কৃচ্ছ্রসাধনের চাপে উন্নয়নে হাতকড়া
চলতি বছরে জানুয়ারি মাসে একনেক সভায় ১০টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের দুর্নীতির তকমার জবাব দিয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে। ফাস্ট-ট্র্যাকের (মেগা প্রকল্প) মধ্যে বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, মেট্রোরেলও আলোর মুখ দেখেছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক মন্দাবস্থার কারণে কৃচ্ছ্র নীতিতে যেতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
অনেক যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। জরুরি না হলে তা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। অর্থও কাটছাঁট করতে বাধ্য হয়েছে। এর প্রভাবে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে বিদায়ী বছরে ডিসেম্বর মাসে কোনো প্রকল্প অনুমোদন হয়নি। অর্থ ব্যয়ে একেবারে হাতকড়া দেওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে। অর্থ ব্যয় করতে না পারায় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নও কমে গেছে।
ব্যয় সাশ্রয়ে কার্যকর কর্মপন্থা নিরূপণের লক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিবদের একগুচ্ছ নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরমধ্যে রাজস্ব ব্যয় সংকোচন, উন্নয়ন ব্যয়ের সর্বোত্তম ব্যবহার, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের মূল্য সহনশীল পর্যায়ে রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বলা হয়। তারপর থেকেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় উন্নয়ন প্রকল্পের গুরুত্ব বুঝে ব্যয় সংকোচনের তালিকা করে।
২৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ স্থগিত
বছরজুড়েই আলোচনায় ছিল বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতি গ্রহণ। গত জুলাই মাসেই গুরুত্ব অনুসারে প্রকল্পগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ভিত্তিতে গত আগস্টে প্রকল্প পুনর্বিন্যাস করে পরিকল্পনা কমিশন। গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোকে ‘এ’ শ্রেণিভুক্ত করা হয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অব্যাহত আছে। এ রকম ৬৪৬টি প্রকল্প রয়েছে। গুরুত্বের দিক থেকে মধ্যম শ্রেণির প্রকল্পগুলোকে ‘বি’ শ্রেণি করা হয়েছে। এ রকম প্রকল্প আছে ৬৩৬টি। সরকারি অংশের ২৫ শতাংশ বরাদ্দ স্থগিত রাখা হয়েছে এসব প্রকল্পে। আর ‘সি’ শ্রেণিতে থাকা প্রকল্পের পুরো টাকা ছাড়ই আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। এই শ্রেণির প্রকল্পের সংখ্যা ৮৫টি। ১ হাজার ৪৯৬টি প্রকল্পের বিপরীতে চলতি অর্থবছর এডিপিতে মোট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠন করেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে অন্য প্রকল্পের সঙ্গে বড় বড় ১০টি প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছে। যা ফাস্ট-ট্র্যাক (মেগা প্রকল্প) নামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তদারকি করা হচ্ছে। দ্রুত বাস্তবায়নে প্রতি অর্থবছরে অনেক অর্থও বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। এসব প্রকল্প অধিকাংশ বর্তমানে দৃশ্যমান। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অপবাদের জবাব দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে উদ্বোধন করা হয়েছে পদ্মা সেতু। এ ছাড়া, স্বপ্নের বঙ্গবন্ধু ট্যানেল (পাতাল সেতু) ও রাজধানীতে মেট্রোরেলও চালু করা হচ্ছে।
