ক্যারল দেলগার্দো ২০২০ সালে টাইম ম্যাগাজিনকে জানিয়েছিলেন, তিনি রক্তের ক্যান্সার ও অস্থিমজ্জাতে কটি টিউমারে আক্রান্ত হয়েয়েছেন। এই রোগেই তিনি কাল মারা গিয়েছেন বলেছেন জানিয়েছেন ম্যানেজার।
তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেছেন নিউ ইয়র্ক শহরের বাড়িতে ৮১ বছর বয়সে।
এমিলিও দেলগার্দো বিশ্বখ্যাত ম্যাক্সিকান-আমেরিকান। অভিনয় করার সুযোগ লাভ করেছিলেন একজন গড়পড়তা অভিনেতা হিসেবে। বড়দের বা ছোটদের যেকারো নাটকগুলোতে গৎবাঁধা ল্যাটিন-চরিত্রাভিনেতাদের সময়ে এমিলিও দেলগার্দো টিভিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে কাজ শুরু করেন। এই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ২০২১ সালে, গত বছর তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তখন টিভিতে অভিনেতাদের কোনো ছাপ ছিল না। সত্যিকারের অভিনয়ও নয়’-এই কথাগুলো বলেছেন ‘ফেমাস কাস্ট ওয়াডর্স’ নামের একটি ইউটিউব সিরিজে।
জানিয়েছেন তার জীবনের কথা-“আমি যেসব চরিত্র করতে চাইতাম, দেখতাম-সেগুলোর বেশিরভাগই দলগত ‘দস্যু’রা বা কোনো খারাপ দলের মতো অভিনয়ে ছড়িয়ে থাকা মানুষদের জন্য সংরক্ষিত হয়ে গিয়েছে।”
এই ধারাটি বদলে ফেললো আমেরিকান টিভি সিরিজে ‘সিসেম স্ট্রিট’। সেখানে নানা ধরণের চরিত্রে নানা ধরণের মানুষকে সুযোগ দেওয়া হলো।
নানা ধরণের অভিনেতা, তারা বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের, এসে কাজ শুরু করলেন একদল শিশুর সঙ্গে। এই অভিনেতাদের মধ্যে ৩৬ বছর বয়সের এমিলিও দেলগার্দো ছাড়াও ছিলেন বিশ্বখ্যাত মার্কিন পাপেটিয়ান, অ্যানিমেটর জিম হেনসন, তিনি ‘বিগ বাড’ ও ‘অস্কার দি গ্রাউচ’ নামের চরিত্রটি তৈরিতেও কাজ করেছেন। শেষের চরিত্রটি তিনি ও জন স্টন মিলে তৈরি করেছেন।
ক্যারল স্পিনি তো ‘অস্কার দি গ্রাউচ’ নামেই বিখ্যাত হয়েছেন। তার নিজের নামটিই হারিয়ে গিয়েছে।
আরো দুটি বিশ্বখ্যাত চরিত্র হলো এই পাপেট সিরিজের ‘এলমো’ ও ‘গ্রোভার’। এগুলো সবই আমেরিকান পাপেট সংস্করণ। তারা ‘মাপেট’ নামে পরিচিত।
দি সিসেম স্ট্রিটের তৃতীয় ধারাবাহিক সিরিজ প্রচারের সময়, ১৯৭১ সালে সেখানে যোগ দেবার সুযোগ লাভ করেন দেলগার্দো। মনে করে বলেছেন, যখন তিনি তার স্প্যানিশ উচ্চারণের শব্দগুলো, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কথা হিসেবে ব্যবহার করা হয় সিরিজে; নানাভাবে চিত্রনাট্যগুলোতে ছড়িয়ে দেবার পরামর্শ দেওয়ার পর প্রযোজকরা বিরক্ত হয়েছিলেন। “প্রথম যখন আমি দেখলাম যে, ‘বিগ বাড’ হাঁটছে, আমার তখন সংলাপ ছিল-‘বিগ বার্ড’। তিনি ২০২১ সালের ইউটিউব সাক্ষাৎকারটিতে আরো বলেছেন-‘‘আমি কিন্তু বিগ বার্ড বলিনি, বলেছি, ‘পাহাড়ো’।’’ ইংরেজিতে এটি ‘পাজারো’। একটি বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডের গাড়ির নাম। এই হলো ভাষা ও তার পরে বদলে যাবার ইতিহাস। সেজন্যই কী তিনি তার নিজের ভাষাকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন সিসেম স্ট্রিটের মতো নামকরা ও বিশ্বখ্যাত টিভি শিশু সিরিজে?
