গ্রাহকের কয়েক হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও এমএলএম কোম্পানি এমটিএফই
আবারও এমএলএম কোম্পানির প্রতারণায় জড়িয়ে সর্বস্বান্ত হলো দেশের লক্ষাধিক মানুষ।গ্রাহকের কয়েক হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও এমএলএম কোম্পানি এমটিএফই। হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে অবৈধ অনলাইন গ্যাম্বলিং ক্রিপ্টো ট্রেডিং করা এই কোম্পানি।
দুবাই ভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠানটি মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম পঞ্জি মডেলে ব্যবসা করতো। ভারত ও বাংলাদেশ থেকে প্রতিষ্ঠানটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিনিয়োগকারী ছিল। ৯০ শতাংশ অর্থই বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের বলে অভিমত সাইবার বিশ্লেষকদের।
জানা গেছে, কানাডিয়ান মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ কোম্পানি (এমটিএফই) বাংলাদেশে কার্যক্রম শুরু করে ২০২১ সালে। তিন বছরে এমটিএফইতে শুধু বাংলাদেশ থেকেই ৪২ লাখ মানুষ যুক্ত হয়েছেন। প্রাথমিক অবস্থায় এমটিএফই অ্যাপে যুক্ত প্রত্যেকেই ৬১, ২০১, ৫০১, ৯০১ ও ২ হাজার ডলার ডিপোজিট করেন। বেশি টাকা আয় করতে কেউ কেউ ৫ হাজার ডলারের বেশিও ইনভেস্ট করেছেন। এভাবে কোম্পানিটি গ্রাহকদের কাছ থেকে ২ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে কোম্পানিটির ৪ শতাধিক অফিস রয়েছে। এমটিএফই’র অ্যাপে এসব অফিসের ছবিসহ ঠিকানা ও অন্যান্য তথ্য দেয়া আছে। মূলত দুবাই থেকে মাসুদ আল ইসলাম নামের এক বাংলাদেশি এমটিএফই’র এশিয়া অঞ্চলের দেখভাল করেন। তিনিই এমটিএফই’র কোম্পানির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে তথ্য সংগ্রহ করে বিভিন্ন গ্রুপগুলোতে ছড়িয়ে দিতেন। তার থেকে পাওয়া তথ্য অন্যান্য গ্রুপের সিইওরা তাদের মেম্বারদের জানাতেন। মেম্বাররা আবার তাদের সদস্যদের জানাতেন।
এমটিএফই মূলত এমএলএম কোম্পানির মতো তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে। প্রথম হাত, দ্বিতীয় হাত, তৃতীয় হাত পর্যন্ত আয়ের টাকা ভাগাভাগি হতো। অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশে এমটিএফই কোম্পানিটির প্রায় সাড়ে ৩ শতাধিক সিইও আছে। এমটিএফইতে নিজের প্রমোকোড ব্যবহার করে মানুষকে যুক্ত করতে পারলেই এমটিএফই তাকে সিইও হিসেবে প্রমোশন হয়। পরে এমটিএফই কোম্পানি প্রত্যেক সিইওকে প্রতিমাসে ৩ লাখ টাকা বেতন ও ১ লাখ টাকা অফিস ভাড়া প্রদান করে। সিইওদের প্রধান কাজ ছিল বিপুল অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে কোম্পানিতে হাজার হাজার মানুষকে যুক্ত করা। এতে তারা সফলও হয়। সহজেই লাখ লাখ মানুষকে যুক্ত করতে পেরেছে। প্রতিজন সিইওর আন্ডারে প্রায় ১ থেকে দেড় লাখ মানুষ এমটিএফইতে যুক্ত রয়েছে। প্রত্যেকের আলাদা আলাদা টেলিগ্রাম ও হোয়াটঅ্যাপ গ্রুপ রয়েছে। গ্রুপে সদস্যদের ট্রেডিংয়ের সিগন্যাল দেয়া হতো। সেই সিগন্যাল অনুযায়ী গ্রাহকরা এমটিএফইতে ট্রেড করতো। ওই গ্রুপে এমটিএফই’র নতুন নতুন সুযোগ-সুবিধার কথা জানানো হয়। এই সিইওদের মাধ্যমে টিম গঠন করে ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রতিমাসে ২ থেকে ৩ শতাধিক সেমিনার আয়োজন করা হয়। মূলত অ্যাপে সদস্য বাড়াতেই এই সেমিনার করা হয়। যারা আগে থেকেই অ্যাপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের মাধ্যমে শত শত মানুষকে এই সেমিনারে আনা হতো। সেমিনার শেষে খাবারেরও ব্যবস্থা করা হতো। ঢাকার সেমিনারগুলো ধানমণ্ডি, গুলশান, বনানী, মোহাম্মদপুর, মহাখালি, উত্তরা, মিরপুরের বিভিন্ন নামিদামি রেস্টুরেন্টে আয়োজন করা হতো। সিইওদের অফিসগুলোও এসব এলাকায়। সেমিনার থেকে সিইওরা সাধারণ মানুষকে ভাগ্য পরিবর্তনের নানা মোটিভেশনাল বক্তব্য দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতেন। অনেকে সেমিনার থেকেই অ্যাপ ইনস্টল করে এমটিএফইতে যুক্ত হতেন। ধারদেনা করে ডলার ঢুকাতেন। এবং সদস্য সংগ্রহ করতে নেমে পড়তেন। তাদেরও সিইও হওয়ার স্বপ্ন দেখানো হতো।
একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমটিএফই গত ৭ই আগস্ট থেকে টেকনিক্যাল সমস্যা দেখিয়ে গ্রাহকদের টাকা উত্তোলন সেবা বন্ধ করে দেয়। এরপরে গ্রাহকদের সঙ্গে কাস্টমার সার্ভিসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে কোম্পানিটি। পরে কাস্টমার সার্ভিস থেকে জানানো হয় সফটওয়্যার আপগ্রেডের কারণে আপাতত উত্তোলন সেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। একটি নোটিশ দিয়ে এ তথ্য জানানো হয়। তবে এরপরে ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও তাদের সফটওয়্যার আপগ্রেড শেষ হয়নি। উল্টো ৭ তারিখের আগে গ্রাহকদের উইথড্রো দেয়া সব ডলার রিজেক্ট করে পুনরায় অ্যাকাউন্টে ফেরত নিয়ে যায়। আবার নোটিশ দিয়ে জানানো হয় সফটওয়্যার আপগ্রেডের কাজ নির্বিঘ্নে করতে সকলের লেনদেন বাতিল করা হয়েছে। তবে গত ১৭ তারিখে এমটিএফই তাদের অ্যাপে প্রবেশ বন্ধ করে দেন। নির্ধারিত সময় পার হয়ে গেলেও গ্রাহকরা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এআই বাটন অন করতে পারেনি। পরে ওইদিন রাত ৮টার পরে কোম্পানিটি গ্রাহকদের অনুমতি ছাড়াই এআই বাটন অন করে দেন।
এদিন রাত ১২টার পরে ট্রেডিংয়ের নামে সকলের অ্যাকাউন্ট ফাঁকা করে দেয়া হয়। উল্টো গ্রাহকদের মূলধনের অর্থের সমপরিমাণ ডলার মাইনাস করে দেখানো হয়। এবং তাদের অ্যাপে জরুরি নোটিশ জারি করা হয়। নোটিশে বলা হয়, গ্রাহকরা এমটিএফই সেবা চলমান রাখতে হলে তাদের মাইনাস ব্যালেন্স পরিশোধ করে আবার ডলার ডিপোজিট করুন। এমনকি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এমটিএফই’র প্রাপ্ত মাইনাস ডলার পরিশোধ না করলে গ্রাহকদের আইনি নোটিশ পাঠানোর হুমকি দেয়া হয়। শুধু বাংলাদেশই নয় এমটিএফই তাদের কার্যক্রম পুরো পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেয়। কানাডা, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ইতালি, অস্ট্রেলিয়া, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া, ইসরাইল, উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, কেনিয়া, তানজেনিয়া, রুয়ান্ডা, কঙ্গো, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, ওমান, আইভোরিকোস্ট, ইরাক, ইয়েমেন ও জিবুতিতে তারা প্রতারণা করে প্রায় ৭ কোটি মানুষের কাছ থেকে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার নিয়ে উধাও হয়েছে।