মজুতদারের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড, যুক্ত হচ্ছে ভোক্তা আইনেও
প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুতদারি নিষিদ্ধ করে মজুতদার বা কালোবাজারির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও বর্তমানে এ আইনের প্রয়োগ করতে পারে না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। ভোক্তা অধিকার মজুতদারদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিতে পারে। এ আইন দিয়েই তারা অবৈধভাবে পণ্য মজুত, ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি, ওজনে কম দেওয়াসহ অপরাধিদের শাস্তি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তারপরও অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার লোভে বেপরোয়া হয়েছে উঠেছে। মানছে না কোনো আইন। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ১৯৭৪ সালের সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিশেষ ক্ষমতা আইনটি ভোক্তা আইনে যুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এ লক্ষ্যে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষের সভাপতিত্বে বুধবার (১৮ মে) আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হবে। সভায় কৃষি, মৎস ও প্রাণি সম্পদ, খাদ্য, শিল্পমন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন।
আলোচনা করে তার সারসংক্ষেপ মন্ত্রীপরিষদ সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। এরপরই সংসদে অনুমোদন পেলে তা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের আইনে পরিণত হবে।
এ ছাড়া জরিমানার পরিমানও বাড়িয়ে দেড়গুণ থেকে দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫০ হাজার থেকে এক লাখ ও দুই লাখ থেকে তিন লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুতদারি নিষিদ্ধ করে মজুতদার বা কালোবাজারির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা আজীবন কারাদণ্ডের মতো কঠোর শাস্তির বিধান আছে। অপরাধের মাত্রা ভেদে অন্যান্য মেয়াদের কারাদণ্ড ও জরিমানা করার কথা উল্লেখ রয়েছে।
অপরদিকে, খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ২০১১ সালের ৪ মে ১৩নং আইনে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে আমদানিকারক, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং চালকল মালিকরা কী পরিমান খাদ্যপণ্য মজুত করতে পারবেন।
তাতে বলা হয়েছে- সরকারের লাইসেন্স ছাড়া কোনো ব্যবসায়ী এক টনের বেশি খাদ্যসামগ্রী মজুত রাখতে পারবেন না।
ভোজ্যতেলের মধ্যে পাইকারি পর্যায়ে সয়াবিন ও পামওয়েল তেল ৩০ টন ৩০ দিন, খুচরা পর্যায়ে ৫ টন ২০ দিন ও আমদানি পর্যায়ে ২৫ ভাগ ৫০ দিন মজুত রাখার নিয়ম করা হয়েছে। এই আইন এখনো কার্যকর বলে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে। তবে অনেক ব্যবসায়ী বলছেন, মজুত করার ব্যাপারে আইনে কী আছে জানেন না তারা।
শুধু তেল নয়, ধান, চাল মজুতের ব্যাপারেও আইনে বলা হয়েছে- পাইকারি পর্যায়ে ধান ও চাল ৩০০ টন ৩০ দিন এবং খুচরা পর্যায়ে ১৫ টন মজুত রাখা যাবে ১৫ দিন। আর আমদানিকৃত হলে ৩০ দিন রাখা যাবে। একে ভিত্তি করেই বাজারে প্রতিনিয়ত মজুতদারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। তারপরও অবৈধ মজুত ঠেকানো যাচ্ছে না।
তাই ২০০৯ সালের ২৬নং ভোক্তা আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ২০১৪ সাল থেকে এ আইন সংশোধনের জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা দেরি হচ্ছে বা আলোর মুখ দেখে না। সর্বশেষ করোনাকালে ই-কমার্স ব্যবসা দিয়ে ভোক্তাদের সঙ্গে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান প্রতারণা করলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নড়েচড়ে বসে। এবার ই-কমার্স ব্যবসা করতে গিয়ে কেউ ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা করলে তাতে শাস্তির বিধান করা হচ্ছে।
ইতোমধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন-২০২১ এর খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তাতে ই-কমার্সকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। সংশোধিত আইনে উল্লেখ করা হয়েছে-রেজিস্ট্রেশন অর্থাৎ ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ব্যবসা করলে তার বিরুদ্ধে মামলা হবে। একইসঙ্গে তিন বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকছে। এছাড়া বিদ্যমান ভোক্তা আইনের কিছু ধারাও সংশোধন করে শান্তির পরিমান বাড়ানো হচ্ছে।
ভেজাল ও নকল ওষুধ বা খাদ্য বিক্রি করলে ১৯৭৪ সালের স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। একই অপরাধে ভোক্তা আইন-২০০৯ এ তিন বছর কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা জরিমানার বিধান করা আছে। তা সংশোধন করে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টের বিধান অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া ভোক্তা আইনের ৩৭ থেকে ৫৬ নং পর্যন্ত যে ধারা রয়েছে সেখানেও সংশোধন করে শাস্তির পরিমান বাড়ানো হচ্ছে। যেমন ৫০নং ধারায় নকল পণ্য প্রস্তুত বা উৎপাদন করলে দুই লাখ টাকা জরিমানা থেকে তিন লাখ করার বিধান করা হচ্ছে।
৫১ নং ধারাতেও মেয়াদ উত্তীর্ণ কোনো পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করার অপরাধে ৫০ হাজার টাকা থেকে তিন লাখ টাকা জরিমানা করা হচ্ছে। এছাড়া ৫৩ নং ধারায় অবহেলার কারণে সেবা গ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য ও জীবনহানি ঘটলে দুই লাখ টাকার যে জরিমানার বিধান আছে তা থেকে বাড়িয়ে তিন লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে সংশোধিত আইনে। একইসঙ্গে ৪৫ নং ধারায় প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা বিক্রি বা সরবরাহ না করলে ৫০ হাজার থেকে এখন লাখ টাকা জরিমানা এবং ৪১ ধারায় কেউ ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রি করলে দুই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এসব ব্যাপারে জানতে জাতীয় জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম শফিকুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তার কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘ভোক্তা সংরক্ষণ-২০০৯ আইন অনুযায়ী ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা করতে কাজ করো হচ্ছে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তাই প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেকে সর্তক হলেও অনেকে অতি মুনাফার লোভ সামলাতে পারছে না। তাই সুযোগ পেলেই মজুত করছে বিভিন্ন পণ্য। সেজন্য ভোক্তা আইন সংশোধন করা হচ্ছে। এটা কার্যকর হলে খাদ্যপণ্য মজুতের পরিমান কমে যাবে।’
জানতে চাইলে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন,‘ ভোক্তাদের স্বার্থে এই আইন সংশোধন করার জন্য অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি করা হয়েছে। বুধরার এর মিটিং হবে। তাতে সব কিছু ফাইনাল হলে মন্ত্রীয় সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। তাতে কোনো আপত্তি না থাকলে সংসদে উপস্থাপন করা হবে। এখানে অনুমোদন পেলেই আইনে পরিণত হবে এবং ভোক্তাদের স্বার্থে ব্যবহার করা হবে।
অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এ আইন ভোক্তা আইনে যুক্ত হতে এতো দেরি কেন। এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘দেখেন, আমি সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর কয়েকটা আইন পাস হয়েছে। এবার ভোক্তা আইন ও কোম্পানি আইন নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। আশা করি, আমার সময়ে ভোক্তা আইন আলোর মুখ দেখবে।’
জেডএ/এমএসপি