বিদায়ী বছরেও বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ শেষে করতে দেড় হাজারের বেশি প্রকল্পে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দও দেয় সরকার। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে সরকার ব্যয় সংকোচন করছে। এর প্রভাবে উন্নয়ন কাজও পিছিয়ে পড়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে আসছে না তেমন নতুন প্রকল্প।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র মতে, বছর খানেক আগেও প্রকল্প অনুমোদনে প্রতি সপ্তাহেই হতো জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক। কিন্তু সেই চিত্র পাল্টে গেছে।
গত ৪ জানুয়ারি মাসে একনেক সভায় সারা দেশের ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল ও অসহায় ৪ লাখ ৮৬ হাজার পরিবারকে পাকা ঘর করে দেওয়ার জন্য আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পটি চতুর্থ সংশোধন করা হয়। এটিসহ ১০টি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ওই সভায়। এরপরই কমতে থাকে একনেক সভা। প্রতিমাসে হচ্ছে গড়ে একটি। অন্যদিকে একনেকে প্রকল্পও উঠছে খুব কম। ফেরত পাঠানো হচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো থেকে আসা অনেক প্রকল্প প্রস্তাব। মূলত সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধন নীতির কারণেই দেখা যাচ্ছে এমন চিত্র।
ডিসেম্বরে অনুমোদন হয়নি কোনো প্রকল্প
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র মতে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে আসা প্রকল্প প্রস্তাব যাচাই-বাছাই শেষে অনুমোদনের জন্য একনেকে উত্থাপন করে পরিকল্পনা কমিশন। এই অনুমোদনের ভিত্তিতেই এডিপি বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হয়। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার একনেক সভা হয়ে থাকে। কিন্তু এখন তা আর প্রতি সপ্তায় হচ্ছে না। সর্বশেষ একনেক বৈঠক হয়েছে গত ২২ নভেম্বর। এরপর ডিসেম্বরে কোনো একনেক সভা হয়নি। গত পাঁচ মাসে মাত্র পাঁচটি একনেক সভা হয়েছে। অনুমোদন হয়েছে মাত্র ৪৫টি প্রকল্প। যেগুলোতে অর্থ বরাদ্দ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। যেখানে গত বছরের একই সময়ে ১৮টি একনেক সভা হয়েছে। মূলত অন্যান্য বছরে ব্যাপকভাবে অর্থ বরাদ্দ পেলেও এবারে তার ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে উন্নয়ন কাজে।
করোনা পরিস্থিতি এবং বৈশ্বিক মন্দাবস্থার কারণে কৃচ্ছ্র নীতিতে যেতে বাধ্য হয়েছে সরকার। অনেক যাচাই-বাছাই করে প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। জরুরি না হলে তা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। ব্যয় সাশ্রয়নীতি গ্রহণের পর থেকেই নতুন প্রকল্পের ক্ষেত্রে নেওয়া হচ্ছে বাড়তি সতর্কতা। পুরোনো প্রকল্প সংশোধনের ক্ষেত্রে বেশি টাকার বিষয় থাকলে তা আমলে নেওয়া হচ্ছে না। প্রকল্প প্রস্তাবের ক্ষেত্রে খুঁটিনাটি বিষয় যুক্ত করতে বলা হচ্ছে। এসব কৌশলের কারণে একনেক পর্যায়ে নতুন বা সংশোধনীর জন্য খুব বেশি প্রকল্প আসতে পারছে না। ফলে একনেক বৈঠকও অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। আগে যেভাবে কর্মব্যস্ততা ছিলো, সব সময় ব্যস্ত থাকতে হতো সেরকম দৃশ্য নেই পরিকল্পনা কমিশনে। যে কয়টি একনেক বৈঠক হচ্ছে, সেখানে প্রকল্প সংখ্যাও থাকছে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম। কম টাকার ছোট প্রকল্পগুলোই কেবল বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে সরকারের কৃচ্ছ্রসাধন নীতির প্রভাবে এডিপির বাস্তবায়নেও ধীরগতি নেমে এসেছে বছরটিতে। গত নভেম্বর পর্যন্ত চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের পাঁচ মাসে বাস্তবায়নের হার ছিল ১৮ শতাংশ। এখনো এক শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পারেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। যেখানে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও ৫৬টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এই সময়ের চেয়ে বেশি হারে এডিপির বাস্তবায়ন হয়েছিল।
জেডএ/এমএমএ/