এ বছর শোবিজ হারিয়েছে যাদের
২০২২ এর শোবিজ অঙ্গন ছিল বিষাদময়। এ বছর দেশের শোবিজে কাজ করা বেশ কয়েকজন কিংবদন্তি ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। বছর শেষে কড় গুণতে গেলে সেই সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। আসুন জেনে নিই সেসব গুণী মানুষের চলে যাওয়ার কথা।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার
কিংবদন্তি গীতিকবি, কাহিনিকার, চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজক গাজী মাজহারুল আনোয়ার সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন ৪ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৬টায়। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। অসুস্থ অবস্থায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান।
কিংবদন্তি এই গীতিকবির জন্ম ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। তিনি ২০০২ সালে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদক এবং ২০২১ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। তিনি পাঁচবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০ হাজারের বেশি গানের রচয়িতা তিনি।
সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় রয়েছে তার লেখা তিনটি গান। বিবিসির সেই গান তিনটি হলো ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’ ও ‘একবার যেতে দে না’। ১৯৬৪ সাল থেকে রেডিওতে গান লেখা শুরু তার। প্রথম চলচ্চিত্রের জন্য গান লেখেন ১৯৬৭ সালে আয়না ও অবশিষ্ট চলচ্চিত্রের জন্য।
তার পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ ১৯৮২ সালে মুক্তি পায়। তার পরিচালিত চলচ্চিত্রের সংখ্যা ৪১।
তার লেখা কিছু কালজয়ী গান হলো- ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’, ‘আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ ও ‘গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’, ‘শুধু গান গেয়ে পরিচয়’, ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা’, ‘ইশারায় শীষ দিয়ে’, ‘চোখের নজর এমনি কইরা’, ‘এই মন তোমাকে দিলাম’ ও ‘চলে আমার সাইকেল হাওয়ার বেগে’।
আলম খান
বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার ও সংগীত পরিচালক আলম খান মারা গেছেন ৮ জুলাই বেলা ১১টা ৩২ মিনিটে। বাংলা সিনেমার গানে অবিস্মরণীয় নাম আলম খান। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে তিনি অসংখ্য কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছেন। তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন।
আলম খানের জন্ম ১৯৪৪ সালের ২২ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের বানিয়াগাতি গ্রামে। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন তিনি। এই স্কুলে থাকা অবস্থায়ই গানের প্রতি আগ্রহী হন এবং মায়ের উৎসাহে তিনি গানের চর্চা শুরু করেন। তার ছোট ভাই ছিলেন বাংলাদেশের কিংবদন্তি পপ শিল্পী আজম খান।
গানের ভুবনে আলম খান আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেন ১৯৬৩ সালে। সুরকার ও সংগীত পরিচালক রবিন ঘোষের সহকারী হিসেবে তিনি ‘তালাশ’ সিনেমার সংগীত পরিচালনা করেন। সাত বছর সহকারী হিসেবে কাজের পর ১৯৭০ সালে আলম খান একক সংগীত পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘সারেং বৌ’ সিনেমার জন্য তিনি তৈরি করেন ‘ও রে নীল দরিয়া’ গানটি। দেশজুড়ে এটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। এখনো সমান জনপ্রিয় গানটি।
এরপর আলম খান আরও বহু কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস’, ‘আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘কি জাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা’, ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’, ‘সবাই তো ভালবাসা চায়’, ‘ভালবেসে গেলাম শুধু’, ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’, ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে’, ‘তেল গেলে ফুরাইয়া’, ‘আমি তোমার বধূ তুমি আমার স্বামী’, ‘জীবনের গল্প বাকি আছে অল্প’, ‘মনে বড় আশা ছিল’, ‘সাথীরে যেও না কখনো দূরে’, ‘বেলি ফুলের মালা পরে’, ‘কাল তো ছিলাম ভাল’, ‘চুমকি চলেছে একা পথে’ ইত্যাদি।
