সিন্ডিকেটের কবজায় লাগামহীন আদার দাম
বাংলাদেশে আদার বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৩ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদন হয়েছে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ, ১ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন। রমজানে চাহিদা ছিল প্রায় ৫০ হাজার টন। ঈদের আগে খুচরা পর্যায়ে চায়না আদা বিক্রি হয়েছে ২৯০ টাকা কেজি ও দেশিটা ১৪০ টাকা। কিন্তু এক মাসের ব্যবধানে সিন্ডিকেটের জালে বর্তমানে তা লাগামহীন হয়ে গেছে।
৬০০ টাকা কেজিতেও পাওয়া যায় না চায়না আদা। তবে ভারত ও মিয়ানমারের আদা ৩৫০ টাকার বেশি কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। বাজারে আদার সংকট সৃষ্টি করে আড়তদার থেকে শুরু করে খুচরা বিক্রেতারা যে যেভাবে পারছে ইচ্ছামতো দাম আদায় করছে ভোক্তাদের কাছ থেকে। এদিকে জিরার দাম হু হু করে বাড়ছে। মাসের ব্যবধানে কেজিতে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে গেছে।
বুধবার (২৪ মে) রাজধানীর কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
হঠাৎ করে আদার বাজার বেসামাল হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ভোক্তার স্বার্থ আমরা দেখি। যখনই কোনো জিনিসের দাম বেড়ে যায় আমরা বাজার তদারকি করি। অস্বাভাবিক কিছু পেলে তাদের শাস্তির আওতায় আনি। আদার ব্যাপারে কাজ করা হচ্ছে। কেউ জড়িত থাকলে এবং ধরা পড়লে তাদেরও শান্তি দেওয়া হবে। জিরার দামও হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় পাইকারি বাজার মৌলভীবাজারে আজ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে।
সরেজমিনে গেলে কারওয়ান বাজারের মেসার্স বিক্রমপুর স্টোরের পাইকারি বিক্রেতা আসাদ ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, কোয়ালিটি বুঝে আদার দামও কম বেশি। চায়না আদা ৬০০ টাকা কেজিও পাওয়া যায় না। কয়েকদিন ধরে এ অবস্থা। তবে মিয়ানমার ও ভারতের আদা ৩০০ টাকা কেজি। আর পাল্লা (৫ কেজি) ১৪৫০ থেকে ১৫০০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে। খুচরা নিলে একটু বেশি। যেটা ভালো না দাম কম। তবে দেশি আদা পাওয়া যায় না। এজন্য আদার দাম বেড়েই যাচ্ছে। এসব শ্যামবাজার থেকে আনা। সেখানে ২৬০ টাকা কেজি কেনা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঈদের আগে দেশিটা ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা ও চায়নাটা ২৭০ থেকে ২৯০ কেজি বিক্রি করা হয়েছে। বর্তমানে দেশি আদা নেই। আবার চায়না এলসি খুলছে না। তাই সংকট আদার। সংকটের কারণে আজও আদা আনা হয়নি। তবে আমদানি বেশি হলে দাম কমে যাবে।
দাম কমার ব্যাপারে এই পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, এত দাম আগে কখনো দেখিনি। দেশি আদার চাষ বাড়লে দাম এত হবে না।
হঠাৎ করে চাহিদা তো বাড়েনি? তাহলে মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি দাম কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমরা যে দরে কিনি কিছু লাভ করে বিক্রি করি পাইকারি পর্যায়ে। আমাদের করার কিছু নেই।
শুধু এই ব্যবসায়ী নয়, কারওয়ান বাজারের অন্যান্য পাইকারি ব্যবসায়ীদেরও একই কথা- আদা নেই। দেশি আদা থাকলে এত দাম বাড়ত না।
তিনি আরও জানান, আদার মতোই জিরার দামও লাগামহীন হয়ে গেছে। প্রায় দিন আদার দাম বাড়ছে। ঈদের আগে ৭০০ টাকা কেজি বিক্রি করা হলেও বর্তমানে ৯৫০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
আদার ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই বাজারের পাশের খুচরা বিক্রেতা আবুল জানান, আদার দাম বেশি। ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি। এটা মিয়ানমার ও ভারতের। চায়নাটা পাওয়া যায় না। আবার কোথাও পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি, ৬০০ টাকার উপরে। তবে পেঁয়াজ ৭০ টাকা কেজি, রসুন ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে।
এরশাদ নামে অপর খুচরা ব্যবসায়ী জানান, ঈদের আগে ২৮০ টাকা চায়না আদা বিক্রি করা হলেও মাসের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। বর্তমানে ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। কয়েকদিন আগে ৩৫০ টাকার বেশি বিক্রি করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, আদার দাম লাগামহীন হলেও পেঁয়াজের কেজি ৭০ থেকে ৭৫ টাকা ও রসুন ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু সেই আদা বিভিন্ন পাড়া-মহাল্লায় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
আমদানিকৃত প্রায় কৃষিপণ্যই রাজধানীর শ্যামবাজারের আড়তে আসে। সেখান থেকেই বিভিন্ন বাজারে পাইকারি পর্যায়ে বিক্রি হয়। সেই বাজারেও বেশি দামে আদা বিক্রি করা হচ্ছে বলে জানান আড়তদাররা।
হঠাৎ দাম বৃদ্ধির ব্যাপারে জানতে চাইলে শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির সভাপতি মো. সাইদ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, মাল কম। আবার ব্যাংক এলসিও খুলছে না। চায়না থেকে একবারে বন্ধ রয়েছে। তাই দাম বাড়ছে। আজ (বুধবার) মিয়ানমারের আদা ২৪০ থেকে ২৬৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। দেশিটা নেই। চায়নাটা ৩৫০ টাকার উপরে। বাড়তি দাম।
কী করলে দাম কমবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রচুর পণ্য আসলে দাম কমে যাবে। আদা, পেঁয়াজ কাঁচামাল। বেশি দিন থাকে না। কিছু নষ্টও হয়। এজন্য আড়তের সঙ্গে পাইকারি ও খুচরায় দামের পার্থক্য ৮০ থেকে ১০০ টাকাও হচ্ছে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এগুলো পচনশীল পণ্য। ধরে রাখা যায় না। আমরা সামান্য লাভে বিক্রি করে থাকি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সূত্র উল্লেখ করে এক প্রতিবেদনে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই জানিয়েছে, দেশে আদার চাহিদা প্রায় ৩ দশমিক ১০ লাখ টন। রমজানে চাহিদা প্রায় ৫০ হাজার টন। এবার ১ দশমিক ৯৩ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে। তার আগের বছরে উৎপাদন হয়েছে ১ দশমিক ৯১ লাখ টন। দুই মাস আগে অর্থাৎ ২২ মার্চ আন্তর্জাতিক বাজারে আদার টন ছিল ৫৪৬ ডলার।
এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবিও বলছে, মাসের ব্যবধানে আদার দাম কেজিতে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে। কারণ বুধবার ৩২০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হচ্ছে আদা। যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকায়।
এসজি