বিশেষ সাক্ষাৎকার
‘অনেক ক্ষেত্রে চীনের চেয়েও এগিয়ে বাংলাদেশ’
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম
যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও ধ্বংস স্তুপের বাংলাদেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জন করে বিশ্বকে তাক লাগিয়েছে। কীভাবে এটা সম্ভব হয়েছে বিশেষ সাক্ষাৎকারে তার আদ্যপান্ত জানান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম। তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ঢাকাপ্রকাশ-এর সিনিয়র রিপোর্টার জাহাঙ্গীর আলম।
ঢাকাপ্রকাশ: ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ও আজকের বাংলাদেশকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
ড. শামসুল আলম: স্বাধীনতার সময় দখলদার বাহিনীরা বাংলাদেশের অবকাঠামোসহ সব জায়গা ধ্বংস করে দেয়। তাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার করতে অল্প সময়ে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিধ্বস্ত বাংলাদেশে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে এসে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য দেশ পুনর্গঠনে যুদ্ধের ২১ দিনের মধ্যে পরিকল্পনা কমিশন তৈরি করেন । অত্যন্ত শক্তিশালী পরিকল্পনা কমিশন করেছিলেন অর্থনীতিবিদদের নিয়ে। যা ভারত ৩ বছর পর, পাকিস্তান ৬ বছর পর করেছিল। তিনি কতটা গুরুত্ব দিয়েছিলেন এটা দেখলেই বুঝা যায়। সংবিধান তৈরি, নির্বাচন প্রদান, বিএডিসি, রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটসহ অনেক প্রতিষ্ঠান সাড়ে তিন বছরে গড়ে তুলেছিলেন তিনি। কৃষিক্ষেত্রে যে বিপ্লব, তার ভিত্তি বঙ্গবন্ধুই গড়েছিলেন।
কাজেই সে সময়ের তুলনায় আমূল পরিবর্তন আসে বাংলাদেশে। মাথাপিছু আয় ৯০ ডলার থেকে ২৫৫৪ ডলারে এসে গেছে। দরিদ্রতার হার ৮৪ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। দরিদ্র দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে। তার মধ্যে গত ১৩ বছরে যে অর্জন তা উল্লেখযোগ্য। অনেক দূর এগিয়েছে দেশ। অগ্রগতির কাল বলা যায় একে। কারণ, ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। কাজেই ৭২ সালের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। এক কথায় সব সূচকে অগ্রগতি হয়েছে দেশের। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম হয়েছে।
ঢাকা প্রকাশ: যুদ্ধ পরবর্তী একটি দেশ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে যেসব প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয় আমরা তার কতটুকু পেরেছি?
ড. শামসুল আলম: অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশকে এগিয়ে নিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ৫টি মৌলিক অধিকারকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু ১৯৭৫ সালে তাকে হত্যা করে সবকিছু তছনছ করে দেয় ষড়যন্ত্রকারীরা।
তার ফলে আবার থমকে যায় দেশ। তখন পরিকল্পনা হতো কিন্তু বাস্তবায়ন হতো না। এর ফলে মাথাপিছু আয় ২৩৮ ডলার থেকে আবার নেমে যায়। যা ৮৮ সালে আবার সে জায়গায় আসে। বিদেশিদের সঙ্গে সমঝোতা ও আনুকূল্যে তারা দেশ পরিচালনা করত। ১৯৭৫ থেকে শুরুটা হয়েছে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে। স্বৈরশাসনসহ বিভিন্ন কারণে ৮০ এর দশকে সাড়ে ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এরপর বিভিন্ন ঘটনার পটপরিবর্তনে ৯০ এর দশকে তার ধারাবাহিকতা থেকে যায়। কিন্তু ১৯৯৫ সালের আগে কোন পঞ্চবাষিকী পরিকল্পনা হয়নি। অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর প্রেসক্রিপশন দিয়ে। বলা যায় তেমন পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৫ম পঞ্চবাষিকী আমরা পাই ১৯৯৬ সালে। বাড়তে থাকে উন্নয়নের ধারা। অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হতে থাকে। এর পর আসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু তারা বিতর্কিত ছিল।