আলম খান তার ক্যারিয়ারে ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচবার পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক হিসেবে এবং একবার শ্রেষ্ঠ সুরকার হিসেবে।
মাসুম আজিজ
একুশে পদকপ্রাপ্ত অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার মাসুম আজিজ মারা গেছেন ১৭ অক্টোবর দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটে। মাসুম আজিজ ক্যানসারের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে হার্টের সমস্যায়ও ভুগছিলেন।
অভিনেতা ছাড়াও মাসুম আজিজ চিত্রনাট্যকার ও নাট্যনির্মাতা হিসেবে পরিচিত। মঞ্চ, টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে অভিনয়ের খ্যাতি রয়েছে তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালীন তিনি থিয়েটারে কাজের মাধ্যমে অভিনয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর ১৯৮৫ সালে তিনি প্রথম টিভি নাটকে অভিনয় করেন। হুমায়ূন আহমেদের ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’, সালাউদ্দিন লাভলুর ‘তিন গ্যাদা’সহ অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি।
‘ঘানি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য ২০০৬ সালে শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে রাইসুল ইসলাম আসাদের সঙ্গে যুগ্মভাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন মাসুম আজিজ। এ ছাড়া ২০২২ সালে একুশে পদক পেয়েছেন মাসুম আজিজ।
‘গহীনে শব্দ’, ‘এই তো প্রেম’, ‘গাড়িওয়ালা’সহ বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন মাসুম আজিজ। সরকারি অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘সনাতন গল্প’ পরিচালনা করেছেন তিনি। সিনেমাটি ২০১৮ সালে মুক্তি পায়।
শর্মিলী আহমেদ
দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে বড় পর্দা থেকে শুরু করে ছোট পর্দা মাতিয়ে বেড়ানো জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পী শর্মিলী আহমেদ ৮ জুলাই সকালে নিজ বাসায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর।
শর্মিলী আহমেদের জন্ম রাজশাহীতে, ১৯৪৭ সালের ৮ মে। রাজশাহী বেতারের শিল্পী ছিলেন তিনি। ষাটের দশকে চলচ্চিত্রাঙ্গনে নাম লেখান শর্মিলী। এর মধ্যে অবশ্য প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঠিকানা’ (উর্দু ভাষায় নির্মিত) আলোর মুখ দেখেনি। তবে সুভাষ দত্তের ‘আলিঙ্গন’, ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ এবং ‘আবির্ভাব’ চলচ্চিত্র দিয়ে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।
শর্মিলী আহমেদের স্বামী রকিবউদ্দিন আহমেদও (রূপকার) ছিলেন পরিচালক। তার নির্মিত ‘পলাতক’ ছবিতে অভিনয় করেছেন শর্মিলী আহমেদ। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে আরও কিছু উর্দু ছবিতেও তিনি অভিনয় করেন। স্বাধীনতার পর ‘রূপালী সৈকতে’, ‘আগুন’, ‘দহন’-এর মতো জনপ্রিয় সব চলচ্চিত্রে ছিল তার সরব উপস্থিতি।
নায়িকা হিসেবে বেশকিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করলেও একটা পর্যায়ে গিয়ে মা-চাচি-দাদির চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন শর্মিলী। চলচ্চিত্র থেকে শুরু করে টিভির পর্দাতেও একের পর এক নাটকে নিজেকে মা এবং এ ধরনের চরিত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী করে তোলেন। তার অভিনীত টিভি নাটকের সংখ্যাও প্রায় হাজার।
হাসান আরিফ
নন্দিত আবৃত্তিশিল্পী ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক হাসান আরিফ ১ এপ্রিল রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ৫৬ বছর বয়সেই মারা গেছেন তিনি।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে করোনা আক্রান্ত হন হাসান আরিফ। তারপর থেকেই শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চার মাস ধরে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। প্রসঙ্গত, হাসান আরিফ নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশের গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোতে সোচ্চার ভূমিকা রেখেছেন।
এএম/এসএন