বিসিএস খুবই রিস্কি গেম, সঙ্গে প্ল্যান বি রেডি রাখতে হবে
৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে মেধাক্রমে ৬৪তম স্থান অর্জন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী নুসরাত নওশীন। প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত নওশীন দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসারের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সে চাকরি ছেড়ে ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে শুরু করেন বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি। এখানেও পেলেন সাফল্য। গণমাধ্যমকে তিনি শুনিয়েছেন নিজের বিসিএস জয়ের গল্প।
নুসরাত নওশীন জানান, তিনি মা-বাবার একমাত্র সন্তান। মা মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা, বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা। দুজনেই বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত। একমাত্র সন্তান হওয়াতে তাদের সমস্ত স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরেই। ঢাকার এ কে হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক আর হলিক্রস কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে ৫৫তম স্থান লাভ করে নিজ পছন্দে ভর্তি হন অর্থনীতি বিভাগে। অর্থনীতি বিষয় নিয়ে বিদেশে পড়ে সেটেল হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি। কিন্তু আম্মু আব্বুকে একা রেখে বিদেশে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না। তাই শুরু থেকেই দেশের মধ্যে ক্যারিয়ার গুছানোর প্ল্যান করেন। আর এজন্য দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সর্বোচ্চ মর্যাদার চাকরি বিসিএস ক্যাডার হওয়ার টার্গেট করেন। প্রস্তুতি নেওয়া শুরু কনে মাস্টার্স পরীক্ষার পরে।
তার মতে, যাদের টার্গেট বিসিএস তারা চাইলে তৃতীয় বর্ষ থেকে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে বিসিএস এর পড়া পড়তে গিয়ে একাডেমিক রেজাল্ট যেন কোনক্রমেই খারাপ না হয়। যেন বিসিএস হাত ফসকে গেলেও ভালো একাডেমিক রেজাল্ট দিয়ে আপনি অল্টারনেটিভ ক্যারিয়ার অপশনটি বেছে নিতে পারেন।
পড়াশোনার রুটিন সম্পর্কে নুসরাত নওশীন জানান, তিনি কোথাও কোচিং করেননি, মডেল টেস্টও দেননি। নিজেই সিলেবাস এনালাইসিস করে টপিক ধরে ধরে পড়েছেন। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হওয়ায় গণিত আর বিজ্ঞানে ভালোই দখল ছিল। পাশাপাশি ছোটবেলা থেকেই বাংলা আর ইংরেজিতে ছিল মায়ের দেয়া শক্ত হাতেখড়ি। অন্যান্য বিষয়গুলোও নিজের মত গুছিয়ে নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছেন। তার পড়াশোনার রুটিন টাইম ওরিয়েন্টেড ছিল না, টার্গেট ওরিয়েন্টেড ছিল। অর্থাৎ প্রতিদিন কয় ঘণ্টা পড়বেন সেটা তিনিই ঠিক করতেন। কতটুকু পড়ে শেষ করবন, কোন সাবজেক্ট কবে শেষ করবেন সেটা ঠিক করতেন। যেমন ঠিক করলেন, আগামী দশ দিনে বাংলা সাহিত্য শেষ করবেন। তাহলে প্রতিদিন কতটুকু পড়া লাগবে একটা টার্গেট ধরে সেইমত পড়তেন। প্রতিদিনের পড়ার টার্গেট শেষ করতেন, সেটা যতক্ষণই লাগুক না কেন।