২১ শতকেও অস্থিতিশীল আধা-সামরিক সরকারের আমল শুরু হয়। ২০০২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল না। কারণ, সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সময় পার করা হয়েছ সে সময়। দেশ উদ্দেশ্যহীন ছিল। কিন্তু ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টি ও অন্তর্দৃষ্টির নেতৃত্বের ফলে বলা যায় প্রথম পঞ্চবার্ষিকী আনা হয়। নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ, প্রেক্ষিত ২০২১ প্রণয়ন করেন। দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২০১০ সালেই বলা হয়েছিল বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। সাড়ে ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ৭ শতাংশ ।
ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১১-১৫) অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, বেশি বিদ্যুৎ উৎপদান, বিদেশে লোক পাঠানোসহ সব ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেটা বাস্তবে রূপ নিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম হয়েছে প্রবৃদ্ধিতে, ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। পরিকল্পনার সঙ্গে মিল রেখে উদ্যোগ নেওয়ায় পাঁচ লাখের টার্গেট ধরা হলেও সাত লাখ করে বিদেশে লোক পাঠানো হয়েছে। রিজার্ভ হুহু করে বেড়েছে, করোনার আগে ৪৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টির জন্য এই সাফল্য অর্জন সম্ভব হয়েছে। এর ফলে করোনার আঘাত মোকাবেলা করে আবারও প্রবৃদ্ধির গতি বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। উৎপাদনে আঘাত হানেনি। আমেরিকা, ইউরোপ ও ভারতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়েনি।
ঢাকা প্রকাশ: বিশ্বের অন্যান্য যেসব দেশ রোল মডেল তাদের সঙ্গে তুলনা করলে আমরা কি তাদের মতোই এগিয়েছি?
ড. শামসুল আলম: পৃথিবীতে উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ। ভিয়েতনামের সঙ্গে কিছুটা তুলনা করতে পারি। রফতানিতে এগিয়ে আছে। তবে জিডিপিতে বাংলাদেশের কাছেও নেই। অনেক উন্নত হলেও চীনকেও এর সঙ্গে আনা যায় না। কারণ, প্রকাশ্যে জনমত প্রকাশের সামান্যতম সুযোগ নেই সে দেশে। যা বাংলাদেশে সম্ভব হয়েছে। গণতান্ত্রিকভাবে সবার মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। যেটা চীন ও ভিয়েতনামে সুযোগ নেই। বর্তমানে বাংলাদেশকে অনেকে অনুসরণ করছে।
ঢাকা প্রকাশ: স্বাধীনতার ৫০ বছর পর অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অগ্রগতির খাত গুলো কী কী?
ড. শামসুল আলম: প্রবৃদ্ধির অনেক অগ্রগতি হয়েছে। কারিগরি শিক্ষার অগ্রগতি হয়েছে, ১০৮টি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। মুত্যৃ হার কমেছে। নারী শিক্ষার হারও বেড়েছে। বিশাল অগ্রগতি হয়েছে। ছাত্রী বেশি মাধ্যমিকে। মাথাপিছু আয় আড়াই গুণ হয়েছে গত ১৩ বছরে। সামজিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গুরুত্ব দেওয়ায় ব্যাপক অগ্রহতি হয়েছে।
ঢাকা প্রকাশ: দারিদ্র বিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ৫০ বছরে আমাদের প্রাপ্তি কতটুকু?
ড. শামসুল আলম: ২০০৫ সালে দারিদ্রের হার ৪০ শতাংশ থাকলেও বর্তমানে তা ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। হত দরিদ্রও অর্ধেক কমে ১০ শতাংশে এসেছে। রিজার্ভ বেড়েছে অনেক, ৫০ বিলিয়ন ডলার ছুঁইছুঁই করছে। সব মিলে বলা যায় বাংলাদেশ বিশ্বে বিস্ময়।
ঢাকা প্রকাশ: স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ড. শামসুল আলম: আমরা থেমে নেই। উন্নয়নের জন্য কাজ করা হচ্ছে। রূপকল্প-২০২১ প্রণয়ন করে ২০৩১ মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। ১০০ বছরের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে 'বদ্বীপ' পরিকল্পনায়। কাজেই বলা যায় ২০২৫ সালে দুই অংকের অর্থ্যাৎ ১০ শতাংশের প্রবৃদ্ধিতে পৌঁছতে পারবে বাংলাদেশ।
জেডেএ/এমএমএ/