মানুষটি কিন্তু আমেরিকাতে জন্মেছেন, ১৯৪০ সালে। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের কালেক্সিকো শহরে। তাদের দেশ মেক্সিকোর পাশের আমেরিকান সীমান্ত পেরুলে এই শহর। তিনি অভিবাসী মা-বাবার ছেলে। বড় হয়েছেন মেক্সিকোর মেক্সিকালি শহরের মোটে কয়েক মাইল দূরের কালেক্সিকোতে। তাতে মেক্সিকোর ভাষা ও জীবনযাপন ভালোভাবেই তার মধ্যে ছিল। আর ছোট থেকে অন্যরকম ছিলেন। রাতে তিনি ঘুমাতেন গান শুনে। বলেছেন, “আমাদের আঞ্চলিক গান ‘মারিয়াচিস’ শুনতে, শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম।’
এমিলিও দেলগার্দোর অভিনয় জীবন শুরু হয়েছিল মঞ্চে। তরুণ বয়সে চলে এলেন লস অ্যাঞ্জেলসে। শখ অভিনেতা হবেন। তবে ভাগ্য তাকে সামান্যই তখন সাহায্য করলো। কেননা, তিনি একজন ল্যাটিন। তবে ভাগ্য ফিরলো যখন একদিন তাকে চমকে দিয়ে নিউ ইয়র্ক থেকে সিসেম স্ট্রিটের প্রযোজকদের একজন ফোন করলেন।
তার সাক্ষাৎকার নিলেন ‘জন আর্থার স্টোন’। সিসেম স্ট্রিটের প্রথম দিকের কলাকুশলীদের একজন। তিনি ‘কুকি মনস্টার’, ‘অস্কার দি গ্রাউচ’ ও ‘বিগ বার্ড’ চরিত্রগুলো সৃস্টি এবং পরিচালনাতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। ছিলেন জনপ্রিয়তম এই টিভি সিরিজের অন্যতম প্রযাজক। ‘তিনি কথা বললেন ঠিকই, তবে তাকে কোনো ধরণের অডিশন দিতে বলেননি, কাজটি দিয়ে দিলেন’-সবসময় শ্রদ্ধার সঙ্গে বলেছেন ম্যাক্সিকান-আমেরিকান অভিনেতা সিসেম স্ট্রিটের এমিলিও দেলগার্দো। জানিয়েছেন জীবনের শেষ বেলায়, গত বছর ২০২১ সালে, ‘তিনি অভিনেতা চাননি, আমাদের মতো সত্যিকারের মানুষদের চেয়েছেন। যারা কাজগুলো করতে পারবেন ও ভালোবাসবেন।’
এরপর টানা ৪৫টি বছর তিনি অভিনয় করেছেন সিসেম স্ট্রিটে একজন দোকানদার ‘ফিক্স-আইটি শপ’র মালিক হিসেবে। তবে ২০১৬ সালে নতুন শিক্ষামূলক বিনোদন উপকরণগুলো যুক্ত করতে আর চুক্তি নবায়ন করতে না চাইলেও সিসেম স্ট্রিট তার অবদানকে বড় করে দেখেছে, তাকে বিভিন্ন আয়োজনে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গিয়েছে। সেখানে শিশুদের উদ্দীপনা ও ভালো দিকে নিয়ে যেতে কাজ করতে পেরেছেন তিনি।
এই মানুষটির সাড়ে চার দশকের অবিচ্ছেদ্য অভিনয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মগুলো মার্কিন তো বটেই, নানা দেশের শিশুদের শৈশবের অপরিহার্য হয়েছে। তিনি ছিলেন সিরিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের ল্যাটিন শিশুদের জন্য তিনি ছিলেন বিশেষ কিছু। মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, পেরু ইত্যাদি আমেরিকার উত্তর অংশের দেশগুলোকে ল্যাটিন আমেরিকা বলা হয়।
সেই জগতের শিশুরা সত্যিকারের তাদের একজন মানুষকে পেল। যিনি বড় হয়েও ছোট, তাদের দেশের মানুষ। চেনা, খুব চেনা। দেখতে তো বটেই। এজন্যই তিনি তার সংলাপগুলোকে ল্যাটিন ভাষায় নিয়ে আসতে বলেছিলেন। পরে তারা রাজি হয়ে কাজ করেছেন।
