এলসি ছাড়া ব্যাংকে মিলছে না ডলার
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ডলারের বিনিময় হার (এক্সচেঞ্জ রেট) বা এক ডলার কেনা-বেচা হচ্ছে ৮৬ দশমিক ৭০ টাকায়। কিন্তু বাস্তবে ব্যাংকে তা মিলছে না। ব্যাংকগুলো বলছে পরিচিত ছাড়া কারও এলসি ওপেন করা যাবে না। তাও আবার ৮৭ টাকা রেটে। চিকিৎসা বা ভ্রমণের জন্য ডলার বিক্রি হবে না। আর মানি এক্সচেঞ্চগুলোতে ডলারের দাম ছাড়িয়েছে ৯৩ টাকা।
মঙ্গলবার (১০ এপ্রিল) ব্যাংকপাড়া নামে খ্যাত মতিঝিল ও দিলকুশায় সরেজমিনে ঘুরে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজারে ডলারের সংকট। তাই প্রতিনিয়ত বাড়ছে ডলারের দাম। কমছে টাকার মান অর্থাৎ ক্রমেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে টাকা। এর ফলে রপ্তানিকারকরা লাভবান হলেও আমদানি ব্যয় ও পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা বেশি দিন থাকবে না বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে।
কয়েক মাস থেকে ডলার দাম বেড়েই যাচ্ছে অর্থাৎ টাকার মান কমছে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক ঈদের ছুটির আগে ২৭ এপ্রিল ডলারের বিপরীতে টাকার মান ২৫ পয়সা কমিয়েছিল। তার আগে প্রতি ডলারের জন্য ৮৬ টাকা ২০ পয়সা ছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এরপর থেকেই শক্তিশালী হতে থাকে ডলার অর্থাৎটাকার মান কমছে বা দুর্বল হচ্ছে টাকা।
গত ২২ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংক মার্কিন ডলারের বিপরীতে প্রতি ডলারের দাম ৮৬ থেকে বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় নির্ধারণ করেছে। এর আগে জানুয়ারি মাসের শুরুতে ডলারের মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করা হয়েছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে মঙ্গলবার এক ডলারের জন্য ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা লাগে। কিন্তু ব্যাংক ও মানি এক্সচেঞ্চগুলো ডলার বিক্রি করছে এর চেয়ে পাঁচ-ছয় টাকা বেশি দরে ৯৩ টাকা পর্যন্ত।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, মহামারি করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। আবার রপ্তানির তুলনাই আমদানি বেশি হচ্ছে। এতে ডলারের দাম বাড়ছে। রেমিটেন্সও কম আসছে। তাই বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থা থেকে রক্ষা পেতে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারও বিক্রি করছে। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের মঙ্গলবার পর্যন্ত ৪৭০ কোটি (৪.৭০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। বেড়েই চলেছে ডলারের দর।
ডলারের দাম জানতে বিভিন্ন ব্যাংকের বৈদেশিক বিনিময় শাখা ও মানি এক্সচেঞ্চগুলোতে মঙ্গলবার যোগাযোগ করা হয়। এ সময় ব্যাংকাররা বলছেন, ডলারের সংকট। তাই শুধু পরিচিত ক্লায়েন্টদের এলসি ওপেন করা হচ্ছে। অন্য কারও কাছে ডলার বিক্রি করা সম্ভব না। উত্তরা ব্যাংকের দিলকুশা শাখার বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঢাকাপ্রকাশ-কে জানান, শুধু পরিচিত গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ৮৭ টাকা রেটে প্রতি ডলারের দাম ধরে এলসি খোলা হচ্ছে। অন্য কারও কাছে ডলার বিক্রি করা সম্ভব না।
মতিঝিলের পূবালী ব্যাংকের বৈদেশিক বাণিজ্য শাখার মো. জসিম বলেন, ‘কেউ চাইলেই ডলার বিক্রি করা যাবে না। শুধু পরিচিত ক্লায়েন্টদের এলসি খোলা হচ্ছে। বিদেশ ভ্রমণের জন্য কারও কাছে ডলার বিক্রি করা যাবে না। তবে চিকিৎসার জন্য কেউ চাইলে ডাক্তারের সার্টিফিকেট, পাসপোর্ট ভিসা দেখাতে হবে। আমাদের কাছে থাকলে তখন বিবেচনা করা হবে। বর্তমানে ডলার সংকট। তাই সবার কাছে বিক্রি করা যাচ্ছে না ডলার।
ব্যাংকগুলো বেশি দামে ডলার বিক্রি করলে বাংলাদেশ ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে থাকে।
কেননা কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আন্তব্যাংক দরে ডলার কিনে সেই ডলার বিক্রি করে ব্যাংকগুলো। তাই সার্বিক ব্যাপারে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ঢাকাপ্রকাশ-কে তিনি বলেন, ‘মূলত প্রবাসীদের আয় ও রপ্তানির মাধ্যমে দেশে ডলার আসে। অপরদিকে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সম্প্রতি বিভিন্ন কাঁচামাল ও মেশিনারিজের বড় বড় এলসি খোলার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আবার করোনাকালে অনেক আমদানি বিল পরিশোধ করা হয়নি। পরে তা করতে হচ্ছে। এতে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এসব কারণে ডলারের চাপ বেড়েছে।
তবে ব্যাংক গুলো বিদেশ ভ্রমণ বা চিকিৎসার জন্য ডলার বিক্রি করবে না এমন হতে পারে না। কারণ কোথায় ডলার বিক্রি করা যাবে গাইডলাইনে তা স্পষ্ট বলা আছে। ডলারের সংকট দূর করতে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রতি নিয়ত ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ৪০ বিলিয়নের বেশি রিজার্ভ রয়েছে। শঙ্কার ও ভয়ের কিছু নেই। রেমিটেন্স বাড়াতে প্রণোদনাও বাড়ানো হয়েছে। গত মাসে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। রপ্তানিও বেড়েছে।’
এভাবে কি ডলারের সংকট চলতে থাকবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘করোনা মহামারির কারণে গত কয়েকটি ঈদ ভালোভাবে করতে পারেনি দেশের মানুষ। এবার করোনামুক্ত পরিবেশে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে ভিন্ন আমেজে ঈদ উদযাপিত হয়। প্রবাসীরা পরিবার-পরিজনের কাছে বেশি করে অর্থ পাঠাচ্ছেন।
এ ছাড়া বিলাসী পণ্যের আমদানি রোধে বাধ্য হয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় ও চিকিৎসা খাত ছাড়া সব পণ্য আমদানির ঋণপত্রে নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের জন্য গত ১১ এপ্রিল ব্যাংকগুলোকে নির্দেশনা দিয়ে এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করা হয়েছে। তাকে অনেকটা বিলাসী পণ্যের আমদানি কমে যাবে।
রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারে নিচে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বেশি করে আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন (৪ হাজার ২০০কোটি) ডলারের নিচে নেমে এসেছে। আকুর (এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন) রেকর্ড ২২৪ কোটি (২.২৪ বিলিয়ন) ডলার আমদানি বিল পরিশোধ করেছে। এর ফলে মঙ্গলবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের ২৪ আগস্ট এই রিজার্ভ অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে ৪৮ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করে।
চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-মার্চ) ৬১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি।
তবে দশ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ১ হাজার ৭৩০ কোটি ৭৭ লাখ (১৭.৩০ বিলিয়ন) ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। অপরদিকে এই দশ মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে ৪৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৫দশমিক ১৪ শতাংশ বেশি।
জেডএ/এমএমএ/