কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বটতলায় নতুন টাকার হাট!
কেউ ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে ঘুরছেন। আবার কারও হাতে ব্যাগ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মেইন গেটের বটতলায় ভিড করে এভাবেই ব্যাগে করে নতুন টাকা নিয়ে মানুষকে ডাকছেন নতুন টাকার বিক্রেতারা।
সেই নতুন টাকা প্রতি হাজারে ১৮০ টাকা বেশি নিয়ে বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পিয়ন ও সিকিউরিটির কাছ থেকে বেশি দামে টাকা কেনেন এই নতুন টাকার বিক্রেতারা।
বিক্রেতাদের দাবি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পিয়ন ও সিকিউরিটির মাধ্যমে ভোগান্তি এড়াতে হাজারে ১৬০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে তাদের। তাই তারাও হাজারে ১৮০ টাকা বেশি নিয়ে নতুন টাকা বিক্রি করছেন। সেনাকল্যাণ ভবনের গেইটের বাইরে এবং গুলিস্থানেও বেশি টাকার বিনিময়ে নতুন টাকা কেনাবেচা হচ্ছে।
রবিবার (১৬ এপ্রিল) মতিঝিল ও গুলিস্তান ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
অথচ কেন্দ্রীয় ব্যাংক পবিত্র ঈদ-উল ফিতর উপলক্ষে একজন গ্রাহককে বিদ্যমান নোট জমা দিয়ে ৫, ১০, ২০ ও ৫০ টাকা মূল্যমানের নতুন সাড়ে আট হাজার টাকার নোট দিচ্ছে। একজন সাড়ে আট হাজার টাকার বেশি নতুন নোট নিতে পারেন না। ফিঙ্গার প্রিণ্ট দিয়ে নিতে হয়। কাজেই পরে আবার নিতে গেলে ধরা পড়ে যায়।
এ ছাড়া, নতুন টাকার বিনিময়ে গ্রাহককে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। ফলে চরম ভোগান্তি পৌঁহাতে হয় গ্রাহকদের।
এই ভোগান্তর সুযোগটাই নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মচারী। তারা বেশি টাকা নিয়ে নতুন নোটের জমজমাট ব্যবসা করছে।
গেটের বাইরে বেশি টাকা দিলেই সহজেই নতুন নোট পাওয়া যাচ্ছে-এমন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, টাকার বৈশিষ্ট্য স্থির থাকে না। তা বহমান। একজন থেকে অন্য জনের হাতে যাবে। আমরা নিয়ম মেনে একজনকে সর্বোচ্চ সাড়ে আট হাজার টাকা বিনিময় করার সুযোগ দিচ্ছি। যে কোনো গ্রাহক লাইনে দাঁড়ালেই নতুন নোট বিনিময় করতে পারবে। কিন্তু অফিসের বাইরে কে কত দামে বিক্রি করছে তা আমাদের দেখার বিষয় না। কারণ, রাস্তায় ওই কাজ যারা করছে তারা আমাদের লোক না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মেইন গেটের সামনে বটতলায় কথা হয় লালবাগের মো. মাসুমের সঙ্গে। তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, কত টাকা নেবেন। ৫ টাকার ২টা বান্ডিল অর্থাৎ এক হাজার টাকা নিলে ১১৮০ টাকা লাগবে। ১০ টাকার একটা বান্ডিল নিলেও ১১৮০ টাকা লাগবে। এভাবে যে মানের নোট নেন না কেন হাজারে ১৮০ টাকা বেশি লাগবে।
এত কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুম বলেন, দেখেন ৫০ বছর থেকে নতুন ও ছেঁড়ার টাকার ব্যবসা করি। প্রতি ঈদে এভাবে নতুন টাকার ব্যবসা করা হয়। এ ছাড়া, সারা বছরও ব্যবসা করি। কিন্তু ঈদের সময় বেশি চলে। কারণ, মানুষ বেশি করে চায়। আমরা বেশি নিই না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পিয়ন ও সিকিউরিটির লোক ভেতর থেকে এনে গেটের বাইরে আমাদের দেয়। তারা হাজারে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা বেশি নেয়। আমরাও হাজারে ২০ টাকা বেশি ধরে ১১৮০ টাকায় বিক্রি করি।
