চিনি আছে ট্রাকে, নেই বাজারে
কোনো কিছুতেই স্থির হচ্ছে না চিনির বাজার। এখনো হাহাকার লেগে আছে বাজারে। একদিকে ভোক্তারা বলছেন, ১১৫ টাকার কমে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে খুচরা বিক্রেতাদের দাবি পাইকারি বাজারে এখনো চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। আসছে আসছে বলে প্রতিদিন আশ্বাস দিয়ে রাখছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ১৫ দিন পার হয়ে গেলেও মিল থেকে চিনি দিচ্ছে না। ডিও দেওয়ার পরও মিলছেনা। প্রতিদিন যোগাযোগ করা হলেও দেওয়া হচ্ছে না চিনি। আর এসবের চূড়ান্ত ভুক্তভোগী ভোক্তারা।
সরকার ৬ অক্টোবর চিনির দাম কেজি প্রতি ৯০ থেকে ৯৫ টাকা বেঁধে দেওয়ার পর থেকেই চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। মিলমালিকদের দাবি, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন কমে গেছে। তাই সরবরাহও কমে গেছে।
তবে টিসিবি থেকে ৫৫ টাকা কেজি চিনি বিক্রি করা হলেও তা চাহিদার তুলনায় একেবারে কম। তা পেতে ভোক্তাদের পোহাতে হচ্ছে দীর্ঘ লাইনের জট। অপরদিকে বাজারে চিনি না পাওয়া গেলেও সিটি, মেঘনা ও দেশবন্ধু গ্রুপ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রাক সেলে ৯৫ টাকা কেজি প্যাকেট চিনি বিক্রি করছে। বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত এই বিক্রি কার্যক্রম চলবে।
বৃহস্পতিবার (২৭ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ানবাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
কারওয়ান বাজারে সরেজমিনে গেলে মনির চা স্টোরের মনির জানান, ১১৫ টাকা কেজি খোলা চিনি কেনা হয়েছে। শুনেছি কমবে, ৯০ টাকা কেজি হবে, সরকার যা ঘোষণা করেছে ২০ দিন আগে। কিন্তু কমছে না। এভাবে আর কতদিন বেশি দামে কিনতে হবে।
তার এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে কথা হয় কারওয়ানবাজারের মায়ের দোয়া জেনারেল স্টোরের শাহ আলম খানের সঙ্গে। চিনি কত করে কেজি? এমন প্রশ্ন করা মাত্র তিনি ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, চিনি নেই। বিক্রি করব কি। কয় দিন থেকে নেই? বলেন, সরকার খোলা ৯০ ও প্যাকেট চিনি ৯৫ টাকা দাম ঘোষণা করার পর থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না। পাইকারি বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না। জামাল ট্রেডার্সসহ বিভিন্ন পাইকারি ব্যবসায়ীরা প্রতিদিন শুধু আশ্বাস দিচ্ছে। কিন্তু পাচ্ছি না। এভাবে আর কতো দিন চলবে, ভালো লাগছে না। কারণ ক্রেতারা চিনি না পাওয়ায় খুবই বিরক্তবোধ করছেন। অনেকে আছে লাইনেতো দাঁড়াতে পারে না। কম দামের চিনি নিতেও পারে না।
শুধু শাহ আলম নয়, ওই বাজারের শাহপরান জেনারেল স্টোর, ইউসুফ জোনারেল স্টোরসহ বিভিন্ন খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, চিনি নেই। এভাবে আর কতো দিন চলব। তারা আরও বলছেন, ভোক্তা অধিদপ্তর থেকে শনিবার মিটিং করে আশ্বাস দিয়েছেন যে চিনি সমস্যা কেটে যাবে। কিন্তু এখনো হাহাকার লেগে আছে। কেউ দিতে পারছে না।
খুচরা ব্যবসায়ীদের অভিযোগের সত্যতা জানতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাদেরও অভিযোগ, চিনি নেই। মিল থেকে দিচ্ছে না। এ ব্যাপারে মেঘনা গ্রুপের ডিলার কারওয়ান বাজারের মেসার্স জামাল ট্রেডার্সের মো. খোকন এই প্রতিবেদককে জানান, চিনি কিভাবে পাব, মিল থেকে তো দিচ্ছে না। কখন থেকে নেই, এমন প্রশ্নের জবাবে খাতা দেখিয়ে তিনি বলেন, গত ৯ অক্টোবর শেষ চালান চিনি এসেছে। এরপর থেকে আর পাচ্ছি না। ডিও করতে করতে ১৪ হাজার কেজি জমে গেছে। প্রতিদিন মিলে যোগাযোগ করা হচ্ছে, দিচ্ছি করে আর দিচ্ছে না। কেন দিচ্ছে না জানেন কি? বলেন, মিলে নাকি বিদ্যুৎ পাচ্ছে না, উৎপাদন কমে গেছে। তাই দিতে পারছে না।
অন্যান্য ডিলারদেরও একই বক্তব্য, মিল থেকে দিচ্ছে না চিনি। পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাই পাইকারি বাজারেও পাওয়া যাচ্ছে না। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কৃষি মার্কেটের সিটি এন্টারপ্রাইজের আবু তাহের সহ বিভিন্ন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা এবং টাউনহলের নিউ হক ভ্যারাইটি স্টোরের মো. আবদুল হাই লিটনসহ বিভিন্ন বিক্রেতারা জানান চিনি পাওয়া যাচ্ছে না প্রায় ১৫ দিন থেকে। তাই বিক্রি করতে পারছি না।
