‘বলতে পারেন খাবারও কমিয়ে দিয়েছি’
‘জিনিসপত্রের দাম এতটাই বেড়েছে যে, বাজারের ফর্দ ছোট করে এনেছি। এতটাই ছোট করেছি যে, মাসের খরচ তিন ভাগের এক ভাগ কমিয়ে দিয়েছি। আগে সব জিনিস বেশি বেশি কিনলেও এখন আর কিনি না। বলতে পারেন খাবারও কমিয়ে দিয়েছি।’
এই কথাগুলো বলতে বলতে যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেন তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম। জাহাঙ্গীর পেশায় চাকরিজীবী। কারওয়ান বাজারে বাজার করতে এসে এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলেন।
একই অবস্থা একটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক শিরিন আখতারের। তিনি বলছিলেন, ‘চালসহ সব জিনিসের দাম বাড়তেই আছে। কিন্তু আয় তো আর বাড়েনি। বাধ্য হয়ে সবকিছু কেনা কমিয়ে দিয়েছি। বাজার এভাবে লাগামহীন হলে চলব কীভাবে?’
শুধু জাহাঙ্গীর কিংবা শিরিন নয়, দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত প্রতিটি মানুষের অবস্থাই চিড়েচ্যাপ্টা।
প্রায় সকল নিত্যপণ্যের বাজার এখন লাগামহীন। তবে চালের বাজার যেন কোনোভাবেই বাগে আনা যাচ্ছে না। রাজধানীর চালের বাজার সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও বড় বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠান চালের বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। তারা ৭০ টাকা কেজির মিনিকেট চাল বিক্রি করছে ৯২ টাকায়। আর খুচরা বাজারে তো প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা দরে।
কারওয়ান বাজারের মেসার্স সালমান ট্রেডার্স এর মালিক মাসুম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, রশিদ, মোজাম্মেলসহ অন্য কোম্পানির মিনিকেট চাল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। কিন্তু প্রাণ, রুপচাঁদার ৫ কেজির প্যাকেট মিনিকেট চাল ৪৬০ টাকা বা প্রতি কেজির দাম ৯২ টাকা। অন্যান্য কোম্পানির চেয়ে এর দাম অনেক বেশি। এ ব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ কোম্পানিই বেশি করে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে।
মোহাম্মদপুর ফিউচার টাউন হাউজিংয়ের আল আমিন এন্টারপ্রাইজের মালিক আনোয়ার হোসেন মেমো দেখিয়ে বলেন, রুপচাঁদা, প্রাণের ৫ কেজি মিনিকেট চাল ৪৬০ টাকা। এত দাম বলা মাত্র গায়ের মূল্য দেখিয়ে বলেন, এই যে দেখেন এমআরপি লেখা। তবে অন্যান্য কোম্পানির ৫০ কেজির বস্তা ৩৫০০ টাকা ও ২৫ কেজির বস্তা ১৮৫০ টাকা বিক্রি করা হচ্ছে।
চালের বাজারের এমন অস্থিরতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে নাজির আহমেদ একজন ক্রেতা বলেন, বাজারে আগের চেয়ে সব জিনিসের দাম বাড়তি। তাই সব জিনিস কেনা কমিয়ে দিয়েছি। চাল কেনাও কমিয়ে দিয়েছি। কারণ আয় (কামাই) তো বাড়েনি।
চালসহ নিত্যপণ্যের চড়া মূল্যের কথা উল্লেখ করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের একজন যুগ্নসচিব ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এভাবে দাম বাড়তে থাকায় আমার খুবই অসুবিধা হচ্ছে। কারণ, সব জিনিসের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এতে চাপে পড়ে গেছি। ২০১৫ সালে বেতন যা বেড়েছে, সেখানেই আছে। আর সরকার ব্যয় কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ায় আগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্মানি পেতাম, সেটাও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই সব পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত ফরহাদুর রহমান বলেন, এতই কি দাম বাড়ার কথা! সরকার বলছে, দেশে যথেষ্ট খাদ্য মজুদ রয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধানও উৎপাদন হয়েছে। তারপরও কেন মিনিকেট চালের কেজি ৯০ টাকার উপরে। আসলেই কি এত দাম?
মিনিকেট চালের বাড়তি দামের ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে প্রাণের পরিচালক মো. কামরুজ্জামান কামাল ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, আমাদের অনেক পণ্য রয়েছে বাজার দরের চেয়ে বেশি দামে ধান কেনা। মিনিকেট নামে চাল তার একটি। আমাদের চেয়েও অন্য কোম্পানি বেশি দামে অর্থাৎ ৫ কেজি প্যাকেট ৪৭৫ টাকায় বিক্রি করছে।
সরকার বলছে মিনিকেটের নামে কোনো চাল নেই ,তারপরও মিনিকেট চাল বিক্রি করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে বিভিন্ন গণমাধ্যমে নিউজ হলেও মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে কোনো নির্দেশনা আসেনি। মামলার শুনানিতে প্রতিযোগিতা কমিশন থেকেও মিনিকেট জাতের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছিলো। আমরা তার ব্যাখ্যা দিয়েছি। কৃষকের কাছ থেকে চিকন ধান কেনা হয়। তারা বলে মিনিকেট ধান, দাম বেশি। তা আমরা নিজস্ব মিলে চাল করে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করি।
এদিকে, মিনিকেট চালের প্রসঙ্গে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, এটা বলতে বলতে আর ভালো লাগে না। এ ব্যাপারে আইন করা হচ্ছে। সময় হলে সবকিছু দেখা যাবে। যাদের টাকা বেশি তারা বেশি দামে কিনবে। আমরা তো বাধা দিতে পারব না।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, চলতি মৌসুমে সরকারি গুদামে খাদ্য মজুদ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ১০ লাখ টন চাহিদার বিপরীতে ২১ লাখ টনের অধিক মজুত আছে। কৃত্রিম সংকট তৈরি করে খাদ্যদ্রব্যের বাজারে যাতে কেউ অস্থিরতা সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এরই মধ্যে অনেক গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, দেশে চালের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২ কোটি ২৭ লাখ টন। তার চেয়ে বেশি ৪ কোটি ৪ লাখ টন উৎপাদন হয়েছে।
টিসিবি বলছে, বর্তমানে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকা কেজি, চিকন চাল ৭৫ টাকা। বাম্পার উৎপাদন ও পর্যাপ্ত মজুত থাকার পরও বছরের ব্যবধানে কেজিতে ৭ থেকে ১০ টাকা বেড়েছে। চালের বাজারে চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। প্রাণ, আকিজ, সিটি গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানি মিনিকেট নামে চাল প্যাকেটজাত করে কেজিতে ৫ টাকা বেশি নিচ্ছে। বাধ্য হয়ে জনস্বার্থে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন গত সেপ্টেম্বরে কুষ্টিয়ার রশিদ এগ্রো ফুড, নওগাঁর বেলকন গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, বাংলাদেশ এডিবল ওয়েল কোম্পানির বিরুদ্ধে বেশি দামে চাল বিক্রি করার অভিযোগে মামলা করেছে। সেসব মামলা এখনো নিস্পত্তি হয়নি।
এনএইচবি/এমএমএ/