চিনি নিয়ে ছিনিমিনি চলছেই, রমজানের আগে মজুতের অভিযোগ
মিলমালিকরা দাম বাড়াতে বাড়াতে সর্বশেষ ১ ফেব্রুয়ারি খোলা চিনির কেজি ১০৭ টাকা ও প্যাকেটজাত ১১২ টাকা করেছে। তারপরও তারা রমজান মাসকে টার্গেট করে কারসাজি করে আটকে রাখছে। ডিলারও পাইকারি ব্যবসায়ীদের চাহিদা মতো চিনি দিচ্ছে না।
সামান্য কিছু দিলেও আগের চেয়ে বেশি দাম আদায় করছে। এর ফলে খুচরা ব্যবসায়ীরাও চিনি পাচ্ছেন না। বাজারে সহজে মিলছে না চিনি। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি দেশে চিনি আমদানি হয়েছে।
শনিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর কারওয়ান বাজার, কৃষিমার্কেটসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই জানা গেছে।
ডলার সংকটের কারণে গত কয়েক মাস থেকেই চিনি দাম বেড়ে যাচ্ছে। আগে কয়েক দফা দাম বাড়ানোর পরও চিনি পরিশোধনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসআরএ) দাবির মুখে সর্বশেষ গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কেজিতে পাঁচ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ফলে খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি পরিশোধিত খোলা চিনি ১০৭ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি ১১২ টাকা বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে সরকার।
দাম বাড়ানোর ব্যাপারে যুক্তি দেখানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত চিনির মূল্যবৃদ্ধি, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধি ও স্থানীয় পরিশোধনকারী মিলগুলোর উৎপাদন ব্যয় বিবেচনায় এনে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ও তাতে অনুমোদন দিয়েছে।
কিন্তু চার দিন অতিবাহিত হলেও মিল থেকে ডিলার ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের সহজেও দেওয়া হচ্ছে না চিনি। ফলে কারওয়ান বাজার, কৃষিমার্কেট, টাউনহলসহ বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বাজারে এখনো পাওয়া যাচ্ছে না চিনি।
চিনি আছে কি, জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের ইউসুফ জেনারেল স্টোরের ইউসুফ, আলী স্টোরের মোহাম্মদ আলী, ইয়াসিন জেনারেল স্টোরের ইয়াসিনসহ প্রায় খুচরা ব্যবসায়ীরা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, চিনি নেই। কোম্পানি থেকে দেয় না, তাই আমরা পাই না। এজন্য বিক্রি করতে পারছি না।
তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে তারা আরও বলেন, ‘সামনে রমজান। তাই কারসাজি করেই চিনি আটকে রাখছে। আমাদের দিচ্ছে না। ডিলারের কাছেও পাওয়া যাচ্ছে না।’
তাদের বক্তব্য জানার পর ওই মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ চিনির ডিলার মেসার্স জামাল ট্রেডার্স এর মো. জামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দাম বাড়ানোর পরও সহজে মিলমালিকরা চিনি দিচ্ছে না। তারা আগে যে লাভ দিতো দাম বাড়িয়ে খোলা ১০৭ টাকা ও প্যাকেট চিনি ১১২ টাকা করার পরও আমাদের লাভ কমিয়ে দিয়েছে। মানে কমিশন কম দিচ্ছে। তাহলে আমাদের ব্যবসা হবে কী করে।
বর্তমানে আমাদেরই ১১০ টাকা দরে চিনি বিক্রি করছে কোম্পানি। কেজিতে এক টাকা খরচা আছে। তাহলে কয় টাকায় বিক্রি করব? খুচরা রেটতো ১১২ টাকা। তাহলে খুচরা ব্যবসায়ীরা কীভাবে নেবে? আগে খুচরা বিক্রেতাদের কেজিতে ৩ টাকা লাভ দেওয়া হতো অর্থাৎ কেজিতে ৫ টাকা কম রাখত। দাম বাড়িয়েও তা-ই লাভ করছে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই ডিলার আরও বলেন, তারা কৌশল করে রমজান মাসকে টার্গেট করে বেশি দামের আশায় আটকে রাখছে চিনি। সরকারের দেখা উচিৎ। সিটি গ্রুপের ডিলারের কাছেও চিনি পাওয়া যায় না।
