আগামীতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার আশঙ্কা
বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে ক্রমাগত। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। বেশিরভাগ মানুষই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের হিসাব মিলাতে পারছেন না। কোনো কোনো নিত্যপণ্যের দাম দেড়গুণ ছাড়িয়ে গেছে। তারপরও বিবিএস বলছে, মে মাসে মুল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ আগের বছরের মে মাসের ১০০ টাকার জিনিসের দাম বর্তমানে ১০৭ টাকা ৪২ পয়সা। মে মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি আট শতাংশের সীমা ছাড়িয়েছে।
গত বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলন করেছিলেন ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। বাস্তবে বেশি হওয়ায় ৯ জুন বাজেটে সংশোধন করে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ নির্ধারণ করেছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার মূল্যস্ফীতির যে তথ্য দিচ্ছে তা বাস্তবভিত্তিক নয়। কারণ, সম্প্রতি সব জিনিসের দাম যেভাবে বেড়েছে তা বিবিএসের মূল্যস্ফীতির দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাবে। আগামীতে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে।
তাদের বক্তব্যে সঙ্গে বাজারের তথ্য প্রদানকারি সরকারি সংস্থা খোদ ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশও (টিসিবি)বলছে, বছরের ব্যবধানে সব জিনিসের দাম বেড়েছে। ভোজ্যতেলের দাম ৫৩ শতাংশ বেড়েছে। কারণ এক বছর আগের খোলা তেল ১২০-১২৫ টাকা লিটার থেকে বর্তমানে বেড়ে ১৯২ টাকা এবং ১৪০-১৫০ টাকার প্যাকেটজাত তেল ১৯৫-২০৫টাকা লিটার বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। বাস্তবে বাজারে আরও বেশি দামে ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে।
চালের বাজারেও একই চিত্র। টিসিবি বলছে, এক বছরের ব্যবধানে ৫৬-৬৫ টাকার চিকন চাল বর্তমানে ৬৪ থেকে ৭৫ টাকা কেজি ও ৪২-৪৫ টাকার বোরো চাল ৫২ টাকা এবং ৩০ থেকে ৩৬ টাকার গমের আটা ৪০ থেকে ৫৫ টাকা কেজি বিক্রি করছেন বিক্রেতারা। চালের মুল্য বেড়েছে ১৫ শতাংশ ও আটার দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশের বেশি।
অথচ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ তথ্যে এসব জিনিসের দাম কম দেখাচ্ছে। সংস্থাটি মূল্যস্ফীতির প্রতিবেদনে দেখা যায়, মে মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৪২ শতাংশ। আগের মাসে ৬ দশমিক ২৯ ও মার্চ মাসে ছিল ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। এরমধ্যে মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৩০ শতাংশ। যা এপ্রিলে ছিল ৬ দশমিক ২৩ শতাংশ আর মার্চে ৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ। গত বছরের মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। এর মধ্যে খাদ্যে ছিল ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
গত মাসে শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে। মে মাসে গ্রামাঞ্চলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ, আর শহরে হয়েছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তৃতীয় মেয়াদে মূল্যস্ফীতির এর হার সর্বোচ্চ দাঁড়িয়েছে গত মে মাসে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে সার্বিক গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ। ওই বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ১৫ শতাংশ। এরপর সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপে কমতে শুরু করে। তাই বছরের ব্যবধানে ২০১২-১৩ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৭০ শতাংশে নেমে আসে। ওই বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয় ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এরপর থেকে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচক নিম্নমুখীই ছিল।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, গত কয়েক মাসের মতো মে মাসেও শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি মূল্যস্ফীতি হয়েছে; এই মাসে গ্রামে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর শহরে হয়েছে ৬ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অর্থাৎ শহরের চেয়ে গ্রাম এলাকায় পণ্যমূল্য ও অন্যান্য সেবার দাম বেড়েছে বেশি।
বিশ্বব্যাপি করোনা, ক্রমাগত ডলারের অবমূল্যায়ন ও গত ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকে অস্বাভাবিকভাবে। অর্থাৎ আগের ১০০ টাকার পণ্য ১৫০ টাকায় ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে।
অথচ বিবিএস মূল্যস্ফীতির যে তথ্য দিচ্ছে তা বাজারের চেয়ে কম। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বেশ কিছুদিন ধরেই সরকার বা বিবিএসের দেওয়া হিসাবের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বাস্তবে অনেক বেশি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম) বলছে, দেশে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত হার বিবিএসের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাবির অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, ‘পণ্যমূল্য নিয়ে সরকারি সংস্থা বিবিএস যে তথ্য দিচ্ছে, তা বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বিবিএস পুরোনো ভিত্তি বছর ধরে মূল্যস্ফীতির হিসাব করছে, যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য না। নিত্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে যাওয়ায় নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষ খুবই চাপে আছে।’
গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তিনি বলেন, ‘বিবিএসের মূল্যস্ফীতির হিসাব বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত নয়। বাজারের যে অবস্থা তাতে মূল্যস্ফীতি এখন ১২ শতাংশ হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ে সরকারের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের মূল্যস্ফীতির তথ্য নিয়ে প্রশ্ন আছে। কারণ বাজারের পণ্যমূল্যের সঙ্গে বিবিএসের তথ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশ্ববাজারেও সব জিনিসের দাম বেশ বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরও বাড়বে বলে মনে হচ্ছে। তার প্রভাব আমাদের এখানেও পড়বে, মূল্যস্ফীতি বাড়বে।’
চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, শাকসবজি থেকে শুরু করে মাছ-মুরগিসহ সব ধরনের প্রয়োজনীয় খাবারের দাম বৃদ্ধির কারণে মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
তাই চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৩ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য ধরা হলেও অর্থমন্ত্রী বাধ্য হয়ে ৯ জুন বাজেটে সংশোধন করে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ ঘোষণা দিয়েছেন।
অর্থমন্ত্রী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে গড় মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ লক্ষ্য ধরেছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ‘প্রধান চ্যালেঞ্জ’ হিসেবেও উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট এরইমধ্যে ঝুঁকিতে ফেলছে বিশ্বসহ দেশের অর্থনীতিকে। কঠিন মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।’
জেডএ/এনএইচবি/এমএমএ/