বশেফমুবিপ্রবি: উচ্চশিক্ষায় নবদিগন্ত
সঠিক শিক্ষা ছাড়া দেশ গঠন কখনই সম্ভব নয়। তাই তো মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশে গণমুখী শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভব সব ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শিক্ষাকে প্রাধন্য দিয়ে ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রণীত হয় সংবিধান, উচ্চশিক্ষার অবকাঠামোগুলো পুনরুদ্ধার এবং সর্বস্তরে শিক্ষা বিস্তারের জন্য নেওয়া হয় কর্মপরিকল্পনা।
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা-ভাবনাই শেখ হাসিনা সরকারের মূলনীতি ও আদর্শ। প্রণীত হয়েছে জাতীয় শিক্ষানীতি। বর্তমান প্রাগ্রসর বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা ও সমতা অর্জন এবং জাতীয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যথাযথ গুরুত্ব প্রদানসহ পঠন-পাঠন ও গবেষণার সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি ও সম্প্রসারণকল্পে জামালপুরে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বশেফমুবিপ্রবি) স্থাপিত হয়। ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর জাতীয় সংসদে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন পাস হয়। কিন্তু এর এক বছর পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি।
২০১৮ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদকে প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। তিনি ওই বছরের ১৯ নভেম্বর যোগদান করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। নামেমাত্র লোকবল দিয়ে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি করা হয়। প্রথমবার ত্রিশালের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। শিক্ষা-কার্যক্রম শুরু করতে প্রাথমিকভাবে ভাড়া নেওয়া হয় জেলা শহরের বঙ্গবন্ধু আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবন। আস্তে আস্তে সিন্ডিকেটসহ সব বডি গঠন করে কিছু শিক্ষক ও কর্মকর্তা এবং কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষা হয় ঢাকার একটি কলেজে। এর মাঝে শুরু হয় মহামারি করোনা। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও এই মহামারিতে শিক্ষার্থীদের পাশে থকেছে কর্তৃপক্ষ।
ময়মনসিংহ বিভাগের প্রথম বিশেষায়িত এ বিশ্ববিদ্যালয়টির স্বপ্নদ্রষ্টা ও প্রতিষ্ঠাতা সংসদ সদস্য মির্জা আজম। শিক্ষা-দীক্ষা ও অর্থনৈতিকভাবে একসময় পিছিয়ে থাকা জামালপুরে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন তিনি; যে প্রতিষ্ঠানে পড়তে আসবে দেশে-বিদেশের শিক্ষার্থী ও গবেষকেরা। সেই স্বপ্ন নিয়ে তিনি ২০০০ খ্রিস্টাব্দে মেলান্দহের মালঞ্চে প্রতিষ্ঠা করলেন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজ। বাংলাদেশের একমাত্র ফিশারিজ কলেজ হিসেবে এখানকার শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি পেতেন।
২০০৬ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জামালপুর সফর করেন। তৎকালীন শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজ মাঠে আয়োজিত বিশাল জনসভায় এ অঞ্চলে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উঠে। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনাও ঘোষণা দেন, সরকার গঠন করলে এ জনপদে একটি পূর্ণাঙ্গ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।
এদিকে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ফিশারিজ কলেজকে কেন্দ্র করে জামালপুরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও বিশ্ববিদ্যালয় আইনে এই কলেজ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। ফলে এ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। অনিশ্চয়তার ঘোর নামে কলেজের প্রায় তিনশ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন নিয়েও।
এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে মির্জা আজম বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেন। এরই মাঝে তার প্রচেষ্টায় কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্তীকরণ সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর একটি অনুশাসন জারি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় কার্যক্রম হাতে নেয়। সরকারের নির্দেশক্রমে যথাযথ নিয়ম মেনে কলেজটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগে আত্তীকরণ করা হয়। এর মধ্যদিয়ে স্বস্তি ফেরে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মাঝে।
২০১৯ সালের ২৩ মে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদের কাছে তৎকালীন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মির্জা আজম, প্রতিষ্ঠানটির সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির দলিল হস্তান্তর করেন। ফলে ১৫.৪৩ একর জমিসহ কিছু স্থাপনা পায় বিশ্ববিদ্যালয়টি। তাই প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মধ্যেই ভাড়া ভবন থেকে ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরিত হয় সব কার্যক্রম। ক্যাম্পাস হয় দৃষ্টিনন্দন। এর মাঝে চতুর্ভূজ আকারে ৫০ কক্ষের একটি সুদৃশ্য একাডেমিক ভবন করা হয়েছে।
শূন্য থেকে শুরু। এখন শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৭০০ এর অধিক। শিক্ষক ৪৭ জন, কর্মকর্তা ৩২ ও কর্মচারী ১০০-এর বেশি। এর মাঝে ফিশারিজ বিভাগের একটি ব্যাচের স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন হয়েছে। ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে প্রথমবর্ষের ভর্তি কার্যক্রমও চলমান।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে প্রয়োজনীয় বইসমৃদ্ধ লাইব্রেরি, গবেষণা ল্যাবসহ শিক্ষার প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ। পড়ুয়াদের শিক্ষণীয় নানা প্লাটফর্মে যুক্ত করতে বিতর্ক ক্লাব, রোবটিক্স ক্লাব, কম্পিউটার ক্লাবও পরিচালিত হচ্ছে। পাশাপাশি নিয়মিত খেলাধুলারও আয়োজন করা হয়।
এদিকে ক্যাম্পাস স্থাপনে সরকার ৫০০ একর ভূমির অনুমোদন দিয়েছে। এরই আলোকে প্রণয়ন করা হয়েছে ডিপিপি তথা মাস্টারপ্ল্যান। অদূর ভবিষ্যতে ক্যাম্পাস আরও বিস্তৃত হবে। শিক্ষার্থী বাড়বে, নিত্যনতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে দেশি-বিদেশি গবেষকদের পদচারণায় মুখর হবে দৃষ্টিনন্দন সবুজ এই ক্যাম্পাস। চর্চা হবে জ্ঞান-বিজ্ঞানের, বাড়বে শিল্প-বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলাবোরেশান। গবেষণালব্ধ সেই নবসৃষ্ট জ্ঞানে কল্যাণ সাধিত হবে দেশ-জাতির। বিশ্ববিদ্যালয় একটি জাতির শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, যেমনটা রেখে চলেছে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ দেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের উত্থান—সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়। এরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গমাতা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরও নিজস্ব কৃষ্টি-ঐতিহ্য তৈরি হবে। শিখন-পঠনের মাধ্যমে মেধা ও মননে এক টুকরো বশেফমুবিপ্রবির আভা ছড়িয়ে পড়বে ‘বিশ্বগ্রামে’। হয়ে উঠবে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ এবং মুক্তবুদ্ধিচর্চার প্রাণকেন্দ্র।
২৮ নভেম্বর ৫ পেরিয়ে ৬ বছরে পা রাখছে নতুন প্রজন্মের বিশ্ববিদ্যালয়টি। সেদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টি এখনো 'শিশু'! ভাবে হাঁটিহাঁটি পা ফেলে শৈশব পেরিয়ে কৈশোর, সেখান থেকে যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে নতুন পথ সৃষ্টি করুক। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষিত নতুন পথে বঙ্গমাতা প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছে গৌরবের স্বর্ণশিখরে। হয়ে উঠুক উচ্চশিক্ষার নতুন দিগন্ত। পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমাদের চাওয়া হোক—এই।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।