নুসরাত নওশীন বলেন, ‘আমার মা। আমার প্রথম শিক্ষক। আমার মা আমাকে কখনোই জাগতিক কোন ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করেননি। তিনি আমার পড়াশোনা নিয়ে সিরিয়াস ছিলেন ঠিকই কিন্তু কোনদিন বলেননি তোমাকে ফার্স্ট হতেই হবে, অমুক চাকরি পেতেই হবে। শুধু বলেছেন, একজন ভালো মানুষ হতে হবে। আমি কতটা ভালো মানুষ হতে পেরেছি বা পারবো জানি না। শুধু জানি তার মানবিক গুণের অর্ধেকও যদি আমি রপ্ত করতে পারি তাহলে আমার আচরণে কেউ অন্তত কষ্ট পাবে না। সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছি।’
যারা বিসিএস-এ যারা ভালো করতে চান তাদের জন্য পরামর্শ কি জানতে চাইলে নুসরাত নওশীন বলেন, ‘বিসিএস-এর প্রতিযোগীর সংখ্যা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে এলোমেলো ভাবে না পড়ে কৌশলী হতে হবে। বিসিএস এর পড়া যতই বেশি হোক না কেন, এর কিন্তু একটা গোছানো সিলেবাস আছে। সবার আগে সিলেবাসটাকে বুঝতে হবে, ভালোমতো এনালাইসিস করতে হবে। বিগত বছরের প্রশ্নগুলো দেখে কোন কোন টপিক থেকে বারবার প্রশ্ন আসে বের করতে হবে। এরপর আপনার শক্তির জায়গা আর দুর্বলতার জায়গা চিহ্নিত করতে হবে। যেটা আপনি পারেন সেটা আর বেশি পারার চেষ্টা না করে, যেটা একেবারেই পারেন না সেটাকে আয়ত্তে আনার চেষ্টা করতে হবে। কারণ বিসিএস কোন এক বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার পরীক্ষা না। সব বিষয়ে মোটামুটি দখল না থাকলে লিখিত পরীক্ষায় হয়তো মোটের উপর ৫০ শতাংশ নম্বর পেয়ে পাস করা যাবে, কিন্তু শেষ হাসিটা হাসা যাবে না। শেষ দৌড়ে এগিয়ে থাকতে হলে প্রথম ৫০০-৬০০ জনের মধ্যে থাকতে হবে (জেনারেল ক্যাডার প্রত্যাশীদের জন্য), যেটা দুর্দান্ত লিখিত নম্বর ছাড়া সম্ভব না। কারণ ভাইভার নম্বরটা একদমই ভাগ্যের খেলা, এখানে ভালো প্রিপারেশন নিলেই যে আপনি ভালো ভাইভা দিবেন বিষয়টা এমন না। কিন্তু লিখিত পরীক্ষার জন্য একটা ভালো প্রস্তুতি আপনাকে অনেকখানি এগিয়ে রাখবে লক্ষ্যের দিকে।’
লিখিত পরীক্ষার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে নুসরাত নওশীন জানান, ‘লিখিত পরীক্ষার জন্য আমি বেশ সিরিয়াস প্রিপারেশন নিয়েছিলাম কারণ লিখিত পরীক্ষার নাম্বারই সবচেয়ে বড় পার্থক্য গড়ে দেয়। সংবিধান খুব ভালো করে পড়েছিলাম বাংলাদেশ বিষয়াবলীর জন্য। সংবিধানের অনুচ্ছেদ গুলো আলাদা নীল কালি দিয়ে লিখেছি। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী একদম নিজের মত করে সাম্প্রতিক ঘটনার রেফারেন্স দিয়ে লিখেছি, কোন গাইড বই অনুসরণ করি নি। ম্যাপ-ডাটা-চার্ট নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি করি নি। বাংলা ইংরেজি রচনাও সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় নিজের মত করে লিখেছি, কোন নোট করিনি। পরীক্ষার হলে এত লেখার সময় থাকে না আসলে। অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা লিখে অযথা উত্তর বড় করিনি। চেষ্টা করেছি পরীক্ষার খাতা একদম পরিচ্ছন্ন রাখতে, কোন কাটাকাটি ছাড়া। খাতা দেখে পরীক্ষক যেন বিরক্ত বোধ না করেন, করলে তার প্রভাব আপনার নম্বরের উপর পড়বেই।’
