জুরিবোর্ড মানেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শেষ কথা নয়: রিয়াজ
ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় চিত্রনায়ক রিয়াজ। সালমান শাহ পরবর্তী সময়ে নির্মাতাদের প্রথম ও সেরা পছন্দের তালিকায় ছিলেন তিনি। দর্শকদের উপহার দিয়েছেন অনেক হিট-সুপারহিট সিনেমা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন তিনবার।
বঙ্গবন্ধু’র বায়োপিক সিনেমা ‘বঙ্গবন্ধু’তে তাজউদ্দীন আহমদ চরিত্রে অভিনয়ের পর ‘রেডিও’ সিনেমার মাধ্যমে আবারও নতুন কাজ শুরু করেছেন তিনি। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার বেশকিছু এলাকায় ও চরে চলছে এর দৃশ্যধারণ। সেখান থেকেই ঢাকাপ্রকাশের মুখোমুখি হলেন রিয়াজ।
ঢাকাপ্রকাশ: ‘রেডিও’ সিনেমায় কাজ করতে রাজি হলেন কেন?
রিয়াজ: এই সিনেমার গল্প যখন শুনি তখনই ভালো লেগে যায় সাবজেক্টটা। গল্পটি খুবই ইন্টারেস্টিং লেগেছে। ৭ মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে গল্পটি। আমরা সবাই জানি এই ভাষণ সারা বিশ্বের জন্যই একটি সম্পদ। গল্পটি শুনিয়ে অনন্য মামুন যখন বললেন করবেন নাকি, বললাম, ‘অবশ্যই করব। আমি সিনেমাটি করতে চাই যদি তুমি আমাকে নাও’।
ঢাকাপ্রকাশ: গল্পে ‘৭ মার্চ এবং রেডিও’- কীভাবে ভূমিকা রাখবে?
রিয়াজ: ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে চারদিকে নান ঘটনা ঘটছিল। এর মধ্যে একটি অখ্যাত গ্রাম। যে গ্রামটির চারদিকে পানি। যোগাযোগ ব্যবস্থাও ভালো না। সব খবরই দেরিতে পৌঁছায়। সেই গ্রামের দুটি রেডিও নিয়ে সিনেমার গল্প। দেখা যায় দুই দল মানুষ গ্রামে। এক দল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে চায়, স্বাধীন হতে চায়। আরেক দল তাদের গলা চেপে ধরতে চায়। এটা নিয়েই এগিয়েছে।
ঢাকাপ্রকাশ: আপনার চরিত্রটি কেমন?
রিয়াজ: আমি একজন স্কুল মাস্টারের চরিত্রে অভিনয় করছি। যে সবাইকে নানাভাবে সচেতন করে, দেশপ্রেমে উৎসাহী করে তুলে। আমি মানুষের কথা বলি, বঙ্গবন্ধুর কথা বলি। স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে সবাইকে নেতৃত্ব দেই।
ঢাকাপ্রকাশ: ক্যারিয়ারে অনেক গুণি ও নামী পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে এ প্রজন্মের নির্মাতা অনন্য মামুনকে পরিচালক হিসেবে কীভাবে দেখছেন?
রিয়াজ: মামুনকে যখন প্রথম দেখি তখন সে অনেক ছোট। এখনও সে ছোটই আছে। বাট এখন সে অনেক পরিপক্ক। তার টিম বেশ দক্ষ। গুছিয়ে কাজ করছে। তার সঙ্গে ফার্স্ট কাজেই আমি ইমপ্রেসড। ওর মধ্যে অনেক ভালো কিছু করার প্রবল ইচ্ছে আছে। আমাদের এখানে যেটা হয় যে, এ ধরনের সিনেমায় প্রচুর লিমিটেশন থাকে। আপনারা দেখছেন ট্রলারে এক ঘণ্টায় নদী পার হয়ে একটা রিমোট এলাকায় এসে কাজ করছি। খাবারের সুব্যবস্থা নেই। পানিটাও এখানে হিসেব করে খরচ করতে হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই নাজুক। বিদ্যুৎ নেই। এতকিছুর মধ্যেও মামুন একটা পিরিওডিক্যাল ছবি বানাতে এসেছে এবং সে হেসেখেলে বানিয়েও ফেলছে। এটা আমার কাছে খুবই ভালো লাগছে। তার সাহস ও ইচ্ছেটা আমাকে সত্যি মুগ্ধ করেছে।
ঢাকাপ্রকাশ: জাকিয়া বারী মম ২০০৭ সালে প্রথম ‘দারুচিনি দ্বীপ’ সিনেমায় কাজ করে। সেই সিনেমায় তার নায়ক ছিলেন আপনি। ১৫ বছর পর আবারও দুজনে একসঙ্গে কাজ করছেন। এ নিয়ে কিছু বলবেন?
রিয়াজ: ‘দারুচিনি দ্বীপ’ ছবিতে আমাদের অনেক স্মৃতি রয়েছে। দর্শকপ্রিয় ছিল ছবিটি। তখন মম ছিল নতুন একটা মেয়ে। আর এখন যে মমকে দেখছি সে দক্ষ এবং অভিজ্ঞ।
ঢাকাপ্রকাশ: একটু আগেই বলছিলেন রিমোট এলাকায় অনেক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কাজ করছেন। এক ঘণ্টা ট্রলারে করে নদী পার হতে হয়েছে। ক্যারিয়ারে এই পর্যায়ে এসে ‘রেডিও’ সিনেমার নহবত মাস্টার হয়ে উঠতে আপনার যে ডেডিকেশন বা পরিশ্রম দেখা যাচ্ছে এর প্রেরণা বা আত্মবিশ্বাসটা কোথায়?