এদিকে চিনি বাজার অস্থিতিশীল হলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে রবিবার (২৩ অক্টোবর) যে কোনো মূল্যে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বলা হয়েছে। এমন অবস্থায় জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর রবিবার চিনি রিফাইনারি মালিক, ডিলার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতিকে নিয়ে সভা করে। ওই দিনই মিলমালিকদের পক্ষ থেকে দেশবন্ধু গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, আসলে চিনির বাজার অস্থির হওয়ার জন্য আমাদের সবার কিছু ত্রুটি রয়েছে। তবে আর সমস্যা হবে না। আমরা যে কেউ চাইলে চিনি দিব। কারণ পরিশোধিত ও র' সবমিলিয়ে ৩ লাখ ৭৫ হাজার টন চিনি রেডি রয়েছে। তাতে তিন মাস চলা যাবে।
অপরদিকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিজ্জামান বলেন, ‘আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ‘র সুগার’ আছে। কিন্তু গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটের কারণে রিফাইন করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। প্রতিদিন আমাদের পাঁচ হাজার মেট্রিক টন চিনির চাহিদা। পাওয়া যাচ্ছে সাড়ে তিন হাজার টন। এটা প্রতিদিন উৎপাদন করতে পারলে সমস্যা আর থাকবে না। কারণ মিলমালিকরা আশ্বস্ত করেছেন, যে যা চিনি চাইবে তারা চিনি দিবেন।
এর একদিন পর থেকেই সিটি, দেশবন্ধু ও মেঘনা গ্রুপ ৯৫ টাকা কেজি প্যাকেট চিনি বিক্রি করছে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দেখা যায় সিটি গ্রুপ ট্রাকে করে ৯৫ টাকা কেজি দরে চিনি বিক্রি করছে। এ ব্যাপারে সিটি গ্রুপের হেমায়েত ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘সকাল ৯টার পর থেকে ৯৫ টাকা কেজি চিনি বিক্রি শুরু হয়েছে। চলবে রাত পর্যন্ত। এ ব্যাপারে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, বুধবার (২৬ অক্টোবর) থেকে রাজধানীর মতিঝিল, আজিমপুর, মোহাম্মদপুরের টাউনহল, মিরপুর-১ ও কারওয়ান বাজারে সিটি গ্রুপের চিনি বিক্রি করা হচ্ছে। সরকারের বেঁধে দেওয়া রেটে প্রতি কেজি প্যাকেট চিনি ৯৫ টাকা দরে বিক্রি করা হবে। ভোক্তাদের স্বার্থে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
অপরদিকে, মেঘনা গ্রুপের মো. সাহাজু উদ্দিন মৃধা বলেন, ‘সকাল ৯ টার পর থেকে রাত পর্যন্ত কারওয়ানবাজার, মতিঝিল ও নিউমার্কেটে ৯৫ টাকা কেজি চিনি বিক্রি করা হচ্ছে। বাজার স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলমান থাকবে। অন্যদিকে দেশবন্ধু গ্রুপও বুধবার সকাল থেকে মতিঝিল, সচিবালয়, প্রেস ক্লাব, জিরো পয়েন্ট, নিউমার্কেট ও কারওয়ান বাজারে নির্ধারিত দামে (প্রতি কেজি ৯৫ টাকা) চিনি বিক্রি করছে।
এদিকে বাজার স্থিতিশীল করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও ৫৫ টাকা কেজি চিনি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তা শুরু করলেও চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত কম। কারণ টিসিবির মুখপাত্র মো. হুমায়ন কবীর ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, ঢাকাতে ১১টি এলাকায় প্রতিদিন ১ হাজার ৫০০ কেজি চিনি বিক্রি করা হচ্ছে, দেড় হাজার পরিবারের জন্য। ট্রাকের অপেক্ষায় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে অনেকে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গোডাউন থেকে ট্রাকে মাল আসতে দুপুর হয়ে যাছে। কারণ অন্য ডিলারদেও মাল দেওয়া হচ্ছে। তাই একটু দেরি হচ্ছে ট্রাক বের হতে।
উল্লেখ্য, গত ৬ অক্টোবর সরকার প্রতি কেজি খোলা চিনি ৯০ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনির কেজি ৯৫ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এখনো বাজারে সহজে পাওয়া যাচ্ছে না।
জেডএ/এএস