এই সিরিজটি তার জীবনে এতই প্রভাব ফেলেছে যে, আরেকজন উল্লেখযোগ্য ল্যাটিন অভিনেত্রী সোনিয়া মানচানোকে তিনি বিয়ে করেছেন। তাদের বিয়ে হয়েছে সিসেম স্ট্রিটের একটি উৎসবে, ১৯৮৮ সালে। তার স্ত্রী মারিয়া ফিগেরোয়া চরিত্রে অভিনয় করতেন।
‘তারাই প্রথম ল্যাটিন জুটি যাদের আমি টিভিতে নাটক করতে দেখলাম’, বলেছেন রোসি করদেরো নামের একজন ডেডলাইন ম্যাগাজিন ও অনলাইনের রিপোর্টার টুইটারে তার মৃত্যুর পর শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে। আরো জানিয়েছেন এই যুবতী রিপোর্টার, ‘তারা অমার পরিবারের একটি বিরাট অংশ জুড়ে ছিলেন। আমাদের ছেলেবেলা কেটেছে তার মতো ল্যাটিন মানুষদের নিয়ে। আমাদের মতো অভিবাসী এবং মার্কিন শিশুদের জন্য তারা ছিলেন আর্শীবাদ। এই দুজনে তাদের পথ পাকা করে নিয়েছিলেন।’
তিনি একজন আগ্রহী থিয়েটার অভিনেতাও ছিলেন। তাদের ম্যাক্সিকান ভাষার (ভাষাটি এখন স্প্যানিশ, ম্যাক্সিকানরা স্পেনের রাজার অনুগত ছিলেন আমেরিকানদের হাতে বন্দী ও স্বাধীনতার আগে) কিসতে নয়ভো নামের বিখ্যাত দন কিসতে বা ডন কহোতি বা দন বা ডন কিহোতো নাসের উপন্যাসটির মঞ্চ নাটকে অভিনয় করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন করোনাভাইরাসের আক্রমণে কভিড ১৯ মহামারিটি ছড়িয়ে যাবার আগে। তাতে খুব নাম করেছেন। মেক্সিকানদের নিজেদের ভাষা আছে। পরে তারা স্প্যানিশে চলে আসেন অনেকটাই। ১৬০২ থেকে ১৬০৫ সালের মধ্যে লেখা এই উপন্যাসটি বিশ্ব সাহিত্যের অনন্য সম্পদ। দুই খন্ডে লিখেছেন অমর সাহিত্যিক মিগেল দে সেরবান্তেস। তাকে এই উপন্যাসের দৌলতেই মূলত স্প্যানিশ সাহিত্যের চিরকালের সেরা লেখক মনে করা হয়।
এমিলিও দেলগাদোর ব্যাপক ও বিস্তৃত মঞ্চজীবনের মধ্যে আছে, তিনি আটিস্টিক ডিরেক্টর বা শিল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন ব্যারিও থিয়েটারে। সেটির পুরো নাম হলো ‘দি ব্যারিও থিয়েটার অ্যানসেম্বল অব ইস্ট লস অ্যাঞ্জেলস’। মঞ্চ দলটি লস অ্যাঞ্জেলসের পূবে, যুক্তরাষ্ট্রে আছে।
তবে এই জীবনের চেয়ে তাকে বেশি খ্যাতি এনে দিয়েছে, সবার মনে রেখেছে জনপ্রিয় এই শিশুদের অনুষ্ঠানটি। সিসেম স্ট্রিট তাদের দীর্ঘদিনের অন্যতম সাফল্যের কারিগরকে শ্রদ্ধা জানাতে ভোলেননি, ‘তার উঞ্চতা ও ভালো ব্যবহার শিশুদের একটি বন্ধুত্ব ও বন্ধুত্বের জগত গড়ে তুলতে বছরের পর বছর ধরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তিনি প্রজন্মগুলোতে প্রতিধ্বনি করে গিয়েছেন। তিনি ম্যাক্সিকান-আমেরিকান হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কোনো একটি সিরিজ, তাও আবার সিসেম স্ট্রিটে, অভিনয়ের বিশ্বরেকর্ডের মালিক। আমরা তার মেধাগুলোকে আমাদের কাজে ব্যবহার ও সহযোগী হিসেবে গ্রহণ করতে পারায় অত্যন্ত কৃতজ্ঞতা বোধ করি। আমরা মনে করি, বিশ্বও তাই মনে করে’, বলেছেন সিসেম স্ট্রিট কর্তৃপক্ষ একটি শ্রদ্ধাঞ্জলীতে।
ওএস।