রিয়াজ: একটি ভালো কাজের প্রত্যাশা ডেডিকেশন তৈরি করে দেয়। তা ছাড়া আমি মনে করি অভিনয়টা এখনও শিখছি। এতটা দক্ষ আমি না। প্রতিদিনই চেষ্টা করি শিখতে। আর শেখার জন্য ডেডিকেশনটা খুব জরুরি। এ ধরনের পিরিওডিক্যাল ছবি করতে গেলে রিয়াজকে ভেঙে নহবত মাস্টার হয়ে উঠতে গিয়ে যে কি না একাত্তরের সেই মাস্টার, বঙ্গবন্ধুর কথা রেডিওতে শুনে শুনে উজ্জীবীত হয়; এ চরিত্রটা করতে গেলে কষ্ট করতেই তো হবে। না করলে তো হয় না। ইজ নট এ ভেরি ইজি থিং। সহজ কিছু না আসলে।
অনেক নাটক-সিনেমায় মাস্টার চরিত্রে অভিনয় করেছেন আপনি। ‘রেডিও’-তেও আবার মাস্টার। ব্যক্তি জীবনে কখনো মাস্টারি করেছেন?
রিয়াজ: (হা হা হা) বাস্তব জীবনে মাস্টারি সেই অর্থে করা হয়নি। তবে টিউশনি করিয়েছি। মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকেরই ছাত্রজীবনে টিউশনি করানোর অভিজ্ঞতা রয়েছে। অনেক মজার অভিজ্ঞতাও থাকে। (জোরে হেসে) রোমান্টিক অভিজ্ঞতাও থাকে অনেকের। আমার তেমন কিছু মনে নাই।
ঢাকাপ্রকাশ: গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা হলো। তারা জানালেন এক মাস আগে এখানে বিদ্যুৎ এসেছে। গ্রামে টিভিও নেই। সেই এক মাইল দূরে বাজার। সেখানে গিয়ে তারা সিনেমা দেখেন এবং তারা শুধু রিয়াজকেই চেনেন। রিয়াজের সিনেমা হলেই তারা ওই এক মাইল দূরে গিয়ে দেখে। এ বিষয়টা নিয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?
রিয়াজ: এটা সত্যি অত্যন্ত আনন্দের। অনেক বড় প্রাপ্তি বলেও মনে করি আমি। এই গ্রামের বাচ্চা থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ, সবার কাছ থেকে আমি যে আতিথেয়তা পাচ্ছি সেটাও বলে শেষ করা যাবে না। ঘরের ছেলের মতো তারা বরই পেড়ে দিচ্ছেন, কেউ গরুর দুধ নিয়ে আসছেন, পেঁপে আনছেন। এই যে ভালোবাসা, এই ভালোবাসার দাম আমার কাছে অনেক। আমি মনে করি সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমত আমার প্রতি, বাংলার মানুষের, এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের অকৃত্রিম যে আদর-ভালোবাসা আমি পেয়েছি তার ঋণ কখনো শোধ করতে পারব না।
ঢাকাপ্রকাশ: দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বৈচিত্রময় গল্প ও চরিত্রে কাজ করেছেন। এমন কোনো চরিত্র বা গল্প আছে কি যে চরিত্রে কাজের স্বপ্ন ছিল বা এখনও স্বপ্ন দেখেন?
রিয়াজ: অনেক চরিত্রই আছে যেগুলোতে কাজের স্বপ্ন দেখি। শিল্পীর তো আসলে কোনো তৃপ্তি থাকে না কাজের ক্ষেত্রে। তবে ‘বঙ্গবন্ধু’ সিনেমায় কাজ করতে পারে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। বড় বাজেট, দুই দেশের মিলিত সিনেমা। এতে কাজ করে আমি আনন্দিত। আর জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় মন্তু চরিত্রে কাজ করতে পারাটাকেও আমি সৌভাগ্য মনে করি।
ঢাকাপ্রকাশ: এবার অন্য প্রসঙ্গে যেতে চাই। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে নানা রকম সমালোচনা হচ্ছে। আপনি এ পুরস্কারের জুরিবোর্ডের একজন সদস্য। এ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
রিয়াজ: দেখুন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়ে প্রতিবারই সমালোচনা হয়। এ নিয়ে তাই বিশেষ করে বলার কিছু নেই। তবে জুরিবোর্ড মানেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শেষ কথা নয়। আমি বলব সবারই নিজের প্রতি সৎ হওয়া জরুরি। শিল্পচর্চায় সততা না থাকলে হয় না।
ঢাকাপ্রকাশ: সমালোচনাও উঠেছে আপনি জুরিবোর্ডে ছিলেন বলেই নায়ক শাকিব খান এবার পুরস্কার পাননি। সিয়াম পেয়েছে। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
রিয়াজ: এসব কথাবার্তা শুনতেও ভালো লাগে। দেখুন স্পষ্ট করে বলছি, জুরিবোর্ড যে মার্কিং করে সেটি কোনো শীর্ষ নায়ক দেখে হয় না। অভিনয় দক্ষতা, পারফরমেন্স এবং সিনেমার সঙ্গে তার একাগ্রতা দেখে মার্কিংটা হয়। এখানে কে শীর্ষ আর কে শীর্ষ না তা দেখে মার্কিং হয় না। আর জুরিবোর্ড কয়েকজনের সমন্বয়ে একটি টিম। একা এখানে কেউ কিছু নয়। আমার ধারণা আমি ক্লিয়ার করতে পেরেছি। সবাই বুঝতে পারবেন।
এএম/এমএমএ/