এ সময় সাইদ নামে অপর নতুন টাকা বিক্রেতা বলেন, হাজারে ১৫০ টাকা বেশি লাগছে। আমরা একটু বেশি দামে হাজারে ১৮০ টাকা বেশি নিয়ে বিক্রি করছি। এত বেশি কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা লাইনে দাঁড়ালে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর আঙুলের টিপ দিয়ে মাত্র সাড়ে আট হাজার টাকা নতুন টাকা পাই। অনেকে আবার পাই না। তাই ব্যাংকের পিয়ন ও সিকিউরিটির লোকের কাছেই কিনে থাকি। তারা আমাদের বেশি টাকা নিয়ে দিচ্ছে।
শুধু এই দুই জনই নয়, বটতলার চারিদিকে অসংখ্য লোক কাঁধে ও হাতে ব্যাগ নিয়ে নতুন টাকা ব্যাচা-কেনা করছে। তারা বলছেন, কয়েক দিন থেকে এ ব্যবসা ভালোই হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা থাকছে। ভেতর থেকে দেওয়া বন্ধ করলে আমাদের লাভ বেশি হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পাশে সেনা কল্যাণ সংস্থার ভবনের গেটের বাইরেও নতুন টাকা কেনাবেচা হচ্ছে। এ সময় হারুন নামে এক বিক্রেতা বলেন, ‘১০ টাকা আর ২০ টাকার নোটের বান্ডিল (প্রতিটিতে ১০০ পিস) বেশি টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। এতে অতিরিক্ত ৪০০ টাকা লাগবে বলে জানান তিনি। অন্যরাও বেশি টাকার বিনিময়ে নতুন টাকা বিনিময় করছে।’
লাইনে দাঁড়ালেই মিলবে নতুন টাকা
সরেজমিন দেখা যায়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৩০ তলা ভবনের নিচ তলায় প্রতিদিন বেলা আড়াইটা পর্যন্ত একজনকে বিভিন্ন মানের সাড়ে আট হাজার টাকার নতুন নোট দেওয়া হচ্ছে। মতিঝিল অফিসে পাঁচটি কাউন্টার রাখা হয়েছে নতুন টাকা বিনিময় করার জন্য। বিপরীতে ডিজিটাল মেশিনে টোকেন দেওয়া হচ্ছে।
ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে গ্রাহকদের। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ধৈর্য হারিয়ে বিশৃঙ্খল ও উত্তেজিত আচরণ করছেন অনেকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ও নিরাপত্তা রক্ষায় ব্যাংকের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীদের পাশাপাশি পুলিশও নজর দিচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নোট নিতে আসা প্রত্যেক ব্যক্তিকে আঙুলের ছাপ দিতে হচ্ছে মেশিনে। বৃদ্ধাঙ্গুলের ছাপ দিলে একটি টোকেন বেরিয়ে আসছে। যেখানে সিরিয়াল নাম্বার লেখা থাকে। যাতে একবারের বেশি কেউ নিতে না পারে। দেওয়া হচ্ছে সাড়ে আট হাজার টাকা।
এ সময় করিম নামে একজন বলেন, একটি মাত্র মেশিনে আঙুলের ছাপ নেওয়ায় দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষা করতে হয়েছে। তাই ভিড় কমাতে মেশিন বাড়ানোর বিকল্প নেই।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা সরবরাহ করেছে গ্রাহকদের বিতরণের জন্য। কিন্তু সেখানে যথাযথ উপায়ে বিতরণ হচ্ছে না। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাপ বাড়ছে।
উল্লেখ্য, গত রবিবার থেকে নতুন টাকার নোট বিনিময় শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তা আগামী ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের সব শাখার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকের নির্ধারিত শাখায় পাওয়া যাবে। বেলা ১০টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত তা বিনিময় করা হচ্ছে। ঢাকা অঞ্চলের বিভিন্ন তফসিলি ব্যাংকের ৪০টি শাখার মাধ্যমেও গ্রাহকদের নতুন নোট দেওয়া হচ্ছে।
এবার ঈদে ১৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে ছাড়ার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত কয়েক বছর ধরে পাঁচ টাকার নোট বাজারে ছাড়েনি বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এবার সেই অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসে পাঁচ টাকার নোটও দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জেডএ/এমএমএ/