অপরদিকে, টাউনহল মার্কেটেও সহজে পাওয়া যাচ্ছে না চিনি। ওই মার্কেটের মনির স্টোরের আনোয়ার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘চিনি তো পাই না। কয়েক দিন থেকে কোম্পানি থেকে শুধু বলছে আসবে, আসবে। তারও আসছে না।’
এদিকে কৃষিমার্কেটেও পাওয়া যাচ্ছে না চিনি। এ ব্যাপারে মেসার্স পারভেজ এন্টারপ্রাইজের পারভেজ বলেন, ‘চিনি পাওয়া যায় না। তাই আমরা রাখি না। কোম্পানি দিলেতো আমরা পাব, বিক্রি করব?’ তাই ওই মার্কেটের সিটি গ্রুপের ডিলার খালেক অ্যান্ড সন্স এর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ম্যানেজার মো. সালেক এ প্রতিবেদককে বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে চিনির কেজি ১০৭ টাকা ও প্যাকেটজাত চিনি ১১২ টাকা করা হলেও চাহিদা মতো পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক চাহিদা থাকলেও কোনো দিন মাত্র ৫০ বস্তা পাচ্ছি। তাই ঘরে থাকে না। আসা মাত্র বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।
তাদের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোনের সংযোগ কেটে দেন। পরে উপদেষ্টা অমিতাব চক্রবর্তীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মিটিং এ আছি। ম্যাসেজ দেন কি বিষয়ে। ডিলারদের চিনি না দেওয়ার ব্যাপারে তাকে ম্যাসেজ দেওয়া হলেও কোনো উত্তর দেননি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে মোট চিনির চাহিদা ১৮ লাখ মেট্রিক টন। রমজান মাসে দুঈ লাখ টনের মতো চাহিদা হয়। তখনই হঠাৎ করে দাম বেড়ে যায় বাজারে। দেশে ৬০ হাজার টনের মতো দেশীয় আখ থেকে উৎপাদিত হয়। বাকি চাহিদা মেটাতে আমদানি করা ‘র সুগার’।
সিটি, মেঘনা, দেশবন্ধু, ইগলুসহ বিভিন্ন রিফাইনারি কোম্পানি পরিশোধন করে বাজারে বিক্রি করে। প্রতিদিন প্রায় ৫ হাজার টন চিনির চাহিদা। এসব কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা ২০ হাজার টনের মতো। কিন্তু গ্যাস সংকটের কারণে গত আগস্ট থেকে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ সুযোগে অস্থির হয়ে গেছে চিনির বাজার।
এ ছাড়া, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাবে ডলার সংকটে রিফাইনারি কোম্পানি দাম বৃদ্ধির চাপ দিলে সরকার গত ৬ অক্টোবর খোলা চিনি প্রতি কেজি ৯০ ও প্যাকেটজাত ৯৫ টাকা রেট করে দেয়। যা আগে খোলা ছিল ৮৪ টাকা ও প্যাকেট চিনি ৮৯ টাকা কেজি। তারপরও কোম্পানি থেকে লোকসান হচ্ছে এমন অভিযোগ করে দাম বৃদ্ধি চাপ দিলে গত ১৭ নভেম্বর সরকার একলাফে প্যাকেট চিনির দাম ৯৫ থেকে ১০৭ টাকা ও খোলা চিনির কেজি ৮৪ থেকে ১০২ টাকা কেজি ঘোষণা করে। আবার কেজিতে ৫ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তারপরও চিনি নিয়ে হাওকাও মিটছে না।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ভিন্ন কথা। যা দরকার তার চেয়ে বেশি চিনির আমদানি হয়েছে। এ ব্যাপারে তথ্য উপাত্ত তুলে ধরে নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, ডলার সংকটের কারণে চিনি আমদানি কম হচ্ছে এর কোনো ভিত্তি নেই। কারণ আমাদের ড্যাস বোর্ডের তথ্য বলছে, শুধু জানুয়ারি মাসেই ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৪১ মে.টন চিনি আমদানি হয়েছে। যা গত বছরের একই সময়ে হয়েছিল ৫ লাখ ১১ হাজার ৪৯৩ টন। বছরের ব্যবধানে বেড়েছে ৯৪ হাজার টনের বেশি বা ১৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ। অন্যান্য মাসেতো আমদানি হচ্ছে। রমজান মাসের আগেও আমদানি হবে।
জেডএ/এমএমএ/