রমজানকে সামনে রেখে দাম বেড়েছে দুধেরও
রমজান মাসে অন্যান্য পণ্যের মতো প্যাকেটজাত তরল দুধের চাহিদা থাকে অনেক বেশি। ফলে বেশিরভাগ লোকজনই পাড়া-মহল্লার দোকান থেকে কিংবা বড় সুপারশপ থেকে দুধ কেনেন। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন কোম্পানি তাদের বাজারজাতকৃত প্যাকেটজাত পাস্তুরিত তরল দুধের দাম বাড়িযে দেন। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। রমজান ঘনিয়ে আসতেই বাজারে বিক্রি হওয়া প্যাকটজাত তরল দুধের দাম বেড়েছে।
তার উপর আবার এক লিটারের প্যাকেট পাওয়া যাবে কম। কেউ এক লিটার নিতে চাইলে আধা লিটারের দুই প্যাকেট অথবার আড়াইশ গ্রামের চার প্যাকেট নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে দাম পড়বে প্রতি লিটার ১০০ টাকা থেকে ১২৮ টাকা।
মোহাম্মদপুরে কথা হয় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দেশে কি যুদ্ধ লেগে গেছে? সরকার বলছে যুদ্ধের কারণে আমদানি করা জিনিসের দাম বেশি। কিন্তু দুধ তো দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। তাহলে দাম বাড়ছে কেন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, যে হারে দুধের দাম বেড়েছে তাতে রমজান মাসে দুধ না খেয়েই থাকতে হবে।
তিনি বলেন, ‘গ্রামে মানুষ হয়েছি। অন্য সময়ে না খেলেও রমজানে একটু দুধ খাওয়ার ইচ্ছ করে। কিন্তু দামের ভয়ে সেই পেথে আর হাাঁটা যাবে না।’
আয়ান নামে একজন বলেন, ছোট থাকতে কত দুধ খেয়েছি। বর্তমানে তা কল্পনাই মনে হচ্ছে। এত দামের কারণে আসছে রমজানে দুধ খাওয়া অভ্যাস ছেড়ে দিতে হবে।
সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপ-সচিব বলেন, ‘বাসায় ছোট বাচ্চা আছে। ওর জন্য বাধ্যতামূলক দুধ কিনতেই হয়। আমরা তো কিছুটা কম খেয়ে থাকতে পারি। কিন্তু বাচ্চাকে তো কম খাওয়ানো যায় না। নিত্যপণ্যের চড়া দামের মধ্যে দুধের মূল্যবৃদ্ধি আমাদের মতো পরিবারের ব্যয় আরও বাড়াল। কিন্তু আয়তো আর বাড়েনি। তাহলে বাড়তি টাকা কোথায় পাব?’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রামাঞ্চলে গাভীর প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। কিন্তু সেই দুধ প্রাণ, আড়ংয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছে প্রতি লিটার ৯৫ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে প্যাকেটজাত প্রতি লিটার দুধের দাম বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে লিটারে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। কোনোরকম যৌক্তিক কারণ ছাড়াই প্রতি বছর প্যাকটজাত তরল দুধের দাম এভাবে বাড়তে থাকায় ভোক্তারা ক্ষুব্ধ।
তবে খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, আমরা তো সামান্য লাভ করি। গায়ের রেটে বিক্রি করে সামান্য কমিশন পাই। দাম বাড়াচ্ছে কোম্পানি। লাভতো তারাই বেশি করছে।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউনহল, কারওয়ান বাজারসহ পাড়া মহাল্লা বিভিন্ন দোকান ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে।
কেরানীগঞ্জ থানার আটিবাজার এলাকার ফার্মার জাহাঙ্গীর আলম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা খামার থেকে প্রতি লিটার দুধ ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি করছি। আরও কম ৬০ টাকা লিটার বিক্রি করেছি। কিন্তু গো খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কোম্পানি প্রতি লিটার দুধ ৯০ থেকে ৯৫ টাকায় বিক্রি করছে। তাদের দুধ কিন্তু এত ভালো না। কারণ কেমিক্যাল দিয়েই প্যাকেটজাত করে তারা। জাল দিলে পাতিলের নিচে আস্তর পড়ে। কিন্তু আমাদের দুধে শুধু উপরে সর পড়ে। খেতেও মজা। দামও কম।
দিনাজপুর জেলার রিপন বলেন, আগে সর্বোচ্চ ৬০ টাকা লিটার বিক্রি হতো। বর্তমানে গরুর খাবারের দাম একটু বেশি হওয়ায় দুধের দামও বাড়াতে হয়েছে এখন ৭০ টাকা লিটার বিক্রি করা হচ্ছে।
এদিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউনহল মার্কেটে মোহাম্মদী জেনারেল স্টোরের কামাল এ প্রতিবেদককে বলেন, দেশের ফার্ম থেকে দুধ কিনে বিভিন্ন কোম্পানি বেশি দামে বিক্রি করছে। দেশি দুধের দামেও যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। আগে মিল্কভিটার দুধ ছিল৬৫ টাকা লিটার। প্রাণ ও আড়ং দুধের লিটার ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে তারা কয়েকবার দাম বাড়িয়েছে। আর গত এক মাসের ব্যবধানে প্রাণ ও আড়ং লিটারে ৫ টাকা বাড়িয়ে ৯৫ টাকা লিটার বিক্রি করছে। তারা গায়ের রেট দিয়ে দিয়েছে। লাভ তারাই করে। আমরা সামান্য কমিশন পাই।
রাজধানীর বিভিন্ন নামি-দামী সুপারশপেও দেখা গেছে বেশি দামে আড়ং, প্রাণসহ অন্যান্য কোম্পানি বেশি দামে তরল দুধ বিক্রি করছে। মোহাম্মদপুরের মীনাবাজার, আগুরাতেও দেখা গেছে প্যাকেটজাত দুধ বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে মীনাবাজারের ম্যানেজার অহিদুজ্জামান অনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমরা কোম্পানি থেকে প্রাণ, আড়ং, ফার্ম ফ্রেশ তরল দুধ কিনে ৯৫ টাকা লিটার বিক্রি করছি। তবে মিল্কভিটা প্রতি লিটার ৯০ টাকা, ৫০০ এমএল ৫০, ২৫০ এমএল ২৮ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।
মোড়ক যাচাই করে দেখা গেছে, আড়ং ব্র্যান্ডের উৎপাদিত এক লিটার পাস্তুরিত তরল দুধের খুচরা দাম লেখা আছে ৯৫ টাকা, হাফ লিটার ৫২ টাকা। ২০০ মিলি ২৫ টাকা। ২৫০ মিলি ৩২ টাকা। কাউকে ২৫০ মিলি ৪টি প্যাকেট কিনতে হলে তাকে ১২৮ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
দুধের বাড়তি দামের কারণ জানতে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামালের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে প্রতিষ্ঠানটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, গরুর খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্য মূল্যবৃদ্ধির কারণে খামারিদের দুধের দাম বাড়ানো হয়েছে। প্যাকেজিং উপকরণেরও মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার খুচরা দোকানি ও পাইকারি ব্যবসায়ীদেরও লাভ কিছুটা বাড়ানো হয়েছে। এ কারণে দুধের দাম বাড়াতে হয়েছে।
সরকার পরিচালিত সমবায়ভিত্তিক কোম্পানি মিল্ক ভিটার দুধের দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক (উপসচিব) ডা. মো. মাহফুজুল হক এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘প্রাণসহ অন্যরা দাম বাড়ানোর পর আমরা বাড়িয়েছি। কৃষক পর্যায়েও দুধের দাম বাড়িয়েছি। প্যাকিং ম্যাটেরিয়ালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। তাই দুই মাস হলো আমরাও দুধের দাম বাড়িয়েছি।
ছোট প্যাকেটের দাম তুলনামূলক বেশি কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ছোট প্যাকেটের খরচও বেশি। তাই দামও বেশি। তারপরও আমাদের দুধের চাহিদা বেশি। দিনে সারা দেশে ৭০ হাজার থেকে এক লাখ লিটার বিক্রি হচ্ছে। প্রতি লিটার ৯০ টাকা। রমজানে চাহিদা বাড়লেও দাম বাড়বে না, আর কমবেও না।
শুধু তরল দুধই নয়, গুঁড়া দুধের দামও বেড়েছে। বছরের ব্যবধানে গুঁড়া দুধের দাম ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতি কেজি গুঁড়া দুধের দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা বেড়েছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজারদর মূল্য তালিকায় দেখা গেছে, বাজারে এখন ডানো গুঁড়া দুধ এক কেজি প্যাকেট ৭৮০ থেকে ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। গত বছরের এই সময়ে ডানো প্রতি কেজি ছিল ৬৫০ থেকে ৬৯০ টাকা। বেড়েছে ২৫ শতাংশ। ফ্রেশ দুধের কেজি ৭৯০ থেকে ৮৪০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এই দুধ গত মার্চে ৫৮০ থেকে ৫৯০ টাকা কেজি বিক্রি হয়েছে।
এনএইচবি/এমএমএ/