পড়ালেখার পাশাপাশি সাহিত্যের বই পড়াকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন নুসরাত নওশীন। তার ভাষায়, ‘আমার কাছে বই মানে জীবনের ক্যানভাস। সেটা একাডেমিক বই হোক, ফিকশন কিংবা নন-ফিকশন। ভালো বই যেমন আপনার সুস্থ বিনোদনের খোরাক হতে পারে, আপনার মানসিকতা গঠনেরও প্রভাবক হতে পারে। যেমন আমি যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন সমরেশ মজুমদারের ‘সাতকাহন’ বইটা পড়ি। কিশোরী আমার মানসিকতা ও ব্যক্তিত্ব গঠনে বইটা অনেক প্রভাব রেখেছিল। এমনকি এখনো মাঝেমধ্যে আমাকে যখন হতাশা গ্রাস করে বা মন খারাপ হয়, আমি সাতকাহন পড়ি। বইটা আমাকে অন্যরকম এক মানসিক শক্তি দেয়। বিসিএস-এর প্রস্তুতির সাথেও এটা সম্পর্কিত। এখন দেখি ভাইভার আগে সবাই বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা বই পড়তে বসে। অথচ এসব বই কিন্তু এমনিতেই সবার আগে থেকে পড়া থাকা উচিৎ। ভাইভার কোন সিলেবাস নেই, যে প্রিলি-রিটেনের মত কয়েক মাস পড়াশোনা করে আপনি আয়ত্ত করে ফেলবেন। ভাইভা হল সারাজীবন আপনি কী পড়লেন, কী জানলেন, কীভাবে নিজেকে গড়ে তুললেন, আপনার মানসিকতা, আচার আচরণ সবকিছুর সমন্বিত একটা ফলাফল। বই পড়ার অভ্যাস যাদের থাকে তাদের সামগ্রিক জানার পরিধি, চিন্তার পরিধি খুব স্বাভাবিকভাবেই অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি থাকে, যেটা কয়েক মাসে ২-৩ টা বই পড়ে রপ্ত করা কখনোই সম্ভব নয়।’
‘বিসিএস ক্যাডারই হতে হবে’— এমন একটা ব্যাপার অনেক চাকরিপ্রার্থী তাদের মনে গেঁথে নিয়েছেন। এ সম্পর্কে নুসরাত নওশীন বলেন, ‘এই চিন্তাটা খুবই ভয়ংকর একটা চিন্তা। জীবনে সবার অবশ্যই একটা স্থির লক্ষ্য থাকা উচিৎ। কিন্তু সেই লক্ষ্য যেন আমাকে গ্রাস করে না ফেলে সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য কোন কারণে অর্জিত না হলেও যেন আমি অন্য আরেকটি ভালো গন্তব্যে পৌঁছাতে পারি সেই সুযোগ টা অন্তত খোলা রাখা উচিত। বিসিএস দিন শেষে একটা সরকারি চাকরি। এখানে অন্যান্য পেশার চেয়ে মানুষের জন্য সরাসরি কিছু করার সুযোগটা বেশি, এজন্য এক্সপোজার একটু বেশি। তাই বলে বিসিএসকে ক্রেজ বানিয়ে অন্ধের মত ছোটা কোন কাজের কথা নয়। বিসিএস খুবই রিস্কি গেম। লক্ষ লক্ষ প্রতিযোগী এখানে পরীক্ষা দেয়, পোস্ট মাত্র হাজার খানেক। আমার পরামর্শ হল, সবসময় হাতে প্ল্যান ‘বি’ রেডি থাকতে হবে। বিসিএস ছাড়াও জীবনে করার এবং দেশকে দেয়ার অনেক কিছু আছে।’
নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে নুসরাত নওশীন বলেন, ‘মহান আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করে আমাকে দেশ ও জনগণের সেবা করার যে সুযোগ দিয়েছেন, সেটাকে নিষ্ঠার সাথে পালন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। দেশের একজন সাধারণ জনগণ এর যে সেবাটুকু নাগরিক অধিকার বলে স্বাভাবিকভাবেই পাওয়ার কথা, সেই সেবা পেতে তাকে যেন বেগ পেতে না হয়, অন্য কাউকে প্রভুজ্ঞান করতে না হয় সেই চেষ্টা করবো। দিনশেষে এমন একজন হওয়ার চেষ্টা করবো যেন আমি চাকরি থেকে অবসর নেয়ার পরে আমার একটা ভালো কাজ দিয়ে হলেও মানুষ আমাকে সারাজীবন মনে রাখে।’
এপি/